২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা:

-

হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আগমনপূর্ব যুগটি ছিল দলাদলি, হানাহানি ও রক্তারক্তির যুগ। মানুষে মানুষে ছিল রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও আভিজাত্যের দুর্লঙ্ঘনীয় প্রাচীর। সমাজ ছিল তখন পশুত্ব ও পৌত্তলিকতার নিকষকালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত। মানুষ ছিল তখন শান্তিহারা, অধিকারহারা, নির্মমভাবে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত।
নারী জাতির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। এক কথায় তৎকালীন মানবসমাজে মুক্তি, শান্তি ও প্রগতির আশা হয়ে উঠেছিল সুদূরপরাহত। মানবেতিহাসের এই ঘোর দুর্দিনেই বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মানবতার মুক্তির সনদ নিয়ে সুন্দর এই বসুন্ধরায় আগমন করেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি।’ মূলত তাঁর আগমনই ছিল মানবকুলের জন্য অপূর্ব নিয়ামত, রহমত ও চিরন্তন শান্তির মহান সওগাত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরম বন্ধুরূপে অন্যায় ও অসাম্যকে তিরোহিত করে সাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর মহান ব্রত।
ধর্মীয় মুক্তি : আল কুরআনের বাণী, ‘ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম।’ অন্য সব ধর্মমতকে বাতিল ঘোষণা দিয়ে ইহকালের পাথেয় ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র সনদরূপে মহানবী সা: ইসলামকে সর্বকালীন ও বিশ্বজনীন পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম।’
অর্থনৈতিক মুক্তি : দারিদ্র্য নিরসনে মহান আল্লাহর বাণী, ‘যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই ঐশ্বর্য আবর্তন না করে।’ এই বাণীর প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে মহানবী সা: মানব জীবনের অন্যান্য দিকের মতো অর্থনৈতিক দিকেরও বাস্তব সমাধান দিয়ে গেছেন। সুদভিত্তিক ঋণ, জুয়া, লটারি ইত্যাদি শোষণমূলকব্যবস্থা চিরতরে নিষিদ্ধ করে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রবর্তিত অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুসরণে আজো মানবজাতিকে রাষ্ট্রের দাসত্ব ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে প্রকৃত আজাদ ও সুখী করা সম্ভব।
রাজনৈতিক মুক্তি : একনায়কত্ব ও রাজতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে মহানবী সা: অন্ধকার যুগে মদিনায় এক নজিরবিহীন সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রণয়ন করেছিলেন মদিনার ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানÑ এই ত্রিজাতির মধ্যে সামাজিক শানি ও অগ্রগতির নিশ্চয়তা, ধর্মীয় সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িকতার উৎখাত, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনার্থে ৪৭টি শর্তসংবলিত যুগান্তকারী এক সনদ।
সামাজিক মুক্তি : ষষ্ঠ শতকের আরব ছিল পাপের কলুষ কালিমায় আচ্ছন্ন। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ ছিল তখনকার প্রচলিত নীতি। এক কথায় নির্যাতিত মানবতা অমানুষিক পশুশক্তির শিকারে পরিণত হয়েছিল। এরূপ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য গুমরে মরছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত অসহায় মানুষের আত্মা। এমতাবস্থায় মহানবী সা: ঘোর অজ্ঞানতার কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বসমাজে ইসলামের সুবিশাল জ্যোতি বিকিরণ করেন। নিঃস্ব ও অসহায়দের সেবা, অত্যাচারীদের বাধা দেয়া, বঞ্চিতদের আশ্রয় এবং বিভিন্ন গোত্রের মাঝে পারস্পরিক শান্তিশৃঙ্খলা ও সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা প্রভৃতি কর্মসূচি সামনে রেখে যৌবনকালে তিনি তরুণদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে কল্যাণধর্মী একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করে গেছেন সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায়।
নারীমুক্তি : ইসলাম আগমনের আগে দুনিয়া নারীকে অকেজো ও অকল্যাণকর, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিপন্থী বা তার প্রতিবন্ধক মনে করে জীবনের কর্মক্ষেত্র থেকে একেবারে বাইরে ফেলে দিয়েছিল। তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, নিষ্ক্রিয়তার এমন এক গহ্বরে যেখান থেকে উঠে আসা ও উত্থান-অগ্রগতি লাভ করা কোনোক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। মানবতার পরম বন্ধু মহানবী সা: তাদেরকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। নারীসমাজকে হীনতার নিম্নতম পঙ্ক থেকে তুলেছেন অনেক ঊর্ধ্বে। দিয়েছেন তাদের তুলনাহীন মর্যাদা, ন্যায্য অধিকার। দিয়েছেন সামাজিক-আর্থিক নিরাপত্তার পূর্ণ নিশ্চয়তা। সম্পদে নারীর অধিকার করেছেন প্রতিষ্ঠা। ঘোষণা দিয়েছেন, নারী-পুরুষ উভয়ে উভয়ের জন্য ভূষণস্বরূপ। মেয়েদের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী সা: বলেন, ‘নিশ্চয় সন্তানের বেহেশত মায়ের পদতলে’। সম্মান, সেবা ও সাহায্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে মায়ের কথা তিনি তিনবার উল্লেখ করেছেন এবং একবার উল্লেখ করেছেন বাবার কথা।
শিক্ষার মুক্ত পরিবেশ : মহানবী সা: বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! যে জ্ঞান উপকারে আসে না আপনার কাছে তা থেকে পানাহ চাই।’ মানুষ কেবল অন্যান্য জীবের মতো নয়, বরং আধ্যাত্মিক তথা আদর্শিক জীবও বটে। যৌক্তিকতার মানদণ্ডে উন্নত মানুষই প্রকৃত মনুষ্যত্বের মানদণ্ড। মহানবী সা: বলেছেন, ‘বাবা-মা তাদের সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম আর কিছুই দিতে পারে না।’
ঝঃধহবষু ঐধষষ যথার্থই বলেছেন, ওভ ুড়ঁ ঃবধপয ুড়ঁৎ পযরষফ ঃযব ঃযৎবব 'জ' জবধফরহম, ডৎরঃরহম ধহফ অৎরঃযসবঃরপ ধহফ ষবধাব ঃযব ৪ঃয 'জ' জবষরমরড়হ ুড়ঁ রিষষ ংবঃ ধ ৫ঃয 'জ' জধংপধষরঃু.
তাই মহানবী সা: প্রত্যেক নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জনকে বাধ্যতামূলক (ফরজ) করে দিয়েছেন।
পরকালীন মুক্তি : মহান আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা তো অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’ মহান আল্লাহ এই রক্ষা করেছিলেন মহানবী সা:-এর মাধ্যমে। তাই মানবতার বন্ধু হিসেবে মহানবী সা: জাহান্নাম থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য অবিরাম চেষ্টা করে গেছেন। পার্থিব জীবনকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সুন্দর সুশৃঙ্খল এবং শান্তিময় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দিনভর তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন, আর পরকালীন জীবনের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তির জন্য প্রায় রাতে আরামের ঘুম হারাম করে মহান আল্লাহর দরবারে কাঁদতেন আর প্রার্থনা করে বলতেন, ‘হে অল্লাহ! তোমার এই বান্দাদের দোষ-ত্রুটি ধরে যদি তুমি এদেরকে শাস্তি দাও দিতেও পার। যেহেতু তারা তোমার বান্দা! কিন্তু তুমি দয়া করে তাদেরকে সৃষ্টি করেছিলে, তাদেরকে যদি মাফ করে দাও তাও তুমি পারো, তোমার সব ক্ষমতা আছে। তুমি তাদের মাফ করে দাও।’
শেষ কথা : মুহাম্মদ সা: আল্লাহর রাসূল। সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতি আল্লাহর দয়ার বাস্তব নিদর্শন তিনি। প্রেম এবং করুণার সম্মিলন তাঁর চরিত্রে অপূর্বভাবে বিমূর্ত হয়েছে। তাঁর প্রচারিত নীতি এবং আদর্শ কালো-সাদা, আরব-অনারব, ধনী-গরিব, উচ্চ-নীচ সবাইকে এককাতারে শামিল করেছে। কালোত্তীর্ণ এ মহামানুষ এ নশ্বর ধরাধামে মহান আল্লাহর গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ করে গেছেন। জগতের সব জড়চিন্তা, ভুয়া মতবাদ এবং মানবতাবৈরী সব শক্তিকে পর্যুদস্ত করে মানবতার এই মহান বন্ধু চির অমর হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। তিনিই আমাদের একমাত্র আদর্শ। তাঁর চেয়ে বড় বন্ধু আর কোনো দিন কেউ হতে পারবে না।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement