২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কুরআন মানুষের জন্য অভ্রান্ত পথনির্দেশনা

-


আমরা যদি আত্মসমালোচনাপূর্বক নিজদের প্রশ্ন করি, প্রকৃত অর্থেই আমাদের মূল্যবোধ, শিষ্টাচার-সৌজন্য, আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা ও আদর্শিক দিক দিয়ে সজাগ-সচেতনভাবে পবিত্র রমজান মাসকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাত অর্জনের লক্ষ্যে আমরা কি স্বাগত জানিয়েছি?
কার্যত এ মাসকে আমরা স্বাগত জানাইনি। যদি জানাতে পারতাম তাহলে এ মাসের আদর্শিক পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বাস্তব জীবনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন হতো।
পবিত্র এ মাস আগমনের আগে প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে আমরা অনাকাক্সিক্ষত যেসব খবর পাঠ করি এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখি। এ মাসে তার কোনো ব্যতিক্রম দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না; বরং অপরাধ জগৎ মুখব্যাদান করে সমগ্র জাতিকে গ্রাস করতে উদ্যত। এর অর্থ হচ্ছে, রমজান মাসকে আমরা কেবল মৌখিকভাবে স্বাগত জানিয়েছি, কিন্তু এর আদর্শকে আন্তরিকভাবে ধারণ করিনি। যদি প্রশ্ন ওঠে, এ মাসকে আমরা কিভাবে স্বাগত জানাব? জবাবে বলা যেতে পারে, এ মাসকে স্বাগত জানাতে হবে আমাদের কর্ম ও জীবনাচরণের মাধ্যমেÑ শুধু মৌখিকভাবে নয়।
বছরের ১২টি মাসের মধ্যে রমজান মাসকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ জন্য যে, এ মাসেই মহান আল্লাহ স্থায়ীভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য পরিপূর্ণ জীবনদর্শন ও জীবনবিধান আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। এ কিতাব সম্মান-মর্যাদার দিক থেকে অতুলনীয়। এর প্রত্যেকটি শব্দ মহান আল্লাহর বাণী, যার মধ্যে কোনো প্রকার সন্দেহ ও বক্রতার সামান্যতম অবকাশ নেই। পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতি ও জিন সম্প্রদায় একতাবদ্ধ হয়ে চেষ্টা-সাধনা করলেও আল কুরআনের ক্ষুদ্রতম একটি আয়াতের অনুরূপ আয়াতও রচনায় সক্ষম হবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি আমার বান্দার ওপর যা নাজিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাকো, তবে তোমরা তার মতো একটি সূরা (বানিয়ে) আনো।’ (সূরা আল বাকারা-২৩)। ‘তারা বলে, সে এটা রচনা করেছে? তুমি বলো, তাহলে তোমরা এর অনুরূপ দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে আসো এবং আল্লাহ ব্যতীত যাকে পারো ডেকে আনো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা হুদ-১৩)। ‘তুমি বলো, যদি মানুষ ও জিন এ কুরআনের অনুরূপ উপস্থিত করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ উপস্থিত করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৮৮)। ‘এ কুরআন তো এমন নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা রচনা করতে পারবে।’ (সূরা ইউনুস-৩৭)।
রমজান কারিমকে আমরা কিভাবে স্বাগত জানাব, বাস্তবতা হলো তা আমরা জানি না। যিনি মর্যাদাসম্পন্ন এ মাস দান করেছেন তিনিই এর গুরুত্ব, মর্যাদা এবং এ মাসকে কিভাবে স্বাগত জানাতে হবে তা জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘রমজান মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন। মানুষের জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট দলিল ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।’ (সূরা আল বাকারা-১৮৫)।
কুরআন কেন নাজিল করা হয়েছে? যদি এ প্রশ্ন ওঠে তাহলে অধ্যয়নকারী দেখতে পাবে, ওই আয়াতের পরবর্তী অংশেই কুরআন নাজিলকারী স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘মানবজাতির জন্য এটি অভ্রান্ত পথনির্দেশনা এবং পথনির্দেশনার সুস্পষ্ট দলিল ও এমন একটি সংবিধান, যা সত্য-মিথ্যা এবং কল্যাণ-অকল্যাণের পার্থক্য নির্ণয়কারী।’
এ কুরআন মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক, পথনির্দেশনা তথা (Guide book) গাইডবুক। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য এটি পথনির্দেশক। আল কুরআন যে পথনির্দেশনা দান করে, তা স্থান-কালের সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ নয়। মহাকালের বিশেষ কোনো অধ্যায়ের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়Ñ এটি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বকালের সর্বযুগের সব মানুষের জন্য প্রযোজ্য। কেননা এ কিতাবের আবেদন চিরন্তন (Of long standing, ever fresh), যা কখনোই পুরনো বা জীর্ণ হবে না, এর বিস্ময়কারিতার ইতি কখনোই ঘটবে না। কুরআন হচ্ছে অভ্রান্ত পথের দিকনির্দেশনার মশাল (Torch) এবং এ কিতাব জ্ঞান-বিজ্ঞানের কূলকিনারাহীন অগাধ এক জলধি।
আল কুরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বপ্রকার শাখা-প্রশাখার অফুরন্ত তত্ত্ব ও অনায়ত্ব অসংখ্য দিক-দিগন্ত বিদ্যমান। মানবীয় অনুসন্ধিৎসা অফুরন্ত (Inexhaustible) এই জ্ঞানসমুদ্র থেকে নিত্যনতুন তত্ত্ব উদ্ধারে সক্ষম। আর প্রতিটি অনুসন্ধানেই প্রত্যেক যুগের সূক্ষ্ম চিন্তাবিদ ও গবেষকগণ মানবজীবনের জন্য যুগোপযোগী আইনবিধান ও তত্ত্ব উদ্ধারে সক্ষম হবে, যদি তারা প্রতিটি পর্যায়ে অভ্রান্ত পথে দৃঢ় থাকে।
তিরমিজি হাদিস গ্রন্থের ২৯০৬ নম্বর হাদিসটির সারমর্মানুযায়ী, ‘এ কুরআন দিয়ে যে ব্যক্তি কথা বলবে সে সত্য কথা বলবে। যে এ কিতাবের দিকনির্দেশনা অনুসারে কর্ম সম্পাদন করবে, সে উভয় জগতে প্রতিদান লাভ করবে। যে এর সাহায্যে বিচার-মীমাংসা করবে, সে ন্যায়বিচার করবে। যে এ কিতাবের প্রতি আহ্বান জানাবে সে সহজ-সরল পথের দিকে আহ্বান জানাবে। কিয়ামত পর্যন্ত এ কিতাব অপরিবর্তিত থাকবে, এর ক্ষুদ্রতম একটি অংশেও পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটবে না।’
যদি প্রশ্ন ওঠে, কুরআন মানবজাতিকে কোন কোন বিষয়ে পথনির্দেশনা দেয়? এর জবাব হলো, এ কিতাব মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবনের যাবতীয় দিক-বিভাগ পর্যন্ত সব কর্ম সম্পাদনে অভ্রান্ত (Accurate) পথনির্দেশনা দান করে। মানুষের সর্বপ্রকার চিন্তা-চেতনা, আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত, মূল্যবোধ, পারস্পরিক সম্পর্ক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-সন্ধি, বিয়ে-তালাক, সম্পদ বণ্টন, উত্তরাধিকার নির্ধারণ, বন্ধুত্ব-শত্রুতা, গবেষণা, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, বস্তুনিচয়ের ব্যবহার তথা মানবজীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সব দিকেই কুরআন পথনির্দেশনা দান করে।
মানবজাতির প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই, যা এ কুরআনে বর্ণিত হয়নি। প্রত্যেক বিষয় ও বস্তুনিচয়ের বর্ণনা রয়েছে এ কুরআনে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি তোমার ওপর কিতাব অবতীর্ণ করেছি প্রত্যেক বিষয়ের বর্ণনা সংবলিত। (সূরা আন্ নাহ্ল-৮৯)। আমি কিতাবে (সব কিছু বর্ণনায়) কোনো ত্রুটি করিনি। (সূরা আনয়াম-৩৮)। এটা (কুরআন) কোনো কল্পিত কাহিনী নয়; বরং তাদের পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী এবং প্রত্যেক বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ। (সূরা ইউসুফ-১১১)।
সুতরাং যে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তাঁরই পক্ষ থেকে এ কুরআন মানবমণ্ডলীর জন্য অভ্রান্ত পথনির্দেশনা। এ জন্যই রমজান মাসের মূল পয়গাম হলোÑ
(১) কুরআন পড়া। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকেও শিক্ষা দেয়। (The most superior among you are those who learn the Qur'an and teach it.)’ (বুখারি হা/৫০২৮)। ‘কুরআন পাঠকারী, সংরক্ষণকারী (মুখস্থকারী) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে কুরআন পাঠ করে এবং সে তা সংরক্ষণ (মুখস্থও) করতে থাকে, যদিও তার জন্য তা খুবই কষ্টকর, তবুও সে পাঠ করায় চেষ্টিত, সে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত হবে।’ (বুখারি হা/৪৯৩৭)। সুতরাং সবার জন্য কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) কুরআন (Recitation) তিলাওয়াত করতে হবে। তিলাওয়াত খণ্ডকালীন নয়, কর্মব্যস্ততার মাঝে ক্ষণকাল অবসর পেলে কুরআনের দু-একটি আয়াত প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা তিলাওয়াত করতে হবে। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘(ঈর্ষা করা হারাম,) কিন্তু কেবল দু’জন লোকের প্রতি ঈর্ষা করা যায়। একজন সে ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ কুরআন (তিলাওয়াত) শিখিয়েছেন, আর সে তা রাত-দিন (সকাল-সন্ধ্যা) তিলাওয়াত করে। অপরজন সে ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধনসম্পদ দান করেছেন আর সে রাত-দিন তা থেকে (আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মানবকল্যাণে) ব্যয় করে।’ (বুখারি হা/৭৫২৯)। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘তোমাদের ঘরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করো না, Do not make your houses as graveyards..’ (মুসলিম হা/৭৮০)। যারা উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন মোবাইল ব্যবহার করেন তাদের জন্য কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন খুবই সহজ।
(৩) কুরআন অর্থসহ বুঝে পড়তে হবে তথা (Study) অধ্যয়ন করতে হবে। নবী করিম সা:কে কুরআন বুঝিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। ‘অতঃপর তার বর্ণনার (কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের) দায়িত্ব আমারই।’ (সূরা আল কিয়ামাহ-১৯)। সাহাবায়ে কেরাম আরবিভাষী হলেও তাদের সবার পক্ষে কুরআন অনুধাবন সম্ভব ছিল না। অধ্যয়নকালে যখনই তারা উপলব্ধিকরণে জটিলতা অনুভব করতেন, তখনই তারা রাসূল সা:-এর কাছ থেকে জেনে নিতেন। তাঁর অবর্তমানে লোকজন কুরআন-অভিজ্ঞ সাহাবায়ে কেরামের সাহায্য গ্রহণ করতেন। কুরআন অনুধাবনে জটিলতা অনুভব করলে শিরক-বিদয়াতমুক্ত হক্কানি উলামায়ে কেরামের সাহায্য গ্রহণ করতে হবে। স্বয়ং কুরআন তাগিদ দিয়ে বলেছে, ‘জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা না জানো।’ (সূরা আন্ নাহ্ল-৪৩)। ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ (সূরা আয্ যুমার-৯)।
(৪) কুরআন নিয়ে গবেষণা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে (Think deeply) গভীর চিন্তা-গবেষণা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’ (সূরা মুহাম্মাদ-২৪)। ‘আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ যেন উপদেশ (শিক্ষা) গ্রহণ করতে পারে।’ (সূরা ছোয়াদ-২৯)। ‘তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না (Consider the Qur`an carefully)? আর যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষ থেকে (নাজিল) হতো, তাহলে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য (Contradiction) দেখতে পেত।’ (সূরা আন্ নিসা-৮২)। কুরআন নিয়ে গবেষণা মুসলিম গবেষকদের আবশ্যিক দায়িত্ব। এতে আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও পৃথিবীর বস্তুনিচয় সম্পর্কিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব সূত্র উল্লেখ রয়েছে, তা দ্বারা মানবজাতিকে প্রগতির শীর্ষে পৌঁছে দিতে হবে। এ কুরআনকে অনুধাবনপূর্বক শিক্ষা গ্রহণ করা জ্ঞানীদের জন্য আল্লাহ তায়ালা সহজ করেছেন, ‘আর আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি (Easy to understand) উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব, কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?’ (সূরা আল ক্বামার-৪০)।
(৫) কুরআনের দিকনির্দেশনা বাস্তব জীবনে অনুসরণ এবং রূপায়ণ (Implementation) করতে হবে; অর্থাৎ কুরআনের ওপর আমল করতে হবে। এ কিতাব যা আদেশ দিয়েছে তা কথা ও কর্ম দ্বারা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর যা নিষিদ্ধ করেছে, যেসব কথা-কর্ম থেকে বিরত থাকতে বলেছে, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। পার্থিব জীবন পরিক্রমায় মহান আল্লাহ যে সীমা নির্ধারণ করেছেন, তা অতিক্রম করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা (Transgress) লঙ্ঘন করো না। আর যে আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই যালিম।’ (সূরা আল বাকারা-২২৯)।
(৬) কুরআনের শিক্ষা (Teachings of the holy Qur`an) তথা দিকনির্দেশনা জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে বিস্তারের জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মপদ্ধতি (Method of work) প্রণয়ন করতে হবে। এটি মুসলিম উম্মাহর আবশ্যিক দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও এবং রাসূল সাক্ষী হয় তোমাদের ওপর।’ (সূরা আল বাকারা-১৪৩)।
প্রত্যেক মুসলিমকে চলমান কুরআনে পরিণত হতে হবে, তার সামগ্রিক আচার-আচরণ, ব্যবহার, কথা-কর্ম সব কিছুর মধ্য দিয়ে কুরআনের শিক্ষা বাস্তবে পরিস্ফুটিত হবে। প্রথম দর্শনে তাকে দেখলেই দর্শকের কাছে যেন অনুভূত হয়, ‘মানুষটি আল কুআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।’ কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির সম্মুখে আল কুরআন ওই আয়াতে মুসলিম উম্মাহকে ‘উম্মতে ওয়াসাতা’ বিশেষণে ভূষিত করেছে। আয়াতে ব্যবহৃত ‘উম্মতে ওয়াসাতা’ শব্দদ্বয়ের ইংরেজি অনুবাদকগণ বিভিন্ন শব্দে অনুবাদ করেছেন, Midmost nation. A temperate people. The best nation. To be a community of the middle way. A community justly balanced. True Muslims- real believers of Islamic Monotheism, true followers of Prophet Muhammad SAW and his Sunnah. A moderate community. A community of the Golden Mean. A middle nation. An Ummat justly balanced.’’
‘উম্মতে ওয়াসাতা’ শব্দদ্বয়ের যিনি যে অর্থেই অনুবাদ করুন না কেন, এ শব্দদ্বয় দ্বারা প্রকৃত অর্থে ওই মুসলিম উম্মাহকে বুঝায়, আল্লাহর রাসূল সা: আল কুরআনের আলোকে যে মুসলিম উম্মাহ গড়েছিলেন। তারা পৃথিবীর যে ভূখণ্ডেই পদার্পণ করেছেন, সেই ভূখণ্ডের অধিবাসীগণ অবাক বিস্ময়ে ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর সর্বোত্তম স্বভাব-চরিত্রবিশিষ্ট ন্যায়পরায়ণতার জীবন্ত ছবি’ দেখেছে। উম্মতে ওয়াসাতা হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠী, যাদের সার্বিক জীবনধারা প্রমাণ করবে যে, কেবল এই মানুষগুলোর মাধ্যমেই সমগ্র পৃথিবীতে কল্যাণকর সমীরণ প্রবাহিত হবে, শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানবতা ইনসাফ পাবে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে।
এরা কথা ও বাস্তব কর্মের দ্বারা কুরআন-সুন্নাহর বাস্তবতা মানবজাতির সম্মুখে তুলে ধরবে। মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য যে জীবনাদর্শ পছন্দ ও মনোনীত করেছেন, সে আদর্শের সার্বিক সৌন্দর্য প্রতিভাত হবে মুসলিমদের সামগ্রিক জীবনধারায়। এর অর্থ হলো, মুসলিমরা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির কাছে বাস্তব সাক্ষী হবে, আল্লাহর মনোনীত জীবনাদর্শই মানবজাতির জন্য কল্যাণকর। মুসলিমগণ যদি এ সাক্ষী দেয়, তাহলে নবী করিম সা:ও আদালতে আখেরাতে সাক্ষ্য দেবেন, তিনি যে দায়িত্ব তাঁর উম্মাতের ওপর অর্পণ করেছিলেন, তারা তা যথার্থই পালন করেছে।
উপরি উক্ত ছয়টি কাজ করতে পারলে রমজান মাস এবং এ মাসে অবতীর্ণ কুরআনের প্রতি প্রকৃত অর্থে সম্মান-মর্যাদা প্রদর্শন করা হলো। একই সাথে কুরআনের যে দাবি আমাদের প্রতি, তার হকও আমরা আদায়ে চেষ্টিত হয়েছিলাম। আর চেষ্টাও যদি না করি, তাহলে এ মাসকে স্বাগত জানানো কেবল লৌকিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল।
অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে রাসূল (সা:) আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে মামলা দায়ের করবেন, ‘আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য করে রেখেছে (O my Lord! Verily, my people deserted this Qur`an (neither listened to it, nor acted on its laws and teachings)।’ (সূরা আল ফুরক্বান-৩০)। এ অবস্থার উদ্ভব হলে আমাদের পারলৌকিক জীবনে মুক্তির কোনো আশা কি অবশিষ্ট থাকবে?
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ

 


আরো সংবাদ



premium cement