১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল্লাহ তাওবা কবুলকারী

-

পৃথিবীর সর্বত্র শয়তানের জাল বিস্তৃৃত। তার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের নিমিত্তে মানুষের সামনে, পেছনে, ডানে ও বাঁয়ে ভালো ও বৈধতার মোড়কে অসংখ্য মায়াবী জাল সে পুঁতে রেখেছে। তাই যেকোনো মুমিন পুরুষ অথবা নারী সর্বপ্রকার সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও যেকোনো সময় শয়তানের জালে পা রাখা অসম্ভব কিছুই নয়। তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা অন্যান্য সৃষ্টির মতো যেহেতু মানুষকে তার কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ না করে তাকে দান করেছেন স্বাধীন বিবেক। তাই ভালো-মন্দ উভয় করার প্রবণতা তাদের রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানব আত্মার শপথ, আর সেই সত্তার শপথ, যিনি তাকে সুগঠিত করেছেন। অতঃপর তার মধ্যে অন্তর্গত করে দিয়েছেন সীমা লঙ্ঘনের (ফুজুরের) প্রবণতা আর সীমার অবস্থানের (তাকওয়ার) প্রবণতা। সফল হলো সে ব্যক্তি, যে তার তাকওয়ার প্রবণতাকে বিকশিত ও উন্নত করেছে। আর ধ্বংস হলো সে, যে তার তাকওয়ার প্রবণতাকে দাবিয়ে দিয়েছে।’(সূরা শামস : ৭-১০)। ভালো ও মন্দ উভয় প্রবণতাই মানুষের ভেতর অবস্থান করছে। একজন মুমিন-মুসলমান আমৃত্যু অবিরত তাকওয়াকেই বিকশিত করতে থাকবে। এর পরও যে মাঝে মধ্যে পা পিছলে যাবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ শয়তান তখন আরো ভালো করে তার পিছু নেয়, পদস্খলনও ঘটিয়ে দিতে পারে।
তাই বলে করুণার আধার মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ব্যক্তির ফিরে আসার সদর দরজা কি বন্ধ করে দিয়েছেন? কখনো নয়। বরং তিনি তাঁর করুণার সদর দরজা বান্দার জন্য সর্বদা খুলে রেখেছেন। ব্যর্থ মনোরথ বান্দাহ সারা পৃথিবীর কোথাও আশ্রয় না পেয়ে আবার যাতে তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টির সীমানায় চলে আসে, সেজন্য তিনি তাঁর দরবারের করুণার দরজাটি দিনে-রাতে খুলে রেখেছেন। ফিরে আসার এ যে কসরত, এর নাম তাওবা।
তাওবা শব্দের অর্থ অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জিত হওয়া, ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। পারিভাষিক অর্থে তাওবা মানেÑ ভুলপথে ধাবিত ব্যক্তির হঠাৎ সচকিত হয়ে সম্বিৎ ফিরে পাওয়া। অনুতপ্ত, অনুশোচনা ও নিজের কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না এ নিশ্চয়তা প্রদান করে অত্যন্ত খালেস দিলে আল্লাহর দিকে ফিরে আসাকে তাওবা বলা হয়। গুনাহ করার পর তাওবার অর্থ হচ্ছে এই যে, যে দাসটি তার প্রভুর নাফরমান ও অবাধ্য হয়ে প্রভুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সে এখন নিজের কার্যকলাপে অনুতপ্ত। সে প্রভুর আনুগত্য করার ও তাঁর হুকুম মেনে চলার জন্য ফিরে এসেছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার দিকে তাওবা করার মানে হচ্ছে, দাসের ওপর থেকে প্রভুর যে অনুগ্রহ দৃষ্টি সরে গিয়েছিল তা আবার নতুন করে তার প্রতি নিবদ্ধ হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তবে এ কথা জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তাওবা কবুল হওয়ার অধিকার একমাত্র তারাই লাভ করে, যারা অজ্ঞতার কারণে কোনো খারাপ কাজ করে বসে এবং তারপর অতিদ্রুত তাওবা করে। এ ধরনের লোকদের প্রতি আল্লাহ আবার তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ের খবর রাখেন, তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নিসা : ১৭)। মহান আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে বলেন : আমার এখানে ক্ষমার দরজা একমাত্র সেসব বান্দার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে, যারা ইচ্ছা করে নয়, বরং অজ্ঞতার কারণে ভুল করে বসে এবং চোখের ওপর থেকে অজ্ঞতার পর্দা সরে গেলে লজ্জিত হয়ে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এমন বান্দা তার ভুল বুঝতে পেরে যখনই প্রভু মহান রাব্বুল আলামিনের দিকে ফিরে আসবে তখনই নিজের জন্য তাঁর দরজা উন্মুক্ত দেখতে পাবে : ‘আমার এ দরবারে আশা ভঙ্গ হয় না কারো, শতবার ভেঙেছ তাওবা, তবু তুমি ফিরে এসো।’
আল্লাহর এক নাম আত তাওয়্যাব। অর্থাৎ তাওবা কবুলকারী। এটি আল্লাহ তায়ালার আশা ও উৎসাহ দানকারী গুণ। আল কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এ গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা এখনো বিদ্রোহ করে চলেছে অথবা যারা বারবার বিপথগামী হয়ে যায়, তারা যেন নিরাশ না হয়; বরং এ কথা ভেবে নিজেদের আচরণ পুনর্বিবেচনা করে যে, এখনো যদি তারা এ আচরণ থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করতে পারে। গুনাহ করার পর তাওবার অর্থ হচ্ছে, যে দাসটি তার প্রভুর নাফরমান ও অবাধ্য হয়ে প্রভুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সে এখন নিজের কার্যকলাপে অনুতপ্ত। সে প্রভুর আনুগত্য করার ও তাঁর হুকুম মেনে চলার জন্য ফিরে এসেছে। আর আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার দিকে তাওবা করার মানে হচ্ছে, দাসের ওপর থেকে প্রভুর যে অনুগ্রহ দৃষ্টি সরে গিয়েছিল তা আবার নতুন করে তার প্রতি নিবদ্ধ হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তবে এ কথা জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তাওবা কবুল হওয়ার অধিকার একমাত্র তারাই লাভ করে, যারা অজ্ঞতার কারণে কোনো খারাপ কাজ করে বসে এবং তারপর অতিদ্রুত তাওবা করে। এ ধরনের লোকদের প্রতি আল্লাহ আবার তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের খবর রাখেন, তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ। (সূরা নিসা : ১৭)। মহান আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে বলেন, আমার এখানে ক্ষমার দরজা একমাত্র সেসব বান্দার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে, যারা ইচ্ছা করে নয়, বরং অজ্ঞতার কারণে ভুল করে বসে এবং চোখের ওপর থেকে অজ্ঞতার পর্দা সরে গেলে লজ্জিত হয়ে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এমন বান্দা তার ভুল বুঝতে পেরে যখনই প্রভু মহান রাব্বুল আলামিনের দিকে ফিরে আসবে তখনই নিজের জন্য তাঁর দরজা উন্মুক্ত দেখতে পাবে : ‘আমার এ দরবারে আশা ভঙ্গ হয় না কারো, শতবার ভেঙেছ তাওবা, তবু তুমি ফিরে এসো।’
কিন্তু আমাদের দেশে তাওবার ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তা হলোÑ পাপকাজ হচ্ছে, একটু বয়স হলে বা হজ থেকে এসে তাওবা করে এ কাজ ছেড়ে দেবো অথবা একটু বয়স হলে কর্তব্যের কাজটি শুরু করব। জীবনের এ গ্যারান্টি কোথা থেকে যে এরা পায় তা আমার বুঝে আসে না। প্রকৃতপক্ষে বয়স হলেও ভালো কাজ করার সুযোগ আর এদের মিলে না। মূলত অপরাধ জানার সাথে সাথে তাওবা করতে হবে। বয়স হলে তাওবা করে খারাপ কাজ ছেড়ে দেবেন বা ভালো কাজ শুরু করবেন, এ ধরনের প্রভিশন ইসলামে নেই। তা ছাড়া ইতোমধ্যে যদি পরকালে চলে যাওয়ার সুযোগ মিলে, তবে তো নিজের পায়ে কুড়াল মারলেন। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আরো লক্ষ করা যায়, ব্যক্তির মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে অজু-গোসল দিয়ে একজন হুজুর এনে তাওবার ব্যবস্থা করা হয়। কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে এটিও ঠিক নয়।
যারা আল্লাহকে ভয় না করে সারা জীবন বেপরোয়াভাবে গুনাহ করতে থাকে, তারপর ঠিক যখন মৃত্যুর ফেরেশতা সামনে এসে দাঁড়ায় তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে, তাদের জন্য তাওবা নেই, তাদের গুনাহের কোনো ক্ষমা নেই। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার তাওবা কবুল করতে থাকেন যতক্ষণ মৃত্যুর আলামত দেখা না দেয়।’ কারণ যৌবন ও কৈশোরের মূল্যবান সময় বেহুদা সব কাজে ব্যয় করে এখন এ অসাড় ও মূল্যহীন জীবনটি আল্লাহর কী প্রয়োজনে আসবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মানুষটার জীবন-যৌবন ও ধনদৌলত দান করেছিলেন তাঁর রাস্তায় ব্যয় করার জন্য। কিন্তু সারা জীবন তার এ মূল্যবান জীবন ও ধনসম্পদ খরচ করে এসেছে আল্লাহর বিরুদ্ধ সব পথে। এখন সে এমন এক স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না। এখন আর তার প্রভাব-প্রতিপত্তি, জানমাল ও সন্তানসন্তুতি তাকে আর বাহাদুরির শক্তি জোগায় না। রঙিন দুনিয়ার শেষ প্রান্তে এসে যখন পরবর্তী জীবনের হাতছানি দেখছে, এখন তার সম্বিৎ ফিরে এসেছে আর তাই তাওবার হাত আল্লাহর দিকে প্রসারিত করেছে। এ অকর্মণ্য হাত আল্লাহর কোনো প্রয়াজন নেই। আল্লাহ এ হাত কবুল করবেন না। তাওবা সময় থাকতে করতে হবে। কাজটি খারাপ হচ্ছে, এ কথা জানার সাথে সাথে তাওবা করে তা থেকে স¤পূর্ণভাবে ফিরে আসতে হবে।
কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার আত্মীয়স্বজন কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করে থাকে। লাশ কবরে রাখার সময় নিম্নোক্ত দোয়াটিও পড়ে থাকেÑ ‘বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতে রাসূলিল্লাহ।’ অর্থাৎ আল্লাহর নামে রাসূল সা:-এর দলে রেখে গেলাম। প্রশ্ন জাগেÑ ব্যক্তি জীবিতাবস্থায় যদি রাসূল সা:-এর দলভুক্ত না হন, তাহলে মূল্যহীন গলিত পচা লাশটি রাসূল সা: তাঁর দলে নিয়ে কী করবেন? রাসূল সা: তো তাঁর দায়িত্বের বোঝা জীবিত লোকের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী আসবেন না। এ দায়িত্ব আমাদের জীবিতদেরই পালন করতে হবে। রাসূল সা:-এর রক্তমাখা ইসলামকে বাদ দিয়ে যারা নিজেদের শ্রম, মেধা ও অর্থ অন্য কোথাও খরচ করে, তারা মূলত ভুলপথে আছে। জেনে বুঝে এ পথে যারা চলতে থাকবে, আল্লাহ তাকে আমৃত্যু এ পথে চলার সুযোগ করে দেবেন। আবার মৃত্যুর পর রাসূল সা: মরা লাশ গ্রহণ করবেন বলে ধারণা করা একান্তই বোকামি। আত্মীয়স্বজন যারা কবরে লাশ রাখবেন, তাদেরকে এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের একটি মিথ্যা কথা এভাবে বলবেন না। এটি এক ধরনের প্রতারণার শামিল। সারা জীবন লোকটি রাসূলের দল করেনি, অথচ মৃত্যুর পর রাসূলের দলে রেখে আসবেন, আপনাদের এ কর্মটিও রাসূল পছন্দ করবেন না অবশ্যই। তাই সময় থাকতে সবাই সঠিক পথে ফিরে আসুন। তাওবা করুন। যে ক’টি বর্ষ জীবন থেকে ঝরে গেছে, তার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হোন। কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবনের সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক করে, তাতে চলার চেষ্টা করুন।
লেখক : সিনিয়র ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement