২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণ

-

(গত সংখ্যার পর)
ইসলামে কখনো জোর করে কাউকে মুসলমান বানানোর কোনো নজির নেই। মুসলমান যারা হয়েছেন তারা মুসলমানদের চরিত্র দেখে, মহানুভবতা দেখে মুসলমান হয়েছেন। ইয়াজিদের আমলে সিরিয়ার দামেস্কের বড় মসজিদটি (মুজামে ওমাবি) প্রথমে ছোট থাকলেও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেÑ এর কাছাকাছি একটি গির্জা ছিল। একপর্যায়ে মসজিদ সম্প্রসারিত হয়ে গির্জার কাছে চলে এলো। তখন মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের বলল, তোমরা গির্জাটা আমাদের দিয়ে দাও। কিন্তু খ্রিষ্টানরা সে প্রস্তাবে যখন রাজি হলো না তখন মুসলমানরা গির্জাটা দখল করে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলো। মসজিদ বড় হয়ে গেল। এরপর উমাইয়া যুগে ( ইয়াজিদের মৃত্যুর ২৫-৩০ বছর পরে) ৯৯ হিজরিতে উমর ইবনে আবদুল আযিজ খলিফা হয়ে জুলুম-অত্যাচার নির্মূল করলেন, তখন খ্রিষ্টানরা সাহস করে তার কাছে গিয়ে বললÑ ইয়া আমিরুল মুমেনিন; আমাদের গির্জাকে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দখল করা হয়েছে।
আমরিুল মুমেনিন বললেন, সে কি কথা! তোমাদের গির্জার কোনো দলিল আছে কি? তারা বলেন, হ্যাঁ, এই দেখুন। তিনি দামেস্কের গভর্নর ও প্রধান বিচারপতিকে তলব করে বললেন, দামেস্ক জামে মসজিদের ভেতর যে গির্জা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা ক্রয়ের দলিল বা খ্রিষ্টানরা গির্জা স্বেচ্ছায় দিয়েছেন, এমন কোনো দলিল থাকলে নিয়ে আসেন। কোনো দলিল নেই জানতে পেরে খলিফা বললেন, আগামী জুমার আগে মসজিদ ভেঙে গির্জা মুক্ত করে দেবেন। খলিফার কথা শুনে মুসলিমগণ পেরেশান হয়ে পড়লেন, এমন কি দামেস্কের গভর্নর ও প্রধান বিচারপতি খ্রিষ্টানদের কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন, হাতে-পায়ে ধরতে লাগলেন যে, গির্জাটি যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে দিয়ে দিন। খ্রিষ্টানরা ইনসাফ পেয়ে গেছে দেখে তারাও নরম হলো এবং লিখিতভাবে তারা গির্জাটি দিয়ে দিলো। জুমার আগেই খলিফা দায়িত্বশীলদের ডেকে জানতে চাইলেন মসজিদ ভাঙা হয়েছে কি না, তখন তারা জানালেন যে খ্রিষ্টানরা গির্জা বেচে দিয়েছে। তখন তিনি খ্রিষ্টানদের ডাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন গির্জা কি সত্যিই তোমরা বেচে দিয়েছ? তারা বললেন, হ্যাঁ। আমরা খুশি মনে বেচে দিয়েছি। তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে এখন নামাজ পড়া যাবে। তোমরা যেতে পারো। মুসলিমরা কখনোই, কখনোই, কখনোই ধর্মের জন্য জিহাদ করেনি। ধর্ম পালনের অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্য জিহাদ করেছে, আর কিছু না।
আরবের কাফেররা মনে করত। তাদের ধারণা আল্লাহর কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তার প্রিয় কারোর মাধ্যমে চাইতে হবেÑ সরাসরি চাইলে পাওয়া যাবে না। যেমন রাজা, বাদশাহ, ডিসি, এসপির কাছে যেতে হলে কারো মাধ্যমে যেতে হয়; তেমনি আল্লাহকে পেতে তাঁর কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তাঁর কোনো প্রিয় বান্দার মাধ্যমে যেতে হবে। তাহলেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। এভাবে ওলি, দরবেশ, পীর, নবী, রাসূলদের তারা মূর্তি বানিয়ে তাদের কাছেই তাদের প্রযোজনের কথা বলত, চাওয়ার কথা বলত। নবী-রাসূলদের সম্মান করতে হবে, কিন্তু চাওয়া-পাওয়া হবে সম্পূর্ণ আল্লাহর কাছে। আবু জেহেল বলল, বেটা বেয়াদব- লাত, মানাত, ইয়াগুস সব দেয় আর ওরা আল্লাহর ওলিদের সাথে বেয়াদবি করতে বলছে। এত্তেবায়ে রাসূল হচ্ছে শিরক থেকে বাঁচার পথ। আবু জেহেলের কথাগুলো কি বাংলাদেশে আছে? পাথরের ওপর একটা পিঁপড়া হাঁটলে যেমন বোঝা যায় না, শিরকও তেমনি সূক্ষ্মভাবে ঈমানের মধ্যে ঢুকে পড়ে অজান্তে। ভালো চিন্তাÑ আমি গুনাহগার আল্লাহ মনে হয় আমার ডাক শুনবে না, হুজুর ডাকলে হয়তো শুনবে। সমস্যাটা কোথায়Ñ আমাদের ধারণা পিএস ছাড়া মন্ত্রী, এমপির কাছে যেমন যাওয়া যায় না; আল্লাহর কাছেও তেমনি মাধ্যম ছাড়া যাওয়া যায় না। ডিসি, এসপি, মন্ত্রী আমাদের চেনেন না বলেই পিএস লাগে, পরিচিতি লোক লাগে; কিন্তু আল্লাহ তো সবাইকে জানেন বা চেনেন। অতএব আল্লাহর কাছে চাইতে হলে, যাইতে হলে মাধ্যম লাগে না। আমি যা করেছি আল্লাহ সব জানেন।
আমরা যদি মনে করি, আল্লাহ খুব বদরাগি ( নাউজুবিল্লাহ ) আমরা কোনো কর্মচারীর ওপর যদি রাগ করি আর সে কারণে শাস্তি দেয়, আর সে যদি আমার কোনো বন্ধুর কাছে ওই কথা বলে আমাকে ম্যানেজ করতে চায় তাহলে আমি কিন্তু ভয়ানক চটে যাই। ধরুন কোনো এমপি সাহেবের দয়ার শরীর। তিনি তার সিলপ্যাড ছেলেমেয়ে, বউ সবার কাছে দিয়ে রেখেছেÑ যে আসবে তাকে দেয়ার জন্য। আপনজন যা বলে তা শোনে, যাচাই না করে। কিন্তু অন্য একজন এমপি কড়া মানুষ তিনি এমনটি না করে সিলপ্যাড নিজের কাছেই রাখেন এবং জেনেশুনে বুঝেশুনে প্রত্যয়ন করেন। এ দু’জনের মধ্যে কে ভালো? যে কড়া সেই তো ভালো। তাহলে আল্লাহ কি না বুঝে, না শুনে, সুপারিশকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছাড় দেবেন? কখনই না। যে নবীকে আল্লাহ বেশি ভালোবাসেন, সেই নবী আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই মারা গেলে তার ছেলের সুপারিশে নিজের গায়ের জামা দিয়ে দিলেন, লাশের ওপর হাত বুলিয়ে দিলেন, জানাজা পড়ালেন; কিন্তু আল্লাহ বললেন, কোনো কিছুতে লাভ হবে নাÑ তার জন্য যদি ৭০ বারও দোয়া করা হয় তাকে মাপ করা হবে না। নবীজীর সাথে বেয়াদবি করেছে, অত্যাচার করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে তাদের ব্যাপারে নবী নিজে নাম ধরে দোয়া/বদদোয়া করলেনÑ আল্লাহ বললেন বিশ্ব পরিচালনার দায়িত্ব নবী তোমার নয়, আমার, আমি যাকে ইচ্ছে মাফ করব; যাকে ইচ্ছে শাস্তি দেবো।
নবী যাদের বদদোয়া করলেন, আল্লাহ তাদের ঈমান আনিয়ে দিলেন। এখন জরুরি কথা, কোর্টে উকিল লাগেÑ কেন জানেন? জজ জানেন না আসল ঘটনা কী, কিন্তু আল্লাহ তো সব জানেন, তাই তার কাছে যাওয়ার জন্য উকিল বা দালাল দরকার নেই। যদি ধরতে হয় তাহলে আল্লাহকে ধরুন। সবচেয়ে দয়ালু কে? আল্লাহ। আমরা তার কথা ভুলে যাই। উকিল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট, অন্য কারো প্রয়োজন নেই। আল্লাহ ছাড়া কাউকে উকিল ধরা যাবে না। আল্লাহই সবচেয়ে দয়ালু।
একাকী দোয়া করবেন, আল্লাহ কবুল করলেও কবুল করতে পারেন। তাই আমরা যেন আল্লাহর কাছে কাঁদিÑ তাহলে আমরা দুনিয়ায়ও পাবো আবার আল্লাহর ওলিও হয়ে যাবো। শিরকের ভেতরে পড়ে যাচ্ছি, গুনাহের ভেতর পড়ে যাচ্ছিÑ এর থেকে বাঁচার একটি উপায় আল্লাহর কাছে তাওবা করা, তার কাছে পানাহ চাওয়াÑ ইত্তেবায়ে রাসূলের পথে চলা। পীর, আলেম, বুজুর্গ, নেককারের কাছে যাবোÑ সোহবতে যাবো- বুঝ নেয়ার জন্য যাবো। মুরিদ না, আবদুল কাদের জিলানীও মুরিদ হননিÑ তিনি দাব্বাত নামে একজন বুজুর্গের সোহবতে গিয়েছিলেন। আমরা সোহবতে যাবো, জজবা নেব; কিন্তু ইবাদত হবে আল্লাহর জন্য। ইবাদত হবে আল্লাহর। আমি যদি নেককার মানুষকে আল্লাহর জায়গায় বসিয়ে দেই তাহলে কি ঠিক হবে? নিশ্চয়ই না। শিরক হবে।
ধরুন আমার দু’জন মুরিদ আছেÑ এর একজন মনে করেন তার ভালো-মন্দ যা হয় তা আমার দোয়ার কারণে হয়। আর একজন তার একিন হলো যা কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। এর অন্তর আল্লাহর কাছে ঘোরে। আগেরজনের অন্তর আমি-কেন্দ্রিক ঘোরে। এর মধ্যে আল্লাহর ওলি কে হবে? নিশ্চয়ই দ্বিতীয় জন। আগের জন আল্লাহর জায়গায় আমাকে বসিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ শিরক করেছে। পীর-মাশায়েখ, আলেম-উলামা আমাদেরকে নবীর তরিকায় আল্লাহর পথে চলতে শেখাবেন। নবীর তরিকায় আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। ইউনুস আ: মাছের পেটে পড়ে কার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। শিরক কিভাবে ঈমানের মধ্যে ঢুকে পড়েÑ একটা উদাহরণ : হুনায়নের যুদ্ধে (মক্কা বিজয়ের পরে যুদ্ধটা হয়) সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ১২ হাজার। মক্কা থেকে তায়েফে যাচ্ছেন, পথে দেখলেন সুতা বাঁধার গাছÑ কাফেররা এই গাছে মনের মাকসুদ পূরণের জন্য সুতা বেঁধে দিত। একজন সাহাবি বললেনÑ ইয়া রাসূলুল্লাহ, কাফেরদের তো একটা গাছ আছে আমাদেরও একটা গাছ ঠিক করে দেন, যে গাছে সুতা বেঁধে আল্লাহর বরকত পাবো। নবী সা: কষ্ট পেয়ে বলছেন, সুবহান আল্লাহ। এটা তো শিরক, বনি ইসরাঈল যেমন শিরক করেছিল, এ তো সে রকমই। মায়ের কাছে আদর পেতে, মায়া পেতে কোনো মিডিয়া লাগে না। তেমনি আল্লাহর রহমত পেতেও কোনো মাধ্যম লাগে না। নবী যা করেছেন আমরা তা করব। যা নিষেধ করেছেন তা করব না। বাঁচার উপায় সুন্নতের মধ্যে থাকা। জীবন তো একটাইÑ আপনি মাত্র দুই লাখ টাকা আছে তা নিশ্চয়ই কম লাভ হলেও নির্ভরযোগ্য জায়গায় রাখছেন। যে যেখানে যাই যাক আমি অন্তত রাসূলের সুন্নতের বাইরে যাবো নাÑ ঈমান যেন মারিং না হয়ে যায়। রাসূল সা: এবং সাহাবিরা যেভাবে চলেছেন, সেভাবে আমরা যদি চলতে পারি তাহলে অবশ্যই কামিয়াব হব। (সমাপ্ত)
অনুলিখন : হেলাল বিশ্বাস


আরো সংবাদ



premium cement