২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তাকাফুল : ইসলামী ইন্স্যুরেন্স-১

-

ইসলাম ও শরিয়তের বিধিবিধান সম্পর্কে আমাদের প্রয়োজনীয় ও কারো কারো ন্যূনতম জ্ঞান না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আমরা প্রশ্ন ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। উদাহরণ মতে, শরিয়তের বিধিবিধান ইবাদত, মো‘আমালাত, মো‘আশারাত, ইকতেসাদিয়াত, সিয়াসিয়াত (ইবাদত, লেনদেন, সামাজিকতা, অর্থনীতি ও রাজনীতি) ইত্যাদির ক্ষেত্রে ‘বিদ‘আত’-এর প্রসঙ্গ বা তেমন প্রশ্ন কেবল ‘ইবাদত’-এর বিষয়ে প্রযোজ্য; অন্যান্য বিষয়ে তেমন প্রশ্ন প্রযোজ্যই হয় না। কেননা বিদ‘আতের সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘ইবাদত জ্ঞান করে বা ইবাদত মনে করে’ কর্মটি সম্পাদন করা। অথচ ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই করে থাকে। এতে কারো ‘ইবাদত করছি’ এমন লক্ষ্য ও মানসিকতা আদৌ কাজ করে না। সুতরাং এ বিষয়ে এমন প্রশ্ন করা যে, ‘তা কি বিদ‘আত নয়’ Ñসম্পূর্ণ অবান্তর ও অর্থহীন।
এটা একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, একজন মুমিন-মুসলমানকে তার নেক নিয়ত ও কল্যাণ চিন্তার দরুন ‘নিয়তকেন্দ্রিক’ একটা পৃথক সওয়াব প্রদান করা হয়; হোক তা মল-মূত্র ত্যাগ, আহার-বিহার, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা জাগতিক যেকোনো কাজ এবং হোক না তা মৌল বিবেচনায় ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।
(১) ‘তাকাফুল’ বা ‘ইন্স্যুরেন্স’ বা অনুরূপ কোনো সমিতি বা সমবায় বা সংস্থা বা কয়েকজনের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে যদি ‘তোমরা পরস্পরকে সৎ ও কল্যাণকাজে, তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা করো’ (আল-মায়েদা : আয়াত নং-২)-এর আলোকে মুসলমানদের বা সমাজ ও দেশের লোকজনের কল্যাণ বা আংশিক কল্যাণ করা যায়, তা কি না-জায়েজ হবে? তাতে কি কোনো সওয়াব পাওয়া যাবে না?
(২) পাশ্চাত্যের বা অমুসলিম দেশগুলোর যারাই ‘ইন্স্যুরেন্স’ নামের প্রচলিত সুদী বিনিয়োগ পদ্ধতি বা পারস্পরিক সহযোগিতার নামে জনগণকে, বিশেষ করে মুসলমানদের সুদের মারপ্যাঁচে জড়িয়ে ফেলেছে; সেই মুসলমানদের সজাগ-সতর্ক করার পাশাপাশি বিকল্প হালাল ও বৈধ পন্থা-পদ্ধতি কী হতে পারে, তা দেখিয়ে দেয়া, কী একজন আলেম বা মুফতি হিসেবে, দীনের একজন দায়ী হিসেবে, মুসলমানদের একজন নেতা ও শাসক-রক্ষক হিসেবে সবার দায়িত্ব বর্তায় না? অবশ্যই যার যার শক্তি-সামর্থ্য মোতাবেক দায়িত্ব আছে। বিশেষত বিষয়টি যখন এমন হয় যে, তাতে সাধারণ জনগণ মুসলিম হোক আর অমুসলিম হোক; গড্ডালিকা প্রবাহে চলতে অভ্যস্ত হয় এবং তাতে তাদের জাগতিক লাভ ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন জড়িত হয়। ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব বিষয়ে জবাবদেহি করতে হবে’ Ñএসব হাদিস কি এড়িয়ে যাওয়া যাবে?
(৩) তা ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যখন ‘ইন্স্যুরেন্স’ ইত্যাদির মতো কোনো সুদী ব্যবস্থা বা সিস্টেম, কারো ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক চালু হয়ে যায়। আবার দেশ ও জনগণ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে গিয়ে বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে, তাতে না জড়িয়ে উপায় থাকে না; তখন তো দেশপ্রেমিক ও সমাজ সচেতন একজন নায়েবে-নবী হিসেবে তেমন ‘সুদী ইন্স্যুরেন্স’-এর একটা বিকল্প ‘সুদবিহীন ইন্স্যুরেন্স’ দাঁড় করিয়ে, দেশ ও দেশের জনগণকে সুদ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা, নৈতিক দায়িত্ব নয় কি?
(৪) ইন্স্যুরেন্স বা বীমা ব্যবস্থার ‘মূল সেøাগান’ ও প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ বা কাছাকাছি অর্থের শব্দ দ্বারা, যে-ভাব-ব্যাখ্যা ও কল্যাণ বোঝানো হয়; সেই কল্যাণ সাধন বা কামনা তো ইসলামী আদর্শ, বোধ-বিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনাবিরোধী নয়। কেবল সমস্যা দাঁড়িয়েছে সুদী ব্যবস্থা, কর্মকৌশল ও সুদের সংশ্লিষ্টতার দরুন। আমরা সেই ব্যবস্থা ও কর্মকৌশল বাদ দিলাম! এবার দেখুন তো বীমা বা ইন্স্যুরেন্সের মূল দাবি ও চাহিদা সম্পূর্ণ ইসলামী আদর্শেরও দাবি ও চাহিদা কি না? দেখুন! হজরত মাওলানা আবদুর রহীমের ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’ (পৃ-৮৬-১২০, সংস্করণ-২০০৫ খ্রি. খায়রুন প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা); সাবেক সিএসপি ও সচিব এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক এ জেড এম শামসুল আলমের ‘ইসলামী ইন্স্যুরেন্স (তাকাফুল’) নামক (পৃ-১৬-৬১, মাম্মী প্রকাশনী, প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা, সংস্করণ-সেপ্টেম্বর-২০০১ খ্রি.) পুস্তকটি; এবং মালয়েশিয়া ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অঙ্গ সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং’ (কুয়ালালামপুর, সংস্করণ-১৯৯৬) কর্তৃক সঙ্কলিত ‘তাকাফুল’ শীর্ষক পুস্তকগুলো।
আমার ধারণা মতে, অবহিত মহল সে সবকে পুরনো কথা ও চর্বিত চর্বণ ভাবতে পারেন, তাই সংক্ষেপ করলাম।
(৫) এ ছাড়া যারা শুধু পাশ্চাত্যের সুদী উদ্যোক্তাদের সেই প্রচলিত সুদী বীমা নিয়েই কেবল আলোচনা করে থাকেন এবং সেই আদলে প্রতিষ্ঠিত নিজ দেশের সুদী ইন্স্যুরেন্সের বাইরে আদৌ চিন্তা করেননি; তাদের তেমন প্রয়োজনও পড়েনি। এমনকি তারা বরং নিজ রাষ্ট্রীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বহুমুখী নির্যাতনের মুখে, সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায়, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে, সেই সুদী ব্যবস্থাকেই নিজেদের স্বধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তা বিবেচনায় ‘জায়েজ’ মর্মে ফতোওয়া দিয়ে রেখেছেন (দ্র. জাদিদ ফিকহী মাবাহিস: খ-৪, পৃ-১৬৭-৩০৮, সম্পাদনা: মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী, ইদারাতুল কুরআন ওয়াল-উলূমুল ইসলামিয়া, ৪৩৭-ডি, গার্ডেন ইস্ট, করাচি-৫, পাকিস্তান; একইভাবে ভারত থেকে প্রকাশিত ১৯৬৫ খ্রি. থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় বড় ফতোওয়া গ্রন্থ রয়েছে, তার সবগুলোতেই প্রায় একই ফতোওয়া আলোচিত হয়েছে)।
যেহেতু স্থান-কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বিশেষ প্রয়োজনে ফতোওয়া পরিবর্তন হতে পারে; সে হিসেবে বৃহত্তর ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ক্ষেত্রে ওই ফতোওয়া সঠিক আছে বা ছিল। তাতে আমাদের দ্বিমতের কিছু নেই। তাদের প্রথম দফার গবেষণা ছিল ‘মজলিসে তাহকিকাতে শরঈয়্যাহ লখনৌ’-এর অধীনে যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে মোট ১০ জন আলেম ও মুফতি স্বাক্ষর করেছিলেন; যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৫ খ্রি. সালে। বিষয় ছিল ভারতীয় মুসলিমদের প্রেক্ষাপটে প্রচলিত ইন্স্যুরেন্সের বৈধতা; ‘ইসলামী ইন্স্যুরেন্স’ বা ইন্স্যুরেন্সের ইসলামীকরণ সম্ভব কি না? তেমন কিছু নয়।
দ্বিতীয় দফার গবেষণা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯-১২/৮/১৯৯২খ্রি. মোট চার দিনে এবং তাতে প্রশ্নোত্তরের জবাব আকারে মোট ২২ জন, অভিমত আকারে মোট ২২ জন ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মোট ২৪ জন। সর্বমোট ৬৮ জনের লেখা ওই গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে। আর এটি ছিল ‘ইসলামিক ফিকহ একাডেমি, ইন্ডিয়া’ এর চতুর্থ সম্মেলন। এ সম্মেলনের আগে সবার কাছে পাঠানো প্রশ্নাবলিতে এবং প্রথম দিনের স্বাগত ভাষণের উপসংহারে বলা ছিল, ‘উল্লেখ্য, আলোচনা ও গবেষণার বিষয় এটি নয় যে, ইন্স্যুরেন্স বা তাতে অংশগ্রহণ জায়েজ কি না? এ মুহূর্তে লক্ষণীয় বিষয় হলো, শুধু এটি যে, ইন্স্যুরেন্সকে নাজায়েজ ধরে নিয়ে, ফিকহগত বিবেচনায় ঠেকা হিসেবে তাতে জড়িত হওয়ার অনুমতি প্রদান করা যায় কি না?...’। অর্থাৎ এতেও ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের কোনো প্রসঙ্গ নেই। সুতরাং আমরা বাংলাদেশের আলেম ও মুফতিগণ কোন বিবেচনায় তাদের ফতোওয়ার কিতাবগুলোর কয়েক লাইন অধ্যয়ন করেই গণহারে ‘ইন্স্যুরেন্স’ বলতেই নাজায়েজ বলে ফেলি বা ফতোওয়া দিয়ে বসি? আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বা ইসলামী দেশ বিবেচনায় আমাদের ফতোওয়া হবে ভিন্ন, আমাদের গবেষণা হবে ভিন্ন, আমাদের দায়দায়িত্ব ও কর্মপন্থা হবে ভিন্ন! যেমনটি বিজ্ঞ উস্তাদ মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী প্রমুখও আলোচ্য বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও, ওই সব সেমিনারে মৌখিক ও লিখিতভাবে উল্লেখ করেছেন (দ্র. পৃ-২১২-৫৯৬)। আমাদের উচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলো, বিশেষ করে যারা ইসলামী ইন্স্যুরেন্স চালু করেছেন এবং সফল হয়েছেন, যেমন বাহরাইন, ব্রুনাই, মালয়েশিয়া ও সুদান। এমনকি লুক্সেমবার্গ, বাহামা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও (এ জেড এম শামসুল আলম, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, পৃ-১২); তারা কিভাবে বীমার ইসলামীকরণ করেছেন, তা আদ্যপান্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করা এবং নিজেদের অর্জিত ইলম-কালামের সাথে মিলিয়ে নেয়া।
লেখক : মুফতি, ইফা

 


আরো সংবাদ



premium cement