২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চাঁদ দেখা : সমস্যা ও সমাধান-৪

-

উক্ত ঘোষণার ক্ষেত্রে শর্ত হলো, এ ঘোষণা যেন সাধারণ সংবাদ বা সংবাদ পাঠের নিয়মে না হয় বরং তা ‘কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটির পক্ষে মনোনীত কোনো আলেম নিজে রেডিও, টিভি তথা প্রচারমাধ্যমের সামনে এমন ঘোষণা দেবেন যে, “আমাদের কাছে ‘চাঁদ দেখার সাক্ষ্য’ অথবা ‘সাক্ষ্য মোতাবেক সাক্ষ্য’ অথবা ‘ফায়সালা মোতাবেক সাক্ষ্য’-এর তিনটি পদ্ধতির মধ্যে অমুকটি উপস্থাপিত হয়েছিল। আমরা বিধি মোতাবেক নিশ্চিত হয়ে চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার ফায়সালা দিয়েছি এবং সরকারের/কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদত্ত ক্ষমতা বলে আমরা সারা দেশের জন্য এ ঘোষণা প্রদান করছি।”
উক্ত মৌলিক কয়েকটি বিষয় চাঁদ দেখা ও সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত প্রশ্নে সকলের সামনে থাকা চাই।
বাস্তবায়ন : উক্ত সাক্ষ্য-নীতির নিরীখে তা বাস্তবায়ন ও শৃঙ্খলাবিধানে যদি কোনো জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়, তা হবে কেবল শেষের প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে অর্থাৎ ‘ফায়সালা মোতাবেক সাক্ষ্য’ পদ্ধতির ক্ষেত্রে । কারণ, এ ক্ষেত্রে এক জেলার উপকমিটির ফায়সালা কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য দু’জন সাক্ষীর সেখানে উপস্থিত হওয়া জরুরি মর্মে বিধান রয়েছে! যা কি না যদিও এ বিমান পথে যাতায়াতের যুগে অসম্ভব নয় বটে; কিন্তু তারপরও তেমনটি অবশ্যই জটিল ও কঠিন।
উক্ত জটিলতার সহজ বিকল্প ও সমাধান কী হতে পারে? এমন প্রশ্নে আজ থেকে প্রায় ৫৫ (পঞ্চান্ন) বছর পূর্বে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের চারজন শীর্ষস্থানীয় প্রসিদ্ধ পণ্ডিত গবেষক আলেমÑ যাঁরা একনামে উপমহাদেশের দ্বিনি পরিবেশে পরিচিতÑ তাঁদের সম্মিলিত বৈঠকে চিন্তা-গবেষণা করা হয়েছে। এঁরা হলেন : ১) হজরত মাওলান মুফতি মুহাম্মদ শফী র. ২) হজরত মাওলানা জফর আহমদ উসমানী র. ৩) হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরি র: ৪) হজরত মাওলানা মুফতি মুহম্মিদ রশিদ আহমদ র: । অর্থাৎ আলোচিত ‘সাক্ষ্য মোতাবেক গৃহীত ফায়সালার ক্ষেত্রেও তা অন্যত্র বাস্তবায়ন বা অন্য সকলের বেলায় প্রযোজ্য বলতে বা করতে গেলে সাক্ষ্য ও সাক্ষীসহ সেখানে বা কেন্দ্রে পৌঁছাতে হবেÑ তার বাধ্য-বাধকতা কতটুকু? বা তাতে কী সহজ কোনো পন্থা বের হতে পারে? তার সার-সংক্ষেপ হলো :
সমাধান : “চার মাজহাব ও জুমহুর আলেমগণের কিতাবাদি অধ্যয়ন করে এ আলেমগণ এমন ফলাফলে উপনীত হয়েছেন যে, মৌলিকভাবে নীতিগত বিবেচনায় অধঃস্তন বা জেলা পর্যায়ের উপকমিটির ‘চাঁদ দেখার ফায়সালা’ কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য তখনই গ্রহণযোগ্য-বাস্তবায়নযোগ্য হতে পারে যখন তা অপর বিচারকের (কমিটির) কাছে শরিয়তসম্মত সাক্ষ্য ও দু’জন সাক্ষীসহই পৌঁছাবে। কেবল টেলিফোন ইত্যাদির মাধ্যমে তার সংবাদ দিয়ে দেয়াই যথেষ্ট হবে না। উম্মতের জুমহুর ফকিহগণেরÑ হানাফি, শাফেঈ, মালেকি ও হাম্বলিদেরÑ মূল মাজহাব তথা গবেষণা তেমনটাই। হেদায়া, কিতাবুল উম্ম (ইমাম শাফেঈ র:) ও মুগনি-ইবনে কুদামা (হাম্বলি) ইত্যাদিতে তেমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। সে কারণে উত্তম হবে তো তা-ই যে, সরকার শরিয়তের মূল বিধান (গবেষণা) মোতাবেক তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা করতে পারেন। (প্রাগুক্ত : পৃ:- ৪০২)
তবে হ্যাঁ, আলেমগণের ওই বৈঠকে এমন প্রশ্নেও চিন্তা-পর্যালোচনা করা হয়েছে যে, সরকার যদি উক্ত প্রক্রিয়া অবলম্বন বা বাস্তবায়ন জটিল বলে মনে করেন, সেক্ষেত্রে কি তার কোনো বিকল্প পন্থা হতে পারে? গভীর চিন্তা-গবেষণার পর তার একটা সমাধান এ মর্মে বের করা হয়েছে :
শেষে সমাধান : “সরকার প্রতিটি বড় বড় শহরে উপকমিটি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেবেন। (বর্তমানে জেলাপর্যায়ে আছে, তা উপজেলাপর্যায় পর্যন্ত করা যেতে পারে; এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও করা যেতে পারে। আর তা ইউনিয়ন পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা ইত্যাদির যে জনবল আছে তা দ্বারা সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব)
তার প্রতিটি কমিটিতে এমন কয়েকজন (২/৩) নির্ভরযোগ্য আলেমকে সদস্য হিসেবে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা চাই যাঁরা শরিয়তের সাক্ষ্য-নীতি বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবেন। আর প্রতিটি উপকমিটির কাজ শুধু সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনাই নয়; বরং এসব কমিটিকে ‘ফায়সালা’ দানের এখতিয়ারও প্রদান করা চাই অর্থাৎ পুরো দেশের বেলায়ই। (মুফতি রশীদ আহমদ র.: প্রসিদ্ধ আহসানুল ফাতাওয়া গ্রন্থকার)
এ উপকমিটি যদি বিধি মোতাবেক সাক্ষ্য গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে কোনো ফায়সালা দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে তো এই ফায়সালা অবশ্যই শরিয়তের নির্দেশিত সাক্ষ্য-আইন মোতাবেকই হয়ে গেল। এখন শুধু ঘোষণার কাজ বাকি থাকল। আর ঘোষণাকর্মের জন্য তো সাক্ষ্য থাকা জরুরি নয়। বরং উপকমিটির কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিকে সতর্কতার সঙ্গেÑ যাতে অপর কারো কোনো হস্তক্ষেপের সংশয় থাকবে নাÑ উপকমিটির এই ফায়সালা বিষয়ে অবহিত করে দেবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি এক্ষেত্রে এটিকে নিজেদের ফায়সালা বলে নয়; বরং উপকমিটির ফায়সালা হিসাবে (অথবা তার সঙ্গে আস্থা ও একমত পোষণ করে, সকলের সর্বসম্মত ফায়সালা বলেও) কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দিতে পারেন। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির এই ফায়সালা টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতেও হতে পারে।” (প্রাগুক্ত : পৃ- ৪০২-৩)
ভিডিও/ভিডিও-কল, ইমু ইত্যাদি : মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তীতে যখন ভিডিও, ভিডিও কল বা ইমু কল-এর মাধ্যমে উক্তরূপ বিবাহ-শাদি ও লেনদেন ইত্যাদিতে কেবল ফোনই নয়, শুধু গলার শব্দ শুনে পরিচিতি বা নিশ্চিতই নয়; বরং কথা শোনার পাশাপাশি একে অন্যকে দূর থেকে স্বচক্ষে দেখেও চিনতে পারছেন এবং নিশ্চিত হতে পারছেন; সেক্ষেত্রে তো আর সংশয়, সতর্কতা ও প্রতারিত হওয়ার যুক্তি ও কারণ থাকছে না। সুতরাং জেলা কমিটি বা উপকমিটির সংবাদ, সাক্ষ্যও উক্ত সব আধুনিক ও ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বনে পৌঁছানো বা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
বর্তমানে আমাদের দেশে কি রাষ্ট্রীয়ভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান প্রমুখগণ বিভিন্ন সভা-সমিতি করছেন না? রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা বা আদেশ-নিষেধ প্রদান করা হচ্ছে না? তাতে কী এমন সন্দেহ করা যায় যে, পিএম-এর আকৃতিতে অন্য কাউকে দেখানো হচ্ছে? অথবা গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের স্থলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে দেখিয়ে কেউ প্রতারণা করছে! সুতরাং চাঁদ দেখার সংবাদ বা সাক্ষ্যের ক্ষেত্রেও, শরিয়তের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সামনে রেখে আমরা এসব পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারি।
বিশেষভাবে বিবেচ্য : একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা যেতে পারে, ৬৪টি জেলায় ৬৪টি কমিটি? সুতরাং ঢাকা জেলায়ও একটি কমিটি? সেক্ষেত্রে উদাহরণ, ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মোকাররমের কমিটি আকাশ মেঘাচ্ছন্নের কারণে চাঁদ দেখতে পেলেন না। তাই বলে কি উত্তরায় মেঘের ফাঁকে কারও চাঁদ দেখা অসম্ভব? মুহাম্মদপুরে বা ডেমরায় কারো পক্ষে চাঁদ দেখা অসম্ভব? সাভার বা ধামরাইয়ে কোনো ইমাম-মুয়াজজেন চাঁদ দেখলে কি তা মিথ্যা হবে? মোটেও অসত্য হবে না। সুতরাং তেমন কাউকে ‘ফিতনা’ বলতে যাওয়া , কটাক্ষ করা বা সন্দেহের চোখে দেখা সঠিক হবে না। বরং সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে এবং প্রয়োজনে আমাদের ৬৪ জেলা কমিটিকে ৪৬০টি কমিটিতে বা আরো অধিক সংখ্যায় উন্নীত করতে হবে। আর ইতঃপূর্বে বলা হয়েছে যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষে তেমনটি বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।
লেখক : মুফতি, ইফা
কুরআনভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই কোরবানির লক্ষ্য
হ অধ্যক্ষ সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ জাফরী

জাহেলিয়াতের যুগে হজে গিয়ে লোকজন ব্যবসায় বাণিজ্য করা সম্পূর্ণ হারাম মনে করত, কিন্তু আল কুরআন হজের আরকান-আহকাম সম্পন্ন করার পর তা হালাল করেছে। কুরআন অবতীর্ণের মূল উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে এটিও একটি যে, কুরআনের বিধান অনুসারীগণ বৈধ পন্থায় নিজদেরকে মর্যাদাবান আত্মনির্ভরশীল (ঝবষভ ফবঢ়বহফবহঃ) জাতি হিসেবে গড়বে। হজ মানুষকে বৈরাগ্যবাদ ও দুনিয়া পূজাÑ এ উভয় চরমপন্থা থেকে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দেয়। কারণ ইসলামে উপার্জনের লক্ষ্য এটি নয় যে, ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক হবে এবং কেবলমাত্র তার পরিবার-পরিজন নিয়ে উপার্জিত অর্থ ভোগ করবে; বরং আল্লাহর সস্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দেশ-সমাজ থেকে সে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এবং জাতীয় দুর্যোগকালে সাধানুযায়ী সহযোগিতা করবে।
মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, সম্মিলিতভাবে তাওহিদভিত্তিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক কল্যাণ সাধনমূলক কর্মসূচি গ্রহণে হজ এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। হজকে নিছক এক আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে হজের মৌলিক শিক্ষা বাস্তবায়নে চেষ্টিত হতে হবে। হজ পালন শেষে মুসলিম দুনিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আয়োজন করে নিজ নিজ দেশের উৎপাদিত পণ্য (চৎড়ফঁপঃ) বিক্রি করে লভ্যাংশ দ্বারা সম্মিলিতভাবে একটি শক্তিশালী মিডিয়া স্থাপনপূর্বক দুশমনদের অপপ্রচারের মোকাবেলা করতে পারে। নিজ নিজ দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানপূর্বক তাদেরকে গবেষণা কর্মে নিয়োজিত এবং বিপন্ন মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পারে। এ ধরনের বহুবিধ জনকল্যাণমূলক কাজ মুসলিমদের দ্বারা সম্ভব।
পশু কোরবানির বিষয়টি হজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হজ আদায়কারীকে অবশ্যই কোরবানি দিতে হবে এবং সমগ্র বিশ্বের সামর্থ্যবান মুসলিমদেরও পশু কোরবানি করতে হবে। হজ পালনে আরকান আহকামে ভুল-ভ্রান্তি হলে বিনিময়ে রোজা পালন অথবা দান সাদাকার বিধান দেয়া হয়েছে। আবার কোরবানির পশু জোগাড় না হলে সেখানে থাকাকালে তিনটি ও বাড়িতে ফিরে সাতটি মোট দশটি রোজা পালনের বিধান দেয়া হয়েছে তাদের জন্য, যারা সেখানের অধিবাসী নয়। হাদিস থেকে জানা যায়, ফিদিয়া আদায়ের ব্যাপারে রাসূল (স:) বিধান দিয়েছেন, তিন দিন রোজা পালন অথবা ছয়জন দরিদ্র লোককে খাদ্য দান বা আল্লাহর রাস্তায় একটি ছাগল জবেহ করতে হবে।
জাহেলি যুগে একই সফরে হজ ও ওমরা আদায় গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হতো। একজন মানুষ বহু দূর থেকে কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহর ঘরে এসে হজ আদায় করতেন, আবার ওমরা পালনের ইচ্ছে করলে পুনরায় তাকে কষ্ট স্বীকার করে নিজ স্থান থেকে মক্কায় আসতে হতো। আল্লাহ তায়ালা মিকাতের সীমার অধিবাসীদের ব্যতীত দূরবর্তী লোকদের জন্য এ সুবিধা দান করলেন, তারা একই সফরে হজ ও ওমরা আদায় করতে পারবে। কিন্তু যারা মিকাতের সীমার মধ্যে বসবাস করে তারা যৌক্তিক কারণেই এ সুযোগ পাবে না, কেননা তারা ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় বায়তুল্লাহয় এসে ওমরা আদায় করতে পারে।
কোরবানিসংক্রান্ত ঘটনায় আল কুরআন পিতা-পুত্রের কথোপকথন মানব জাতির সম্মুখে যে কারণে উপস্থাপন করেছে তা উপলব্ধি করতে হবে। নবী হিসেবে হজরত ইবরাহিম (আ:) দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু তার কোনো সন্তান নেই। স্বাভাবিক কারণেই তার মধ্যে এ চিন্তার উদয় হয়েছিল, তিনি বয়সের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর পর মানবজাতিকে ইসলামী আদর্শের দিকে আহ্বান জানাবে কে? তিনি নিজের উত্তরাধিকার (ওহযবৎরঃধহপব) হিসেবে মহান আল্লাহর কাছে সন্তান চাইলেন না, চাইলেন ইসলামী আদর্শের প্রচার-প্রসার অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে। এমন সন্তান কামনা করলেন যে সন্তান সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কর্ম প্রতিরোধ করবে। হযরত ইবরাহিম (আ:)-এর আবেদন সম্পর্কে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছেÑ
‘হে আমার রব! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন।’ অতঃপর তাকে আমি পরম ধৈর্যশীল একজন পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। এরপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। অতএব দেখো তোমার কী অভিমত’; সে বললো, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশা আল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে কাত করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি।’ নিশ্চয় এটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি এক মহান জবেহের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম। আর তার জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে সুখ্যাতি রেখে দিয়েছি। ইবরাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। (সূরা আছ্ ছাফফাত-১০০-১১০)
নবী-রাসূলদের স্বপ্ন ওহির অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ:)-কে স্বপ্ন দেখানো হলো, তিনি যেন তার কলিজার ফুল অপূর্ব সুন্দর বালক হজরত ইসমাঈল (আ:)-কে জবেহ করছেন। স্বপ্নের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাকে কী আদেশ করেছেন তা তিনি স্পষ্ট উপলব্ধি করলেন। লক্ষ্য করুন তো, এর থেকে কঠিন আদেশ কী আর কিছু হতে পারে? মানুষ হিসেবে তিনি আবেদন করতে পারতেনÑ
‘হে আমার রব! তুমি আমাকে বহু পরীক্ষা করেছো, একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই আমি অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ, মাতৃভূমি ত্যাগ, নিজের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন ত্যাগ করে আমার জীবন তোমার জন্য উৎসর্গ (ঝধপৎরভরপব) করেছি। এসবের বিনিময়ে আমি তোমার কাছে আমার কলিজার ফুল বালক ইসমাইলের জীবন ভিক্ষা চাইছি। তুমি যে আদেশ আমাকে দিয়েছো, তা ফিরিয়ে নাও’। ইবরাহিম (আ:) এমন কোনো আবেদন আল্লাহর কাছে করেননি। তিনি আবেদন করতে পারতেন, ‘রাব্বুল আলামিন! আমি ইসলামী আদর্শের প্রচার-প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই সন্তান চেয়েছিলাম। এ কারণেই আমার এ সন্তানকে জীবিত রাখো, তোমার আদেশ ফিরিয়ে নাও। আল্লাহ তায়ালা! একজন পিতাকে তুমি কেমন নিষ্ঠুর নির্মম আদেশ দিলে, আমি পিতা হয়ে কিভাবে নিজ সন্তানকে জবেহ করব?’ এ ধরনের আবেদন দূরে থাক, তিনি এমন কল্পনাও মনের গহিনে স্থান দেননি। কিন্তু কেন তিনি এ ধরনের আবেদন করেননি?
কারণ, তিনি জানতেন মহান আল্লাহ যে আদেশই দেন না কেন, তার পেছনে অবশ্যই কল্যাণ নিহিত রয়েছে, সেই কল্যাণ কত দূরে তা মানুষ দেখতে পায় না। তিনি জানতেন, মানুষ একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই অনুগত বান্দা এবং বান্দা হিসেবে মহান মনিব আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করার অধিকার তার নেই। তিনি এ কথাও জানতেন, আল্লাহর ইচ্ছা ‘ভালো না মন্দ’ এ চিন্তা করাও কুফরি। এ কারণে তিনি আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীতে নিজ মনে ভিন্ন চিন্তার স্থান দেননি।
হযরত ইবরাহিম (আ:) এ বিষয়েও সজাগ ছিলেন, আল্লাহর নির্দেশের মোকাবেলায় যুক্তি উত্থাপন করাও কুফরি এবং তাঁর নির্দেশ পালনের মধ্যেই রয়েছে মানব জীবনের সার্বিক সফলতা। তিনি যখন চোখ বেঁধে নিজ সন্তানকে জবেহ করছিলেন তখন তাঁর মধ্যে এ চেতনা সক্রিয় ছিল, তিনি কাকে জবেহ করছেন। যখন তিনি চোখের বন্ধন খুলছিলেন তখন তিনি জানতেন, চোখ খুলেই তিনি দেখতে পাবেন, তার কলিজার ফুল মৃত অবস্থায় রক্তশয্যায় শায়িত। কিন্তু তিনি চোখ খুলে তার ধারণার বিপরীত দৃশ্যই অবলোকন করলেন, জবেহকৃত একটি পশু পড়ে আছে আর তার সন্তান জীবিতাবস্থায় দণ্ডায়মান।
আমরা সেই প্রিয় দর্শন বালকটির অবস্থার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আগমন করে চোখ মেলার পর বালকটির মন-মানসিকতা কিভাবে গড়া হয়েছিল। নবী পরিবারে তাঁর জন্ম, তাকে ওহিভিত্তিক শিক্ষায় এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল যে, নবী-রাসূল যে স্বপ্ন দেখে সে স্বপ্নও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি, এ কথা বালক উপলব্ধি করতেন। বালক এ কথাও অনুধাবন করতেন, আল্লাহ তায়ালার আদেশের মোকাবেলায় সব কিছু এমন কি নিজ প্রাণ উৎসর্গ করে দিতে হবে এবং এর মধ্যেই মানব জীবনের সার্বিক সফলতা নিহিত। বালক এ কথাও উপলব্ধি করতেন, মহান আল্লাহর আদেশের মোকাবেলায় কোনোরূপ প্রশ্ন তোলা অপরাধ। আল্লাহর আদেশ শোনামাত্র মাথানত করতে হবে। আর ঠিক এ কারণেই বালক ইসমাইল (আ:)-কে যখন তার পিতা দ্বিধা না করে স্বপ্নের কথা জানালেন তখন বালক তার পিতাকে জানালেন, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশা আল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ (সূরা আছ্ ছাফফাত-১০২)
অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ আপনি বাস্তবায়ন করুন, আমি ভয়ে পালাব না, প্রাণ রক্ষায় চেষ্টিত হবো না, যন্ত্রণা-কাতর শব্দও করব না। আমি এ প্রশ্নও করব না, আপনি কেন আমাকে হত্যা করবেন। অথবা এ কথাও বলব না, ঘুমের রাজ্যে দেখা স্বপ্নের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আপনি নিজ সন্তানকে কেন জবেহ করবেন?
প্রতি বছরই সচ্ছল মুসলিমগণ পশু কোরবানি করে থাকে, তারা কি নিজ সন্তানদের ঐ প্রশিক্ষণ দেন, যে প্রশিক্ষণ ইবরাহিম (আ:) তার সন্তানকে দিয়েছিলেন? যদি প্রশিক্ষণ না দেয়া হয় তাহলে কোরবানির নামে শুধু গোশতই খাওয়া হবে, ভিন্ন কোনো লাভ হবে কি না তা কোরবানির চেতনা থেকে জানা যায় না। কোরবানি সম্পর্কিত উক্ত ঘটনা থেকে যে সব বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হচ্ছে, মুসলিম হতে হলে কুরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশ প্রশ্নাতীতভাবে (ডরঃযড়ঁঃ য়ঁবংঃরড়হ) অনুসরণ করতে হবে। কেননা আল্লাহর আদেশ অনুসরণ করলে তা সর্বাবস্থায় কল্যাণই বহন করে।
কোরবানির ঘটনার প্রতি দৃষ্টি দিন, আল্লাহ তায়ালার বিধান মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে পার্থিব লাভ-ক্ষতি, মায়া-মমতা, কামনা-বাসনা, কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা বা আকর্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা যাবে না এবং এ সংক্রান্ত সামান্যতম চিন্তাও মনে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তাঁর আদেশের মোকাবেলায় পিতা-পুত্রের ভূমিকা কুরআন থেকে শুনুন, ‘অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে কাত করে শুইয়ে দিলো।’ (সূরা ছাফফাত-১০৩)
কুরআনের উক্ত আয়াতে দ্বিবচনে ‘আছলামা’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে, পিতা-পুত্র দু’জনই মুসলিম হলো। প্রশ্ন ওঠে, কোরবানির ঐ ঘটনার পূর্বে তারা কি মুসলিম ছিলেন না? হজরত ইবরাহিম (আ:) ছিলেন মহান আল্লাহর একজন মর্যাদাবান নবী, তাহলে তাকে পুনরায় কেনো মুসলিম হতে হবে? ইসমাইল (আ:) যথাযথ বয়সে নবুওয়ত লাভ করেছিলেন, কিন্তু কেন তাকেও বালক বয়সে মুসলিম হতে হলো? প্রকৃত বিষয় হলো, ‘মুসলিম’ শব্দটির অর্থ আমাদেরকে অনুধাবন করতে হবে। মুসলিম শব্দের অর্থ (ঈড়সঢ়ষবঃব ংঁৎৎবহফবৎ) আত্মসমর্পণ করা তথা মহান আল্লাহর নির্দেশ অকুণ্ঠিত চিত্তে অনুসরণ করা।
আল কুরআনের উক্ত আয়াতে ‘আছলামা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে তারা দু’জনই আল্লাহর আদেশ অনুসরণে তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হলো (ইড়ঃয ংঁনসরঃঃবফ ঃযবরৎ রিষষং)। পিতা প্রস্তুত হলো কলিজার টুকরা সন্তানকে জবেহ করতে আর ছেলে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বয়ং জবেহ হতে রাজি হলো। প্রতি বছর কোরবানি পর্ব আসে আর যায়, যে উদ্দেশ্যে কোরবানি সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি মুসলিম উম্মাহ বাস্তবায়ন করে? কোরবানিদাতা কি আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে কুরআনভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজকে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছে অথবা নিজ সন্তানদেরকে প্রস্তুত করেছে? যদি করে তাহলে হাদিসে বর্ণিত পশু কোরবানির সওয়াব ইনশা আল্লাহ আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement