১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নারী নির্যাতন রোধে করণীয়

-

দেশে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতি যে ব্যাপকতা পেয়েছে তা উদ্বেগজনক। যে দেশের জনগণ, সরকার ও প্রশাসন, সুশাসন, ন্যায়বিচার, সততা, যোগ্যতা, মানবতা, নিরপেক্ষতা এবং ঈমান, আমল ও চরিত্রে অনুসরণীয় তারাই আদর্শ জাতি। তাদের পক্ষেই সম্ভব, জাতিকে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত করা। সংখ্যালঘুরা আদর্শ জাতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রিয় নবী সা:-এর মাদানিজীবন তার প্রমাণ। ঈমান, আত্মমর্যাদাবোধ, দেশপ্রেম, সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান ও জাতীর ঐক্যই হলো জাতীয় অস্তিত্বের ভিত্তি। মানবতাবোধ, নৈতিকতা, সম্প্রীতিপূর্ণ সমাজ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন পক্ষপাতমুক্ত ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনই হলো শান্তি ও উন্নতির চাবিকাঠি। যা ইসলাম ছাড়া আর কোনো মতবাদ দিতে পারে না। কুরআনি শিক্ষার মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব, তাই সর্বস্তরে কুরআনি শিক্ষা চালুর ব্যবস্থা করা সব মুসলমানের দায়িত্ব।
নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে আলেম ওলামাদের দায়িত্ব : জুমার নামাজ ও পবিত্র রমজান মাসকে কাজে লাগিয়ে আলেম ওলামারা জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা মসজিদের খুতবায়, ওয়াজে, বয়ানে এবং মাহফিলে মিলাদে এসব ব্যাপারে সরকার ও জনগণকে কুরআনিক পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতে পারেন। এভাবে তারা নারী নির্যাতন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা ইসলামসম্মত কাজে সরকারকে সহযোগিতা করা এবং ইসলামবিরোধী কাজের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করা তাদের ঈমানি দায়িত্ব। তাদের প্রতি এটাই আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, তোমরা ভালো এবং তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা করো, মন্দ এবং পাপের কাজে সহযোগিতা করিও না। আল কুরআন। আল্লাহর নবী সা: বলেন, তোমরা অন্যায় দেখলে হাতে বাধা দাও, বাধা দিতে না পারলে মুখে প্রতিবাদ করো। (আল হাদিস)
নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে অভিভাবকদের দায়িত্ব : নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে অভিভাবকদের ভূমিকা শিক্ষকদের চেয়ে বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ। জাতির ভিত্তি যে শিশু-কিশোর তাদের আসল পরিচালক ও অভিভাবক হচ্ছেন মা-বাবা। ছেলেমেয়েরা পারিবারিক পরিবেশে মা-বাবা থেকে যা শুনবে, যা শিখবে, তাদের সারা জীবন পথের দিশা দেবে সেই শিক্ষা। মা-বাবা এবং অভিভাবকসমাজ তাদের অধীনস্থদের যে স্বভাব চরিত্রে, যে ধ্যান ধারণায় গড়ে তোলবেন, পুরা জাতি সেভাবে গড়ে উঠবে। তাই ছেলেমেয়েদের নীতি-নৈতিকতা, চরিত্র ও পর্দা নেকাব শিক্ষা দেয়া অভিভাবকদের দায়িত্ব। আল্লাহর নবী সা: বলেন, প্রতিটি শিশু সন্তানই ইসলামী প্রকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, মা-বাবাই তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান, মজুসি ও মুশরেক বানায়Ñ আল হাদিস। বেপর্দা উলঙ্গপনা ও অবাধ চলাফেরা যা যুবক ও তরুণদের নারী নির্যাতনের দিকে ঠেলে দেয় তার হাত থেকে এবং দুর্নীতির মনোভাব সৃষ্টিকারী কুস্বভাব থেকে ছেলেমেয়েকে রক্ষা করা অভিভাবকের প্রধান দায়িত্ব। হজরত লোকমান আ: তার ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘হে আমার বৎস, তুমি আল্লাহর সাথে শরিক করো না। নামাজ কায়েম করো এবং সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করো। এভাবে দায়িত্ব পালন করতে যদি বাধা আসে, তখন ধৈর্য ধারণ করবে। মানুষকে অবজ্ঞা করবে না। দম্ভ ভরে জমিনে হাঁটবে না। পথ চলতে মাধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। কণ্ঠস্বর নিচু রাখবে। (আল কুরআন)
হজরত লোকমান আ:-এর মতো পরিবার গঠনে অভিভাবকেরা সক্রিয় না হলে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠন সম্ভব নয়।
নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে শিক্ষকদের দায়িত্ব : নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে শিক্ষকের দায়িত্ব খুবই ব্যাপক ও গভীর। শিক্ষকের প্রশিক্ষণেই গড়ে ওঠে জাতির এক-একটি স্তর। এ জন্যই আল্লাহর নবী সা: নারী-পুরুষ সবার জ্ঞান অর্জন ফরজ করেছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা প্রিয় নবী সা: -এর প্রতিনিধি। আল্লাহর নবী সা: বলেন, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। শিক্ষককে চেষ্টা করতে হবে প্রিয় নবী সা: -এর শিক্ষা দর্শনের ভিত্তিতে উন্নত নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রসম্পন্ন একটি জাতি গঠনের উন্নত কাঁচামাল সরবরাহ করার। জাতিকে দুর্নীতিমুক্ত চরিত্রবান ও উপযুক্ত মানুষ গঠন করে দেয়া শিক্ষক সমাজেরই কাজ। প্রিয় নবী সা:-এর চরিত্র ও জাতি গঠনের সাথে সম্পৃক্ত, প্রথম কাজটি হচ্ছে খোদায়ী নিদর্শন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছেÑ মানুষকে কিতাবি তথা পুঁথিগত জ্ঞান দান করা। তৃতীয়টি হচ্ছেÑ বিজ্ঞান বা হেকমত শিক্ষা দেয়া। অন্যটি হচ্ছেÑ তাদের চিন্তা, চরিত্র ও কর্মের দিক থেকে দুর্নীতিমুক্ত বিশুদ্ধ করা। এই হলো শিক্ষার মূল কাজ।
আল্লাহর নবী শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালিকে এ কারণেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ইসলামিক ও কুরআনিক জ্ঞান ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত ও চরিত্রবান জাতি গঠন অসম্ভব। প্রিয় নবী সা:-এর হাদিস থেকে জানা যায়। কেয়ামতের দিন শিক্ষক ও জ্ঞানীদেরকে তাদের জ্ঞানের ভিত্তিতে কি দায়িত্ব তারা পালন করেছেন, তার যথাযথ উত্তর দেয়া ছাড়া এক কদমও নড়তে দেয়া হবে না।
নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে সরকারের দায়িত্ব : সরকারের ওপরই নির্ভর করে জাতির উন্নতি, সুখ ও শান্তি। জাতিকে নারী নির্যতান ও দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তোলাও সরকারের দায়িত্ব। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা সংস্কৃতিকে, রাজনীতি ও প্রশাসনকে ইসলামিক ধারায় গঠন ও পরিচালনা করা। সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় কুরআনি শিক্ষা চালু করা। এ কুরআনই মানুষকে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির পথ দেখাবে। আল-কুরআন। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বন্ধ করাও সরকারের দায়িত্ব। এখন কিন্তু শিক্ষা-সংস্কৃতি-মিডিয়া ঈমান ও চরিত্র বিনাশী। ফলে ছাত্রছাত্রী ও যুবসমাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও নারী নির্যাতনকারী হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি চরিত্র গঠন, ঈমান ও নৈতিকতার ব্যাপারে সচেতন না হয়, সরকার যদি আল্লাহ রাসূলে সা:-এর কথা বাদ দিয়ে অন্যদের পরামর্শ মতো কাজ করে তাহলে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাই দুনিয়া ও আখিরাতের উভয় জগতে সরকারকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাহিনীর পর বাহিনী লালন করা যাবে কিন্তু জাতিকে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না। এই জন্য প্রাচীন প্রবাদ বাক্যে বলা হয়েছে ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়।’ এই কষ্ট থেকে নিজেকে এবং জাতিকে বাঁচানোর জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আল্লাহর গজব থেকে বাঁচা যাবে। দুর্নীতি নির্মূল হবে। নারী নির্যাতন বন্ধ হবে, জাতিও সুখ পাবে।
নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত জাতি গঠনে সম্মিলিত দায়িত্ব : জাতি এবং যারা জাতির ভবিষ্যৎ তাদেরসহ সবারই নারী নির্যাতন, দুর্নীতি ও অন্যায় অশ্লীলতা এবং অনৈতিক কাজ থেকে মুক্ত থাকা ফরজ। এর জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা-সুসম্পর্ক এবং চিন্তার ঐক্য। নারী নির্যাতন ও দুর্নীতি কেন বন্ধ হচ্ছে না, তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ চিহ্নিত করে তার নিরসনের জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সবার ঈমানি দায়িত্ব। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব সব চেয়ে বেশি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জান্নাতি হিসেবে গড়ে তোলা এবং জাহান্নামি হওয়া থেকে রক্ষা করাও তাদের কাজ। আল্লাহ বলেন, তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে বাঁচাও, তোমাদের অধীনস্থদেরও বাঁচাও, আল কুরআন। এ ব্যাপারে নামাজ হলো বড় হাতিয়ার। আল্লাহর নবী সা: বলেন, তোমরা তোমাদের ছেলেদের তাদের বয়স সাত বছর হলে, নামাজ পড়ার আদেশ দাও। ১০ বছর বয়স হলে, নামাজের জন্য (প্রয়োজনে) মারো। তাদের বিছানা পৃথক করে দাও। (আল হাদিস)। আল্লাহ বলেন, নামাজ মানুষকে অন্যায়, অশ্লীল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে। সরকারসহ সবার জন্য ফরজ, জাতিকে এবং ছেলেমেয়েদের নামাজি বানানোর চেষ্টা করা। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব সব চেয়ে বেশি।
কেয়ামতের দিন আমাদের সন্তানরা তাদের অনৈতিক কাজের জন্য নেতা, কর্মকর্তা এবং শিক্ষক-অভিভাবকদের দায়ী করে আল্লাহর দরবারে বিচার দেবে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলবে, হে আমাদের রব আমরা আমাদের বড় জনদের, নেতাদের (কর্মকর্তাদের শিক্ষকদের) কথামতো চলতাম, তারাই আমাদেরকে গুমরাহ (নষ্ট) করেছে। হে আমাদের রব তাদেরকে দিগুণ শাস্তি দাও এবং বড় ধরনের অভিশাপে অভিশপ্ত করো।’ (সূরায়ে আহজাব : ৬৮)। অন্য আয়াতে আছে, ‘তাদের এনে দাও আমরা তাদের আমাদের পায়ের নিচে দেই।’ (সূরায়ে হা-মীম, সিজদা : ২৯)।
শেষ কথা : আজ দেশে ধর্ষণ, অপহরণ, নারী নির্যাতন দুর্নীতিসহ যত অপকর্ম হচ্ছে, এর জন্য কুশিক্ষাই দায়ী। জাতিকে বাঁচাতে হলে ইসলামী নৈতিক শিক্ষা ও নামাজ প্রতিষ্ঠার পথে আসা ছাড়া উপায় নেই। আল্লাহর নবী সা: বলেন, তোমরা যদি তোমাদের নবী সা:-এর (নামাজ, ইসলামী শিক্ষা) সুন্নত ছেড়ে দাও, পথ হারা হয়ে যাবে। আল হাদিস। জাতিকে নারী নির্যাতন ও দুর্নীতিমুক্ত করার কাজে সরকার এগিয়ে এলে তাকে সহযোগিতা করা সবার দায়িত্ব।
আল্লাহ বলেন, আমি তাদের ক্ষমতা দিলে তারা নামাজ কায়েম করে। জাকাত আদায় করে। ভালো কাজের আদেশ করে, খারাপ কাজ বন্ধ করে (আল কুরআন, সূরা হজ)। এখন ক্ষমতা পাওয়া কিছু চরিত্রহীন লোক কুরআন বর্ণিত সেই সব ভালো কাজ করেই না, উল্টা খারাপ কাজ করে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াও সরকারের দায়িত্ব।
লেখক : খতিব


আরো সংবাদ



premium cement