১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মহানবী সা:-এর চারিত্রিক সৌন্দর্য

-

বারা ইবনে আযিব রা: বলেন, ‘উত্তম দামি পোশাক পরিহিত অনেক শৌখিন লোক আমি দেখেছি, কিন্তু নবী করিম সা:-এর চেয়ে আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারার কোনো লোক আমি দেখিনি’ (সহিহ মুসলিম)। কিশোর বয়স থেকেই মহানবী সা:- এর মধ্যে মহাপুরুষোচিত ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠতে থাকে। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি কুরাইশ নেতা দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে দুই বছর লালিত পালিত হন। দাদার পর চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে তিনি লালিত পালিত হন। আবু তালিব কিশোর মুহাম্মদের প্রতি ইঙ্গিত করে তার সন্তানদের বলতেন, আমার এ বাছাধনের ব্যক্তিত্বে সর্দারির শোভা দেদীপ্যমান। বিরাট মহাপুরুষোচিত ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি মহানবী সা:-এর হৃদয়-মন ছিল অত্যন্ত কোমল। প্রথমবার কেউ তাঁকে দেখলে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে যেত। কোনো ব্যক্তি কথাবার্তা, ওঠাবসা ও চলাফেরার মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হলে সে তাঁর প্রতি চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হয়ে পড়ত এবং হৃদয় উজাড় করে তাঁকে ভালোবাসত। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে শত্রুতা পোষণ করত সে ব্যক্তির কাছে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল আতঙ্ক ও ভীতি সঞ্চারকারী। তাঁর মধ্যে ছিল বিশ^নেতা হওয়ার মতো অনবদ্য ব্যক্তিত্ব আর তাঁর হৃদয়-মন ছিল মানবতার প্রতি করুণাসিক্ত।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে একজন রাসূল এসেছে, তোমাদের ক্ষতি ও দুঃখ তার মনকে ব্যথিত করে তোলে। সে তোমাদের পরম কল্যাণকাক্সক্ষী। সে মুমিনদের প্রতি রাউফুর রাহিমÑ অতি ¯েœহশীল ও পরম করুণাসিক্ত’ (সূরা আত তাওবা : ১২৮)। বিশ^নেতা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: কেবল কোমল হৃদয়ের অধিকারীই ছিলেন না, সেই সাথে তিনি ছিলেন বীর বাহাদুর, বীর বিক্রম, দুরন্ত সাহসী, বীরশ্রেষ্ঠ বীর, বীরত্বের প্রতীক। তাঁর একান্ত সাথী ও খাদিম আনাস রা: বলেন, ‘রাসূল সা: ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহসী বীর বাহাদুর’ (সহিহ বুখারি)।
একবার এক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় পথিমধ্যে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায় এক শত্রু এসে তাঁর গর্দানের ওপর কোষমুক্ত তরবারি উদ্যত করে বলল, মুহাম্মদ! এবার আমার হাত থেকে তোমায় কে রক্ষা করবে? সজাগ হয়েই তিনি উদ্যত তলোয়ারের দিকে তাকালেন। তারপর শত্রুকে লক্ষ্য করে বীরশ্রেষ্ঠ বীর নির্ভীকচিত্তে বলে উঠলেন : আল্লাহই আমাকে রক্ষা করবেন। বিশ^নবী সা: ছিলেন ধৈর্যের পাহাড়। আর ধৈর্যেরই অপর নাম দৃঢ়তা। তাঁর চরিত্রের এক সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য ছিল এই ধৈর্য ও দৃঢ়তা। ছেলেবেলা থেকেই রাসূল সা:-এর মধ্যে ধৈর্য গুণের বিকাশ ঘটতে থাকে। এতিম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই মাকে হারান, দাদাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই কঠিন পরিশ্রম করে উপার্জন করতে শেখেন। তাঁর জীবনের সূচনাই হয় ধৈর্য অবলম্বন দিয়ে। বিশ^নবী সা: বিপদ মুসিবত এবং বাধা বিরোধিতায় যেমন দৃঢ়তার সাথে ধৈর্যধারণ করতেন, ঠিক তেমনি বিজয়ের সময় ধৈর্যধারণ করতেন। মদিনার জীবনে বহুবার তিনি শত্রুদের ওপর বিজয় অর্জন করেছেন। কিন্তু বিজয়ে আত্মহারা হয়ে তিনি কখনো কোনো অসংলগ্ন ও সীমালঙ্ঘনের কাজ করেননি। যখনই কোনো বিজয় তাঁর পদচুম্বন করেছে, তিনি আত্মসংবরণ করেছেন। আল্লাহর শোকর আদায় করেছেন। দুনিয়াদার বড় বড় নেতার অবস্থা আমাদের সবারই জানা। তাদের পাবলিক লাইফ হয়ে থাকে এক রকম আর প্রাইভেট লাইফ হয়ে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। পাবলিক লাইফে তারা নীতিবান, চরিত্রবান, সদাচারী, মানবদরদি ও স্বচ্ছ হওয়ার ভান করেন। পক্ষান্তরে প্রাইভেট লাইফে তারা হয়ে থাকেন নীতিবিবর্জিত, অনাচারী, নিষ্ঠুর, বদমেজাজি এবং নোংরা ও অস্বচ্ছ। কিন্তু বিশ^নবী সা:-এর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তাঁর সামাজিক জীবন ছিল একেবারেই স্বচ্ছ ঝকঝকে তকতকে অনাবিল। আর ব্যক্তিগত জীবন ছিল আরো অধিকতর স্বচ্ছ ও নির্মল।
আট বছর বয়স থেকে হজরত আনাস রা: তাঁর সেবক হিসেবে তাঁর সতীর্থ লাভ করেন। তিনি ১০ বছর রাসূল সা:-এর সেবা করেন। তিনি বলেন, রাসূল সা: কখনো আমাকে ধমক দেননি। কখনো বলেননি, এমনটি করলে কেন? অমনটি করলে না কেন? তিনি কখনো কাউকে মারেননি, নির্যাতন করেননি, ধমক দেননি, তাড়িয়ে দেননি, অপমান করেননি, অনাদর করেননি। কারো সাথে রুক্ষ ব্যবহার করেননি। তার অমায়িক ব্যবহারে ঘরের এবং বাইরের সবাই ছিল তাঁর প্রতি চুম্বকের মতো আকৃষ্ট ও মুগ্ধ। জারির ইবনে আবদুল্লাহ রা: বলেন, ‘ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে কখনো তাঁর কাছে যেতে বাধা দেননি এবং যখনই আমাকে দেখেছেন, মিষ্টি হেসেছেন’ (মুআত্তায়ে মালেক)।
আনাস রা: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন ফজরের নামাজ পড়া শেষ করতেন, তখন মদিনার লোকদের চাকর-চাকরানী তাঁর কাছে পাত্রভরা পানি নিয়ে উপস্থিত হতো যেন তিনি তাদের পানি স্পর্শ করে দেন। তখন তিনি তাদের প্রত্যেকের পানির পাত্রে হাত বুলিয়ে দিতেন। অনেক সময় তারা শীতের সকালেও আসত। তখনো তিনি তাদের পানির পাত্রে হাত ডুবিয়ে দিতেন’ (সহিহ মুসলিম)। আনাস রা: বলেন, মদিনার একটি ছোট মেয়ে নবী করিম সা:কে হাতে ধরে (নিজের অভিযোগ শোনানোর জন্য) যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারত’ (সহিহ মুসলিম)। আনাস রা: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: কখনো কাউকে অশ্লীল অশালীন কথা বলতেন না, অভিশাপ দিতেন না এবং গালাগাল করতেন না। কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে শুধু এতটুকু বলতেন: তার কী হলো, তার কপাল ধুলোমলিন হোক!’(সহিহ বুখারি)। আনাস রা: বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: রোগীর সেবা করতেন, কফিনের সাথে যেতেন, সেবক কর্মচারীদের দাওয়াত গ্রহণ করতেন এবং গাধার পিঠে চড়তেন’ (ইবনে মাজাহ)। আনাস রা: আরো বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন কারো সাথে মুসাফা করতেন, তখন তিনি নিজের হাত ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড়িয়ে নিতেন না যতক্ষণ না সে ব্যক্তি নিজের হাত সরিয়ে নিত। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত তার দিক থেকে মুখ ফিরাতেন না, যতক্ষণ না সে নিজে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিত। তাঁকে কখনো মানুষের দিকে পা ছড়িয়ে বসতে দেখা যায়নি’ (তিরমিজি)।
বিশ^নবী বিশ^মানবতাকে যে তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য দিয়ে আলোকিত করেছিলেন আজ তা শুধুই স্বপ্ন। বিশ^সভ্যতা আজ বিজ্ঞান প্রযুক্তির আবিষ্কারে এক অসাধারণ কৃতিত্বের দাবিদার হলেও চারিত্রিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে অনেক পেছনে পড়ে আছে। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় উন্নতির দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেলে অহঙ্কার ও দাম্ভিকতা তাদের স্পর্শ করে। ফলে তারা এতটাই অধঃপতিত হয় যে ইপুকেরিয়ান ফিলোসফির মতে মানব প্রকৃতি হচ্ছে মূলত স্বার্থপর ধরনের। এর পেছনে রয়েছে তার সুখ ও সমৃদ্ধির আকাক্সক্ষা। ম্যাকিয়াভেলি যে রাজনৈতিক দর্শন আমাদের দিয়ে গেছেন তার মূলভিত্তি হচ্ছে, মানুষ আসলে চরম স্বার্থপর, মালিকানামুখী এবং আগ্রাসী। হব্স তার বিখ্যাত গ্রন্থ লেভিয়াথানে মানব প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সে হচ্ছে পশুর চেয়েও অধম এবং স্বার্থপরতাই হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। লক এবং অন্যরা মনে করেন মানুষ মূলত আত্মকেন্দ্রিক।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কুরআন


আরো সংবাদ



premium cement