২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল কুরআনের পরিচয়

-

আল কুরআন মহান স্রষ্টার নাজিলকৃত সর্বশেষ আসমানি কিতাব। মহান স্রষ্টা বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পর তিনি তা পরিচালনা, প্রতিপালন ও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি বা বিধান তৈরি করে দিয়েছেন। প্রত্যেক সৃষ্টিই সে নির্দিষ্ট নিয়মনীতি বা বিধান অনুসরণ করে চলছে। তাই সমগ্র সৃষ্টিজগতে যেমন কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, তেমনি আল্লাহর নিয়মনীতির মধ্যেও কোনো ব্যতিক্রম বা ব্যত্যয় নেই। অনুরূপভাবে, মানুষ সৃষ্টির পরও তিনি মানবজাতির সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য একটি বিধান দিয়েছেন, এ বিধানের নাম ইসলাম।
মানুষ সৃষ্টির সময় থেকেই মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এ বিধান কার্যকর রয়েছে। আদি মানব আদম আ: থেকে এ বিধান চালু হয়েছে। আদম আ:কে সৃষ্টির পর জান্নাতে তাঁকে কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে, তা স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে শিখিয়েছেন। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির পর তিনি স্বয়ং তাঁকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন,ভাষার মাধ্যমে তাঁকে নানা বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের দ্বারা মানুষ যেমন ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, কল্যাণ-অকল্যাণ ইত্যাদি বুঝতে পারে, তেমনি ভাষার দ্বারা সে নিজেকে সম্যকরূপে অন্যের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম। ভাষা ও জ্ঞান শিক্ষার প্রধান মাধ্যম কলম। মহান স্রষ্টা সে কলমের কথাও তাঁর আসমানি কিতাবের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন।
আদম আ: ও মা হাওয়া আ: যখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তখন স্বয়ং আল্লাহ তাঁদের পৃথিবীতে সঠিক পথে চলার পথ-নির্দেশনা দেন। এ নির্দেশনাকে আল কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘ওহি’। এ ওহির নির্দেশনায় যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত খাস বান্দারা মানবজাতিকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ খাস বান্দাদের কুরআনের ভাষায় নবী ও রাসূল বলা হয়। প্রথম মানব আদম আ: ছিলেন প্রথম নবী। পরবর্তীতে প্রায় এক লাখ চব্বিশ হাজার বা দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ সা:। প্রত্যেক নবী-রাসূলের ওপর আল্লাহ তায়ালার ওহি নাজিল হয়েছে। কারো কারো ওপর আসমানি কিতাব ও সহিফা নাজিল হয়েছে। সহিফা হলো ক্ষুদ্রায়তন উপদেশ বাণী। কিতাব হলো বড় আকারের পূর্ণায়তন হিদায়াত গ্রন্থ। সর্বমোট চারটি কিতাব নাজিল হয়েছে। এগুলো হলোÑ তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল ও আল কুরআন। প্রথম তিনটি কিতাব সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বিকৃত-বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন, যা আখেরি নবীর ওপর নাজিল হয়েছে, তা কিয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে হেফাজত করার দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। তাই নাজিল হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এ কিতাবের একটি বর্ণ বা জের-জবরও মুছে যায়নি বা বিকৃত হয়নি। কিয়ামত পর্যন্ত এ মহান কিতাব সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকবে এবং সমগ্র মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলো, মিথ্যা থেকে সত্য, অন্যায় থেকে ন্যায়, অমানবিকতা থেকে মানবিকতার উজ্জ্বল পথের সন্ধান দেবে। তাই সত্য, সুন্দর, ন্যায়, শান্তি, কল্যাণ ও মানবিকতার পথে উত্তরণের জন্য আল কুরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য সঠিক পথের নির্দেশনা রয়েছে।
মানবজীবনে সাফল্য অর্জন এবং পৃথিবীতে শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপনে আল কুরআনের কোনো বিকল্প নেই। আল কুরআন শুধু মুসলিম নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত একমাত্র সঠিক-নির্ভুল হিদায়াত গ্রন্থ। তবে এ গ্রন্থের ওপর যারা ঈমান আনে এবং অনুসরণ করে, তাদের বলা হয় মুসলিম। মুসলিম অর্থ অনুগত। আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে যারা আল্লাহর নির্দেশ বা দ্বীনের আনুগত্য করে তারাই মুসলিম।
আল কুরআন মহান স্রষ্টার পবিত্র বাণী। তাই অন্য কোনো কিছুর সাথে এর তুলনা করা চলে না। এরূপ কোনো গ্রন্থ তো দূরের কথা, এ গ্রন্থের একটি ক্ষুদ্র বাক্যাংশের অনুরূপ কোনো কিছু রচনা করাও কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ অসাধারণ মহিমান্বিত গ্রন্থটি নাজিল হয়েছে, তাই অন্য কোনো গ্রন্থের সাথে এ গ্রন্থের তুলনা করা কোনো মতেই সম্ভব নয়।
আল কুরআনের ভাব-ভাষা-বর্ণনা অসাধারণ। আল কুরআনে নেই, এমন কোনো বিষয় পৃথিবীতে নেই। এটি যেমন মাধুর্যময়, কাব্যময়, রূপক-অলঙ্কার-উপমাসমৃদ্ধ, তেমনি এ গ্রন্থ অতিশয় জ্ঞানগর্ভ, প্রজ্ঞা, শিক্ষা ও উপদেশ লাভের জন্য অতুলনীয়। এর ভাষা ও বর্ণনা এত মনোমুগ্ধকর যে, এ গ্রন্থ তিলাওয়াতে অপরিসীম আনন্দ লাভ হয়। এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মুসলিম এ গ্রন্থ কণ্ঠস্থ করেছেন। পৃথিবীতে দ্বিতীয় এমন কোনো গ্রন্থ নেই, যার আবৃত্তি এত মনোমুগ্ধকর ও যা সহজে মানুষ মুখস্ত করতে পারে। আল কুরআনের এটা এক অলৌকিক বৈশিষ্ট্য।
এ মহান গ্রন্থ যেহেতু স্বয়ং স্রষ্টার বাণী, তাই এ পবিত্র বাণী পাঠ ও শ্রবণেও অসীম ছওয়াব নিহিত। কিন্তু শুধু পাঠের জন্য এ কিতাব নাজিল হয়নি। এটি হলো মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য হিদায়াত বা পৃথিবীতে সঠিক পথে চলার নির্দেশনা। মানুষ এ কুরআন পাঠ ও কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলে মানবজীবনে সফলতা আসবে। অন্যথায়, তার জীবন বিফল হবে, সন্দেহ নেই। কুরআন অনুসরণকারীর জীবন দুনিয়াতেও সফল, আখিরাতেও সে অফুরন্ত নেয়ামত লাভে সক্ষম। অতএব, যে মানুষ নিজের ভালো, কল্যাণ, শান্তি ও সাফল্য চায়, তার অবশ্যই কুরআন পাঠ ও তার নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা অবশ্য কর্তব্য। অন্যথায়, তার জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। কেননা, মানবজীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্যই স্রষ্টার পক্ষ থেকে এ বিধান নাজিল হয়েছে।
আল কুরআন শুধু ব্যক্তি মানুষকে সঠিক পথ-নির্দেশনা দেয় না, সমষ্টি তথা সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বকে সঠিক পথ-নির্দেশনা দেয়। মানুষ ও জগতের সাথে যা কিছু সম্পর্কিত, সে সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ আল কুরআনে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যক্তি, সমষ্টি, সমাজ, রাষ্ট্র তথা বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে আল কুরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, কায়কারবার, মানুষের আচার-আচরণ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, আনন্দ-বিনোদন ইত্যাদি সব বিষয়ে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নাজিলকৃত পবিত্র গ্রন্থে সুস্পষ্ট নীতিমালা দেয়া হয়েছে। এ জন্য ইসলাম প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের মতো নয়, এটা মানবজীবনের সামগ্রিক বিধান, যা স্বয়ং স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত। অতএব, এটা একটি সম্পূর্ণ, সার্বজনীন, সর্বকালীন, চিরন্তন, শাশ্বত, নির্ভুল বিধান। এ বিধান শুধু মুসলিম নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। তাই এ সম্পর্কে জানা, এর চর্চা ও অনুসরণ করা, প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য।
আল কুরআন নিছক ধর্মতত্ত্ববিষয়ক কোনো গ্রন্থ নয়। এতে একাধারে রয়েছে ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, দর্শন, নীতিকথা, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মানুষ ও জগৎ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়, সৃষ্টিজগৎ, স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক, ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়। আল কুরআনে স্বয়ং স্রষ্টা ঘোষণা করেছেন, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যা এ গ্রন্থে নেই। এ থেকে বুঝা যায়, এ এক মহা অলৌকিক গ্রন্থ। এ ধরনের কোনো গ্রন্থ মানুষের পক্ষে রচনা করা শুধু অসম্ভব নয়, অকল্পনীয়ও বটে। এর দ্বারা প্রমাণ হয়, আল কুরআন মহান স্রষ্টার নাজিলকৃত গ্রন্থ। সমগ্র মানবজাতির সঠিক পথ-নির্দেশনা রয়েছে এ মহাগ্রন্থে।
আল কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। পৃথিবীতে ভিন্ন ভাষাভাষী অন্যরা যাতে আল কুরআনের অর্থ, তাৎপর্য ও মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারে, সে জন্য পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই আল কুরআনের অনুবাদ হয়েছে। আল কুরআন একমাত্র গ্রন্থ, যা পৃথিবীতে প্রচলিত সর্বাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা ভাষাতেও বিভিন্ন বিজ্ঞ আলেম বিভিন্ন সময় আল কুরআনের সহজ-সুন্দর অনুবাদ করেছেন। তাই বাংলাভাষীদেরও আল কুরআনের মর্মবাণী জানা ও সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা অনেকটাই সহজসাধ্য। তবে আল কুরআন মহান আল্লাহর এমন এক অলৌকিক গ্রন্থ যে, এ গ্রন্থের সম্পূর্ণ সঠিক অনুবাদ করা যেকোনো ভাষায় অত্যন্ত কঠিন। তবে এর মর্মবাণী যথাসম্ভব অনুবাদের মাধ্যমে সবাই উপলব্ধি করতে সক্ষম। আর বিভিন্ন অনুবাদ গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে মোটামুটি সঠিক ধারণা লাভ করা অনেকটাই সম্ভব।
আল কুরআনের সঠিক অর্থ বুঝার জন্য আরবি ভাষায় গভীর জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশত, সবার সে জ্ঞান নেই। ভিন্নভাষীরা ও আরবি ভাষায় অদক্ষ ব্যক্তিরা অনুবাদ পড়ে এ মহান গ্রন্থের মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারেন। তাই প্রত্যেকের আরবি শিখে শুদ্ধরূপে কুরআন পড়ার চেষ্টা করার সাথে সাথে তার মাতৃভাষায় কুরআনের অনুবাদ পড়ে এর মর্মার্থ উপলব্ধি করা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করা উচিত। মহান স্রষ্টা তাঁর সব বান্দাকে তাঁর পবিত্র হিদায়াত গ্রন্থ অধ্যয়ন, অনুধাবন ও সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তৌফিক এনায়েত করুন।
লেখক : শিক্ষাবিদ

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজার ২টি হাসপাতালে গণকবরের সন্ধান, তদন্তের আহ্বান জাতিসঙ্ঘের তীব্র তাপদাহে পানি, খাবার স্যালাইন ও শরবত বিতরণ বিএনপির ৬ জেলায় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ, সিলেট বিভাগে বৃষ্টির সম্ভাবনা মাতামুহুরিতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ২ আপিল বিভাগে ৩ বিচারপতি নিয়োগ ফেনীতে ইসতিসকার নামাজে মুসল্লির ঢল গাজা যুদ্ধের মধ্যেই ১০০ শতাংশ ছাড়িয়েছে ইসরাইলের সামরিক ব্যয় মন্ত্রী-এমপি’র স্বজনরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে ব্যবস্থা : কাদের গ্যাটকো মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুন বুড়িচংয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ গলাচিপায় স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে ৩টি সংগঠনের নেতৃত্বে মানববন্ধন

সকল