২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অপরাধের স্বরূপ ও প্রতিকার

-

অপরাধ শব্দটির সমার্থক দোষ, ত্রুটি, আইনবিরুদ্ধ কাজ, দণ্ডনীয় কর্ম, পাপ, অধর্ম, অন্যায়, অসঙ্গতি, দুষ্কর্ম, দুর্নীতি, কুনীতি, কুকর্ম, অপকর্ম ইত্যদি। এটি মানুষের ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত দু’ভাবেই সংঘটিত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তরে অসৎকর্ম ও সৎকর্ম উভয়ের প্রেরণা জাগ্রত করেছেন, কিন্তু কোনো একটি করতে বাধ্য করেননি। তাই মানুষ সৎকর্মের জন্য পুরস্কার এবং অসৎকর্মের জন্য শাস্তির যোগ্য হয়। মানুষের অপরাধকর্মে লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মানুষ যদি কোনো অপরাধ না করত তাহলে তদস্থলে আল্লাহ এমন এক জাতি সৃষ্টি করতেন, যারা অপরাধ করত এবং তারা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতেন। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়ে আসছে। আদম আ:-এর পুত্র কাবিল কর্তৃক হাবিল হত্যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংঘটিত অপরাধ। অপরাধকর্মের মধ্যে রয়েছে কিছু ছোট আবার কিছু আছে বড়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক এবং জঘন্যতম অপরাধ হচ্ছে যিনা-ব্যভিচার, হত্যা, চুরি, ডাকাতি, মাদকাসক্তি, জুয়া, দুর্নীতি, প্রতারণা, কাউকে ঠকানো, জুলম করা, নির্যাতন করা, কাউকে ভয় দেখিয়ে বল প্রয়োগ করে কোনো কিছু আদায় করা ইত্যদি। নানা কারণে মানুষ এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পিতা-মাতা ও অভিভাবকের অবহেলা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক নৈতিক শিক্ষা না পাওয়া, অসৎ সঙ্গ, অর্থনৈতিক সমস্যা, অর্থের প্রাচুর্যতা, হতাশা, লোভ, ক্ষোভ, ক্ষমতার দাপট, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ক্ষমতাসীনদের সহায়তা, জবাবদিহিতা না থাকা ইত্যাদি কারণে মানুষ আস্তে আস্তে নানাবিধ অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। সমাজের কেউ এসব অপরাধে জড়িতদের ভালো চোখে দেখেন না। শান্তি, নিরাপত্তা, কলুষতামুক্ত সমাজ বিনির্মাণে অপরাধ দমনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এসব অপরাধ থেকে মুক্তি লাভের জন্য বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা আবশ্যক। (ক) ব্যক্তিগত সংশোধনের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় ভালো কাজের উপদেশ ও ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা। ব্যক্তির মন ও চরিত্র পরিশুদ্ধকরণে অভিভাবকদের বিশেষ নজর রাখা। (খ) শিক্ষামূলক শাস্তি প্রদান। সামাজিক অপরাধের শাস্তি হিসেবে জনসমক্ষে বিধি মোতাবেক নির্ধারিত শাস্তি কার্যকর করা। অপরাধী যে কেউ হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শুধু সমাজের নি¤œবৃত্তদের অপরাধের শাস্তির আওতায় আনলেই অপরাধ দমন হবে না। উচ্চশ্রেণীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যদি ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদও চুরি করত তাহলে আমি তার হাত কাটার নির্দেশ দিতাম।’ (গ) হদ্দ (শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি) কার্যকর করা। যেমনÑ মদপানের জন্য আশিটি বেত্রাঘাত করা। হত্যার শাস্তি কিসাস (হত্যার বদলে হত্যা), ক্ষতিপূরণ বা কাফফারা কার্যকর করা। ব্যভিচারের শাস্তি অবিবাহিতদের জন্য ১০০টি বেত্রাঘাত বা নির্বাসন এবং বিবাহিত হলে পাথর নিক্ষেপ করা। ধর্ষণের মিথ্যা দোষারোপকারীর শাস্তি ৮০টি বেত্রাঘাত করা। চুরির শাস্তি হাত কাটা। যদিও এসব শাস্তির পরিমাণ নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। (ঘ) তা’জির (এমন অপরাধ, যাতে শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি নেই) পর্যায়ের শাস্তি সুবিচারের সাথে করা। (ঙ) পারিবারিক শিক্ষা প্রদান করা। (চ) সংশয়মুক্ত ঈমান আনা ও তাতে দৃঢ় থাকা। (ছ) আল্লাহর আনুগত্য ও ভয়ের সাথে ইবাদত করা। এর মধ্যে নামাজ হচ্ছে বড় ইবাদত। এটি যাতীয় অপরাধ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখে। ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (আনকাবুত : ৪৫)। সিয়াম পালন করা। এর মাধ্যমে লোভ, যৌনস্পৃহা, অহমিকাবোধ দমন হয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ’ (বুখারি-মুসলিম)। জাকাত আদায় করো। মানব মনকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে এই জাকাত। ‘আপনি তাদের (ধনীদের) সম্পদের মধ্য থেকে জাকাত গ্রহণ করুন এবং তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করুন।’ (সূরা তাওবা : ১০৩)। হজ, যা পরবর্তী জীবনে সর্বপ্রকার পাপ ও অপরাধ থেকে মুক্ত থাকার জন্য ঢালের কাজ করে। রাসূল সা: বলেন, ‘যে হজ করল এবং কোনো ধরনের পাপে লিপ্ত হয়নি সে যেন পাপ থেকে এমনভাবে ফিরল যেন তার মা সদ্য জন্ম দিলো।’ (বুখারি-মুসলিম)। কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও অন্যান্য ইবাদত করা। (জ) ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। (ঝ) মানুষ যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, সর্বাবস্থায় নিজের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। (ঞ) তাওবা করা। মনে রাখতে হবে, অপরাধ প্রতিরোধে শাস্তিই একমাত্র হাতিয়ার নয়। এজন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধের কুপ্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement