১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অধীনস্থদের সম্পর্কে প্রিয়নবী সা:

-

আল্লাহ তায়ালা সব মানুষকে সমান আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে সৃষ্টি করেননি। এ জন্যই তো চাকর-চাকরানী সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারে কাজ করতে আসে। কিন্তু ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নিয়োগকারীর ওপর তাদের অধিকারও শরিয়ত নির্ধারিত করেছে। তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, পৃথিবীতে কোনো মানুষ তার সব কাজ একা আঞ্জাম দিতে পারে না, বিশেষত্ব এই জটিল শিল্পায়নের যুগে জীবন ধারণের জন্য প্রত্যেক মানুষকেই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। বিভিন্ন স্তরে এক ব্যক্তির অধীনে একাধিক ব্যক্তিবর্গ কাজকর্ম আঞ্জাম দিয়ে থাকে। ইসলামী সমাজ ‘ব্যবস্থায় সকল দায়িত্বশীল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ রয়েছে যেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধীনস্থদের সাথে সদ্ব্যবহার করে এবং তাদের ওপর কোনো প্রকার জুলুম-অত্যাচার না করে।’ আজকের সমাজে ক্রীতদাস প্রথা নেই সত্য তবে অধীনস্থদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার অহরহ চালু আছে। ইসলাম চাকর-চাকরানীদের প্রতি সুন্দর ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে ওদের মর্যাদা দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেন ‘তোমাদের চাকর, নকর বা দাস-দাসী প্রকৃত পক্ষে তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহ যার ভাইকে অধীনস্থ করে দিয়েছেন তার উচিত তাকে তাই খাওয়ানো যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরানো যা সে নিজে পরে থাকে। তাকে এমন কর্মভার দিবে না, যা তার সাধ্যাতীত। যদি কখনো তার ওপর অধিক কর্মভার চাপানো হয় তবে যেন তার ওপর সাহায্যের হাত প্রসারিত করা হয়’ (বুখারি, মুসলিম)।
দুঃখের সাথে বলতে হয় আমাদের সমাজে অনেক লোককেই দেখা যায় তারা তাদের চাকর-চাকরানীর সাথে অশ্লীল কথা বলে, অথচ সদ্ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রতিটি মানুষকে জীবনের সাফল্য অর্জন করতে হয়। তাই কোনো অবস্থাতেই চাকর-চাকরানীর সাথে অশ্লীল কথা বলা উচিত না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেনÑ ‘যাদের জীবন-সাধনা সার্থক, সুন্দর, তাদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে’ (সূরায়ে মুমিনুন)।
তাই প্রকৃত মুসলিম কখনোই জীবনের মূল্যবান সময় অশ্লীল কথা ও বেহুদা কর্মে নষ্ট করে না। প্রিয়নবী সা: তার অধীনস্থদের সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করতেন। এ প্রসঙ্গে প্রিয়নবী সা:-এর খাদেম হজরত আনাস রা:-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, আমি দীর্ঘ দশ বছর প্রিয়নবী সা:-এর খেদমত করেছি। তিনি আমার সম্পর্কে কখনো ‘উহ’ শব্দটি বলেননি এবং কোনো দিন বলেননি এটা করোনি কেন? ওটা করোনি কেন? আমার অনেক কাজ তিনি নিজে করে দিতেন’ (মিশকাত)।
প্রিয় নবী সা:-এর অন্য এক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হজরত জায়েদ রা: সারা জীবন প্রিয়নবীর কাছে ছিলেন মনে হতো যেন সে প্রিয় নবীর পুত্র। জায়েদ প্রিয় নবীর পুত্রের মতো আদর যতেœ বড় হয়েছেন। প্রাণঢালা স্নেহ পেয়েছেন প্রিয় নবীর। বড় হলে প্রিয় নবী সা: আপন চাচাতো বোন জয়নবের সাথে বিয়ে দিলেন জায়েদের। পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় করে নিলেন জায়েদকে। জায়েদ ক্রীতদাস হিসেবে এসেছিলেন প্রিয় নবী সা:-এর সংসারে। কিন্তু একবারও মনে করলেন না সে কথা। প্রিয় নবী সা: জায়েদের ছেলে উসামাকে খুব আদর করতেন। মনে হতো নাতি ইমাম হাসান ও হোসাইনের মতোই আপন। আমাদের সমাজের অনেক মালিকদের দেখা যায় তারা তাদের অধীনস্থ চাকর-চাকরানীদের সাথে খারাপ ব্যবহার তো করেই সাথে সাথে তাদের বিভিন্নভাবে প্রহার করে, যা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়ে দেয়। অথচ হাদিসে এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। চাকর-চাকরানীর প্রতি জুলুমকারীকে কিয়ামতের দিন তার পরিণাম দেয়া হবে। হজরত আবু হোরায়রা রা: বলেন, প্রিয়নবী সা: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে স্বীয় চাকর-চাকরানীকে প্রহার করবে, কিয়ামতের দিন তাকে তার পরিণাম দেয়া হবে’ (বায়হাকি, শোয়াবুল ঈমান)। হজরত কাব ইবনে উজরা রা: বলেন, প্রিয়নবী সা: ইরশাদ করেন ‘তোমাদের থালা-বাটি তোমাদের চাকর-চাকরানীর হাতে ভেঙে গেলে তাদের মারধর করবে না। কেননা তোমাদের আয়ুষ্কাল যেমন নির্ধারিত থালা-বাটিরও তদ্রƒপ’ (দায়লামি)।
প্রিয় নবী সা:-এর হাদিস থেকে একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মানুষের আয়ুষ্কাল শেষ হলে যেমন সে মরে যাবে, তদ্রƒপ থালা-বাটিও ভেঙে যায়। এ জন্য চাকর-চাকরানীদের মারধর করা ঠিক হবে না। হ্যাঁ, তবে আদব শিক্ষার্থে মারধর করাতে দোষণীয় বলতে কিছু নেই। চাকর-চাকরানী সম্পর্কে প্রিয় নবী সা:-এর শেষ ওসিয়ত ছিল তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে। হজরত জাবের রা: বর্ণনা করেন যে, প্রিয় নবী সা: বলেছেন, যার মাধ্যে তিনটি গুণের সমাবেশ হবে, আল্লাহ তার মৃত্যু সহজ করে দেবেন এবং তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। গুণ তিনটি হচ্ছেÑ ১.দুর্বলের সাথে বিনয় ব্যবহার, ২.মা-বাবার সাথে ভালোবাসা, ৩.স্বীয় চাকর-চাকরানীর সাথে সদাচরণ।
উপরে বর্ণিত আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে প্রত্যেক মানুষেরই উচিত ইসলামী আদর্শে চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা। আর প্রত্যেক মনিবেরই মনে করা উচিত চাকর-চাকরানীও সব মানুষের মতোই একজন মানুষ। পরিশেষে, এ কথা বলা যেতে পারে যে আমাদের সমাজ থেকে যদি চাকর-চাকরানীর ভেদরেখা মুছে যেত তাহলে প্রতিটি পরিবারই প্রিয় নবী সা:-এর পরিবারের মতো সুন্দর, সুখী ও আদর্শ পরিবার হিসেবে গড়ে উঠতো। আর দেশের ও সমাজের অনেক অমঙ্গলই কেটে যেয়ে প্রতিটি পরিবারে শান্তি নেমে আসত।
লেখক : মুদাররিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ


আরো সংবাদ



premium cement