২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাবার মেহমান

-

হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা স্তম্ভ। আরবি ভাষায় হজ শব্দের অর্থ জিয়ারতের সঙ্কল্প করা। যেহেতু খানায়ে কাবা জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা পৃথিবীর চারিদিক থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে চলে আসে, তাই এর নাম হজ রাখা হয়েছে। কিন্তু এ হজের পেছনে এক সংগ্রামী, চিত্তাকর্ষক ও শিক্ষাপ্রদ ইতিহাস নিহিত রয়েছে। যারা এ বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্রে আল্লাহর মেহমান হিসেবে হাজিরা দিতে যাবেন, তারা যদি একটু গভীর মনোযোগসহকারে সে ইতিহাস অধ্যয়ন করে নেন, তবে হজের প্রকৃত শিক্ষা ও কল্যাণ লাভ করা সহজ হবে।
হজ এলেই আমাদের হৃদয়স্পটে ভেসে ওঠে শিরকের মূলোৎপাটনকারী মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা ও পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর কথা। যিনি মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রভুর সন্ধানে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্রকে ব্যর্থ প্রভু ভেবে অবশেষে সত্যের আলোর সন্ধান পেলেন এবং উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেনÑ ‘তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরিক বলে মনে করো তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিশেষভাবে কেবল সেই মহান সত্তাকেই ইবাদাত-বন্দেগির জন্য নির্র্দিষ্ট করলাম, যিনি সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের মধ্যে শামিল নই।’
এভাবে হজরত ইবরাহিম আ:-কে দুনিয়ার নেতৃত্ব দান করা হলো এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম বা মুসলমানদের চিরস্থায়ী আদর্শিক নেতা নিযুক্ত করা হলো। জ্যেষ্ঠপুত্র হজরত ইসমাইল আ:-কে সাথে নিয়ে তিনি হিজাজের মক্কা নগরীকে কেন্দ্র করে আরবের কোণে কোণে ইসলামের শিক্ষাকে বিস্তার সাধন করলেন। আর পিতা-পুত্র মিলে ইসলামী আন্দোলনের বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্র খানায়ে কাবা প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এ কেন্দ্র নির্দিষ্ট করে দেন। খানায়ে কাবা সাধারণ মসজিদের মতো নিছক ইবাদতের স্থান নয়, প্রথম দিন থেকেই এটা দ্বীন ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রচার কেন্দ্ররূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ কাবা নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী সব মানুষ এখানে এসে মিলিত হবে এবং সঙ্ঘবদ্ধভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করবে, আবার এখান থেকে ইসলামের বিপ্লবী পয়গাম নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। বিশ্ব মুসলিমের এ সম্মেলনের নামই হজ।
এ ঘরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়া শুনুন : আল্লাহ তায়ালা বলছেনÑ ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম দোয়া করেছিলেন : হে আল্লাহ! এ শহরকে শান্তিপূর্ণ বানাও, আমাকে এবং আমার সন্তানকে মূর্তি পূজার শিরক থেকে বাঁচাও। হে আল্লাহ! এ মূর্তিগুলো অসংখ্য লোককে গোমরাহ করেছে। অতএব, যে আমার পন্থা অনুসরণ করবে সে আমার, আর যে আমার পন্থার বিপরীতে চলবেÑ তখন তুমি নিশ্চয়ই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরোয়ারদিগার! আমি আমার বংশধরদের একটি অংশ তোমার এ মহান ঘরের নিকট, এ ধূসর মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেছিÑ এ উদ্দেশ্যে যে, তারা নামাজ কায়েম করবে। অতএব, হে আল্লাহ! তুমি লোকদের মনে এতদূর উৎসাহ দাও যেন তারা এর দিকে দলে দলে চলে আসে এবং ফলমূল দ্বারা তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করো। হয়তো তারা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবে’ (সূরা ইবরাহিম-৩৫-৩৭)।
এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেনÑ ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিমের জন্য এ ঘরের স্থান ঠিক করেছিলামÑ এ কথা বলে যে, এখানে কোনো প্রকার শিরক করো না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও নামাজিদের জন্য পাক-সাফ করে রাখো। আর লোকদেরকে হজ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহ্বান জানাওÑ তারা যেন তোমার কাছে আসে, পায়ে হেঁটে আসুক কিংবা দূরবর্তী স্থান থেকে কৃশ উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের ব্যবস্থা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেয়া জন্তুগুলোকে আল্লাহর নামে কোরবানি করবে, তা হতে নিজেরাও খাবে এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরকে খেতে দেবে’ (সূরা হজ-২৬-২৮)।
এ ঘরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পিতা-পুত্র মিলে মহান আল্লাহর দরবারে আরো দোয়া করেছিলেন, যা আল্লাহ নিজের ভাষায় কুরআনে বলেছেনÑ ‘এবং স্মরণ করো, ইবরাহিম ও ইসমাইল যখন এ ঘরের ভিত্তি স্থাপনকালে দোয়া করছিলেনÑ ‘পরোয়ারদিগার! আমাদের এ চেষ্টা কবুল করো, তুমি সব কিছু জানো এবং সব কিছু শুনতে পাও। পরোয়ারদিগার! তুমি আমাদের দুজনকেই মুসলিম অর্থাৎ তোমার অনুগত করো এবং আমাদের বংশাবলি থেকে এমন একটি জাতি সৃষ্টি করো যারা একান্তভাবে তোমারই অনুগত হবে। আমাদেরকে তোমার ইবাদত করার পন্থা বলে দাও, আমাদের প্রতি ক্ষমার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো, তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরোয়ারদিগার! তুমি সে জাতির প্রতি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন নবী পাঠাও যিনি তাদেরকে তোমার বাণী পড়ে শোনাবে, তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেবে এবং তাদের চরিত্র সংশোধন করবে। নিশ্চয় তুমি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বিজ্ঞ’ (সূরা বাকারা-১২৭-১২৯)।
যে শিরক উচ্ছেদ ও মূর্তি পূজা বন্ধ করার সাধনা ও আন্দোলনে হজরত ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ:-এর সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, কালের বিবর্তনে এ কাবা ঘরে আবার ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা হয়। চারদিকে শিরক আর শিরক চলতে থাকে। লাত, মানাত, হুবাল, নসর, ইয়াগুস, উজ্জা, আসাফ, নায়েলা আরো অসংখ্য নামের মূর্তি তৈরি করে পূজা করত। হজকে তারা তীর্থযাত্রার অনুরূপ বানিয়ে তাওহিদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল কাবা ঘর থেকে মূর্তি পূজার প্রচার শুরু করেছিল এবং পূজারীদের সর্বপ্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত লোকদের কাছ থেকে নজর-নিয়াজ আদায় করত। হজের অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোকে বিকৃতরূপ দিয়ে পালন করত। এভাবে ইবরাহিম আ: ও হজরত ইসমাইল আ: যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন এবং যে উদ্দেশ্যে তারা হজ প্রথার প্রচলন করেছিলেন, তা সবই বিনষ্ট হয়ে যায়।
অবশেষে হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়ারই ফসল মানবতার বন্ধু হজরত মোহাম্মদ সা: মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে শিরকের মূলোৎপাটন করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতার হারানো হজের নিদর্শনগুলো পুনরুদ্ধার করেন।
হজের প্রতিটি পদে পদে আল্লাহর স্মরণ-আল্লাহর নামের জিকর, নামাজ, ইবাদত ও কোরবানি এবং কাবা ঘরের প্রদক্ষিণ। আর এখানে একটিমাত্র আওয়াজই মুখরিত হয়ে উঠে, হেরেম শরিফের প্রাচীর আর পাহাড়ের চড়াই-উৎরাইয়ের প্রতিটি পথে উচ্চারিত হয়Ñ ‘লাব্বাইক আলাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ হে প্রভু তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। সব প্রশংসা একমাত্র তোমার জন্য। সব নিয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি একক কেউই তোমার শরিক নেই।’
কাবার পথের যাত্রীরা কোথায় হাজিরা দিতে যাচ্ছেন আর হাজিরা দিতে গিয়ে কী বলছেন তা অবশ্যই গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তা করতে হবে। এমনিভাবে হজের প্রতিটি অনুষ্ঠান পালন করার সময় কী করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে তা অনুধাবণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষেই কি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনকে শিরকমুক্ত করতে পেরেছি এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসেবে পেশ করতে পেরেছি? আত্মজিজ্ঞাসার জবাব যদি নাবোধক হয় তবে আমরা লাব্বাইক বলে এ বিশ্বসম্মেলন কেন্দ্রে হাজিরা দেবো ঠিকই, কিন্তু আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত লেখা হবে। যেমন প্রাণহীন নামাজ মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতে পড়ছে না, প্রাণহীন রোজা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছে না ও জাকাত আমাদের পবিত্র করতে পারছে না। তেমনিভাবে প্রাণহীন হজ আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিই লেখা হবে। তাই কাবার পথের যাত্রীরা তাদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন।
শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে : শিরক একটি জুলুম। শিরকের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। শিরক সমস্ত নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। এ শিরক বর্তমানে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় এ শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ শিরকমুক্ত জীবন ও সমাজ গঠণ করার জন্যই হজরত ইবরাহিম আ: ও হজরত মুহাম্মদ সা: আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তা ছাড়া মহান আল্লাহর সম্মানিত মেহমান হিসেবে তালবিয়া পাঠে বলা হচ্ছে ‘আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। তুমি একক-কেউই তোমার শরিক নেই।’ এ কথাটিকে বাস্তব জীবনে রূপায়ন করতে হবে।
দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে, পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে : জন্মসূত্রে মুসলমান নয়, বরং একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে। সারা জাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে, নিজেকে তার নিকট সোপর্দ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করা হলো, কিন্তু জীবনের বিশাল অংশকে মানুষের তৈরি আদর্শের হাতে সোপর্দ করলে তিনি মুসলিম নন বরং একজন খাঁটি মোনাফিক। প্রতি নামাজেই অসংখ্যবার বলা হচ্ছেÑ ‘আমরা তোমারই গোলামি করি আর তোমারই সাহায্য চাই’। অথচ নামাজের বাইরে তার বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। এ এক মিথ্যাচার ছাড়া কী হতে পারে? আর এ মিথ্যাচারকে বিশ্বসম্মেলন কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে বলা হয়Ñ ‘হে প্রভু তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। সব প্রশংসা একমাত্র তোমার জন্য। সব নিয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি একক কেউই তোমার শরিক নেই।’ অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে তার বিপরীত কার্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি বা মুনাফেকি আচরণ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিত্যাগ করতে হবে।
হজ চেতনার অনুধাবন : হজের অনুষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে রেখে পালন করতে হবে। আর এ চেতনাকে হজরত ইবরাহিম আ: ও হজরত ইসমাইল আ:-এর মতো শিরক উচ্ছেদে এবং মানুষকে অসংখ্য মিথ্যা রবের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার আপসহীন সংগ্রামের কাজে ব্যবহার করতে হবে এবং এ সংগ্রাম নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবেই হজের স্বার্থকতা ও সুফল পাওয়া যাবে এবং আল্লাহর হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে।
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement