২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আমেনার রমজানের আয়োজন

-

আমেনা আজ অনেক ক্লান্ত। একে তো রমজান মাস তার ওপর কয়েক দিন টানা রান্না করতে হয়েছে তাকে। খুব কাছের কয়েকজনকে ইফতারির দাওয়াত করেছিল আমেনার পরিবার। শিশু ও বড়দের মিলিয়ে ১৫ জন মেহমানের আয়োজন। আর তাতেই আমেনাকে টানা তিন দিন রান্না করতে হয়েছিল।
প্রবাসের জিন্দেগি। কাজের বুয়া নেই, শিশুরাও এসব কাজে এখনো সাহায্য করতে শিখেনি। বদরুল ফুল টাইম চাকরি করাতে তেমন হাত লাগাতে পারেনি। বাজার করা থেকে শুরু করে রান্নার বেশির ভাগ কাজ আমেনাকেই সামলাতে হয়েছে, তাতেই তার এ হাল হয়েছে।
ছোটবেলার কথা আমেনার এখনো পরিষ্কার মনে পড়ে। বাসায় কাউকে দাওয়াত না করলেও আপনজন বিনা নোটিশে হাজির হতো। যা নিজেরা খেত, তাই মেহমানকে পরিবেশন করা হতো। অথচ আজ যুগ কতই না বদলে গেছে। কাউকে দাওয়াত না করলে এখন আর কেউ বাসায় আসে না। আর দাওয়াত করলেও দুই এক আইটেম নয় কমপক্ষে গোটা দশেক আইটেম তো সামনে দিতেই হবে, তা না হলে ইজ্জত থাকবে না। বিষয়টা যে শুধু আমেনার বেলায় ঘটছে, তা নয়। এই তো সেদিন পাশের স্ট্রিটের এক ভাবী দাওয়াত করেছিল আমেনাকে। টেবিলে কমপক্ষে বিশ আইটেম সাজানো ছিল। ভর্তা থেকে শুরু করে কি না ছিল। মাছ ভাঁজা, গরুর গোশতের কুপ্তা, রেজালা, পাখির গোশতের সুপ, নানা ধরনের সবজি, পোলাও, ভাত, খিচুড়ি সবই ছিল। খাবার শেষে মিষ্টি ছিল কম করে হলেও সাত ধরনের। ইফতার খাবার পর পেটে সামান্য কিছু দেয়ার অবস্থা না থাকায় রাতের খাবারের সময় ঠিক করা হয় তারাবির নামাজের বেশ কিছুক্ষণ পর। পাশের স্ট্রিটের ভাবীর আয়োজনের তুলনায় আমেনার আয়োজন একেবারেই সাদামাটা।
রান্না করতে গিয়ে আমেনার বারবার একটি বিষয় মনে পড়ছিল। তা হলো, সে যা করছে তা কতটা ইসলাম বা শরিয়াসম্মত। ইসলাম তো বলে কম খেতে, কম অপচয় করতে। রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবারা অনেক সময় ক্ষুদার যন্ত্রণায় পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন। রমজানে একটি খেজুর দিয়ে ইফতার করা ছিল তাদের জন্য অতি সাধারণ ব্যাপার। অথচ আজ আমেনা কী করছে?
এখানে হয়তো কথা আসতে পারে আল্লাহ তায়ালা তাকে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই খাচ্ছে ও খাওয়াচ্ছে। কিন্তু রাসূল সা:-এর উম্মতের অনেকেই তো আজ না খেয়ে আছেন। কেউ শুধু পানি দিয়ে ইফতার করছেন। সাহরিতে কেউ কেউ খেতেই পায় না। না খেয়ে রোজা রাখছেন কতশত মানুষ। তাদের জন্য আমেনার কি কিছুই করার নেই? পরকালে আল্লাহ তায়ালা যদি তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, তবে সে কী উত্তর দেবে। শুধু যে রান্না বা অতিরিক্ত খাবারের পেছনে ব্যয় তা নয়। সময়ের হিসাব। কত সময় ব্যয় হচ্ছে বাজার, রান্না ও এসব পরিবেশন করতে। আমলের ক্ষতি তো অনেক। রমজানে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের কথা থাকলেও মেহমানদারির কারণে তা হয়ে উঠছে না। তার ওপর এসব আয়োজনে এসে ভাবীরা দ্বীনি কথা না বলে শাড়ি-চুড়ির গল্পই তো বেশি করেন, তার হিসাব কে দেবে?
এসব দাওয়াতে গিয়ে আমেনা আরেকটি বিষয় লক্ষ করে। আর তা হলো যখন তার সামনে অনেক খাবারের আইটেম থাকে, তখন সে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করে। লজ্জার খাতিরে আমেনা এ কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারে না। কষ্টটা হলো এক ধরনের অতৃপ্তি। এত উপাদেয় খাবারের প্রতিটি আইটেম খেতে না পারার অতৃপ্তি। বেশির ভাগ আইটেম থেকে সামান্য পরিমাণে নেয়ার কারণই সে খাবার থেকে তার তৃপ্তি না পাবার কারণ। খাওয়া শেষে আমেনার মনে হয় হয়তো অন্য আইটেমগুলো বেশি স্বাদের ছিল। অনেকটা শিয়াল আর বকের একে-অপরকে দাওয়াত করার গল্পের অনুভূতি। এ যেন মেহমানদারি নয় বরং একজন অপরজনকে ঠকানোর খেলা।
মাঝে মাঝে আমেনার এও মনে হয়, সে কেন অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে এসব করছে। তার বাসার সামনেই কয়েকজন বিধর্মী লোক বাস করত। তাদের বাসায় তো এ ধরনের পার্টি বা খাবারের আয়োজন আমেনা কখনো হতে দেখেনি। যদিও তারা প্রায় বছরের অধিক সময় এখানে ছিল। মুসলমান কি খেতে আর খাওয়াতেই হায়াত শেষ করে ফেলবে?
এসব ভাবতে গিয়ে আমেনা নিজেই লজ্জিত হলো। ইসলাম অধিক খেতে নিষেধ করলেও মুসলমান হয়ে আমরা অধিক খাচ্ছি। তবে কি ইসলামের সত্যিকার শিক্ষা আমাদের থেকে বিলীন হতে বসল। রাসূল সা:-এর আরেকখানা হাদিসের কথা মনে পড়ে আমেনা আরো কুঁকড়ে গেল। সবচেয়ে নিকৃষ্ট পেয়ালা হলো সেটাই যা খাবার দিয়ে পরিপূর্ণ করা হয়। এখানে পেয়ালা বলতে পেটের কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পেট পুরে খাওয়া এক নিকৃষ্ট কাজ। ইসলামের শিক্ষা থেকে আমরা দিন দিন এভাবেই দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। নিজের অজান্তেই আমেনার বুক থেকে এক চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
লেখক : প্রবাসী


আরো সংবাদ



premium cement