২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আদর্শ যুবক মুহাম্মদ সা:

-


মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি যেমন ছিলেন ইনসানে কামেল তথা পরিপূর্ণ মানুষ, তেমনই ছিলেন একজন পরিপূর্ণ আদর্শ যুবক। পৃথিবীতে যত ভালো গুণ আছে, এর সব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল একজন মুহাম্মদ সা:-এর মধ্যে। এককথায় তিনি ছিলেন সর্বগুণের আধার। ফরাসি লেখক আলফ্রেড তাঁর তুর্কির ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, ‘দার্শনিক, বক্তা, ধর্ম-প্রচারক, যোদ্ধা, আইন-রচয়িতা, ধর্মমতের ও প্রতিমাবিহীন ধর্ম-পদ্ধতির সংস্থাপক মুহাম্মদ সা:-কে মানুষের মহত্বের যতগুলো মাপকাঠি আছে তা দিয়ে মাপলে, কোনো লোক তাঁর চেয়ে মহৎ হতে পারবে না।’
মহামানব মুহাম্মদ সা: আরবের এক সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারে পিতৃহীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। এক জনৈকা দরিদ্র্য ও সুশীলা ধাত্রীর দুধ খেয়ে গ্রামের সুস্থ ও অকৃত্রিম পরিবেশে লালিত পালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন। তিনি বিশেষ ব্যবস্থাধীনে মরুভূমিতে ছোটাছুটি করতে করতে জীবনের কর্মক্ষেত্রে কঠিন বিপদ-মুসিবত ও দুঃখ-কষ্টের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ছাগল ভেড়া চরিয়ে এক বিশ্বজোড়া জাতির নেতৃত্ব দেয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শৈশবের সময় কাটানোর আগেই এই ব্যতিক্রমী শিশু মায়ের স্নেহময় ছায়া থেকেও বঞ্চিত হন। দাদার ব্যক্তিত্ব বাবা-মার এই শূন্যতা খানিকটা পূরণ করতে পারলেও কিছুদিন যেতেই সে আশ্রয়ও তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশেষে চাচা হন অভিভাবক। এ যেন কোনো পার্থিব আশ্রয়ের মুখাপেক্ষী না হয়ে একমাত্র আসল মনিবের আশ্রয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি।
যে বয়সে ছেলেরা সাধারণত বিপথগামী হয়ে থাকে, ঠিক সে বয়সেই তিনি গরিব ও নিপীড়িত মানুষদের সহায়তা এবং অত্যাচারীদের জুলুম উচ্ছেদের লক্ষ্যে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটা সংস্কারকামী সংগঠন গড়ে তুলেন। নবুয়ত লাভের পর রাসূল সা: ওই সংগঠনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন, ‘ওই অঙ্গীকারের পরিবর্তে কেউ যদি আমাকে লাল রঙের উটও দিত, তবু আমি তা থেকে ফিরে আসতাম না। আজো কেউ যদি আমাকে তেমন কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে ডাকে, তবে আমি সে জন্য প্রস্তুত।’
তিনি এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথানত করেননি। তাঁর শুরুই বলে দিয়েছে শেষটা কেমন হবে। যে সমাজে দেবমূর্তির সামনে সিজদা করা ধর্মীয় প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এই পবিত্র স্বভাব ও চিন্তাশীল তরুণ কোনোরূপ মুশরিকসুলভ ধ্যান-ধারণাও পোষণ করেননি। এমনকি একবার তাঁকে দেবমূর্তির সামনে বলি দেয়া জন্তুর রান্না করা গোশত খেতে দেয়া হলে তিনি তা খেতে অস্বীকার করেন। তিনি জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করার সময় মক্কার উঠতি যৌবনা সুন্দরী মেয়েদের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে চল্লিশোর্র্ধ্ব বয়সের মহিলা হজরত খাদিজা রা:-কে বিয়ে করেন। খাদিজা রা: ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন সতী-সাধ্বী ও সচ্চরিত্র মহিলা। বিয়ের জন্য এমন পাত্রী নির্বাচন তাঁর মানসিকতা ও স্বভাব চরিত্রের গভীরতাকেই ফুটিয়ে তোলে।
কোনো ব্যক্তির চরিত্র ও মানসিকতাকে তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সহচরদের দেখে যাচাই করা যায়। হজরত আবু বকর রা:-এর সাথেই ছিল তাঁর সবচেয়ে গভীর বন্ধুত্ব ও অকৃত্রিম সম্পর্ক। একে তো সমবয়সী, তদুপরি সমমনা। তাঁর অপর এক বন্ধু ছিল হজরত খাদিজার চাচাতো ভাই হাকিম বিন হিজাম। তিনি হারাম শরিফের একজন খাদেম ছিলেন। দিমাদ বিন সালাবা আযদি নামক একজন চিকিৎসকও ছিল তার অন্যতম বন্ধু। যুবক মুহাম্মদ সা:-এর বন্ধুমহলে একজনও নীচ, হীন, জুলুমবাজ ও পাপাচারী লোক দেখা যায় না।
তিনি যখন অর্থোপার্জনে পদার্পণ করলেন, তখন ব্যবসার মতো পবিত্র ও সম্মানজনক পেশা বেছে নিলেন। দেশের বড় বড় পুঁজিপতি এই যুবককে তাদের পুঁজিগ্রহণ ও ব্যবসা করার জন্য মনোনীত করে। এ যুবকের মধ্যে এমন গুণ নিশ্চয়ই ছিল যে জন্য তারা তাঁকে মনোনীত করেছিল। হজরত খাদিজা এবং আরো কয়েক ব্যক্তি একে একে তাঁর অনুপম সততার বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং তারা সবাই তাঁকে একবাক্যে ‘তাজের আমিন’ বা ‘সৎ ব্যবসায়ী’ উপাধিতে ভূষিত করে। আবদুল্লাহ বিন আবিল হামসার সাক্ষ্য আজো সংরক্ষিত রয়েছে। নবুয়তের আগে একবার এই তরুণ সৎ ব্যবসায়ীর সাথে তার কথা হয় যে, আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি আসছি। কিন্তু পরে সে ভুলে যায়। তিন দিন পর ঘটনাক্রমে আবদুল্লাহ সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পান, ওই সৎ ব্যবসায়ী নিজ প্রতিশ্রুতির শেকলে আবদ্ধ হয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। হজরত মুহাম্মদ সা: আবদুল্লাহকে শুধু বললেন, ‘তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ। আমি তিন দিন ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি’ (আবু দাউদ)।
কাবা শরিফ সংস্কারের সময় হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এটা এতদূর গড়ায় যে, তলোয়ার পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ে এবং সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কিন্তু এই গোলযোগ মিটমাট করার সুযোগটা যুবক মুহাম্মদই সা: লাভ করেন। চরম উত্তেজনার মধ্যে শান্তির পতাকাবাহী এই বিচারক একটা চাদর বিছিয়ে দেন এবং নিজ হাতে চাদরের উপর রেখে দেন হাজারে আসওয়াদ। এরপর তিনি কুরাইশ গোত্রের সব শাখার প্রতিনিধিদের চাদরের চারপাশে ধরে হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে নিয়ে যেতে আহ্বান জানান। পাথর যথাস্থানে উপনীত হলে যুবক মুহাম্মদ সা: পাথরটা তুলে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। এরপর গোলযোগ থেমে গেল এবং সবার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
যুবক মুহাম্মদ সা: সাংসারিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যখন কিছু সময় অবসর পেতেন, তখনো তিনি আমোদ-ফুর্তি ও বিনোদনে কাটাতেন না। যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করে, আড্ডা দিয়ে কিংবা অলসভাবে ঘুমিয়ে কাটাতেন না। বরং সব হই হাঙ্গামা থেকে দূরে সরে এবং সব কর্মব্যস্ততা পরিহার করে নিজের নির্মল ও নিষ্কলুষ সহজাত চেতনা ও বিবেকের নির্দেশক্রমে হেরাগুহার নিভৃত প্রকোষ্ঠে গিয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতেন। বিশ্বজগতের প্রচ্ছন্ন মহাসত্যকে হৃদয়ঙ্গম করা ও মানব জীবনের অদৃশ্য রহস্যগুলো জানার জন্য আপন সত্তায় ও বিশ্ব প্রকৃতির অতলান্তে চিন্তা গবেষণা চালাতেন। তিনি ভাবতেন, কিভাবে নিজ দেশবাসী ও গোটা মানবজাতিকে নৈতিক হীনতা ও নীচতা থেকে টেনে তুলে আদর্শবান করা যায়।
দৈনন্দিন জীবনের এ জাতীয় ঘটনাবলি নিয়ে ভবিষ্যতের বিশ্বনবীর কুরাইশদের চোখের সামনেই পবিত্র সময় কাটতে থাকে। খোদ কুরাইশরাই তাঁকে সাদেক (সত্যবাদী), আল-আমিন (বিশ্বাসী), তাজেরে আমিন (সৎ ব্যবসায়ী), আমানতদার, জ্ঞানী-গুণী ও মহৎ চরিত্রধারী মানুষ বলে বারবার স্বীকার করেছে। তাঁর শত্রুরা কঠিনতম দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের মধ্যেও তাঁর মনীষা ও নৈতিকতার শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দিয়েছে। জর্জ বার্নার্ড শ লিখেছেন, ‘যদি সমগ্র বিশ্বের ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদসম্পন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে কোনো নায়কের শাসনাধীনে আনীত হতো, তাহলে একমাত্র মুহাম্মদই সা: সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতা হিসেবে তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।’ সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালা তো পবিত্র কুরআনে তাঁর সম্পর্কে বলেছেনই, ‘নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সা:-এর মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ তাহলে রাসূল মুহাম্মদ সা: ছাড়া আর কোথায় আমরা জীবন পরিচালনার আদর্শ খুঁজব, মহৎ হওয়ার অনুপ্রেরণা খুঁজব?
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল