২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যবসায় সততা অপরিহার্য

-

বৈধ উপায়ে রুজির প্রচেষ্টা ইবাদত। এ জন্য আল্লøাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে প্রচুর সওয়াবও মিলবে। হালাল জীবিকা উপার্জনের যত পদ্ধতি আছে, ব্যবসা এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবসাই সবচেয়ে বড় উপার্জনের মাধ্যম। আর যদি তা হালালভাবে করা যায়, তবে তা কতই না উত্তম। বিশ্বনবী সা: ইরশাদ করেন, ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তা-ই সর্বোত্তম।’ (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)
এ সর্বোত্তম উপার্জনে যদি সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠা থাকে, তবেই তা প্রশংসনীয় হবে। তাই সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে বৈধ পথে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতে ইসলাম বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।’ (সূরা নিসা : ২৯)
ইসলাম সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী হতে উৎসাহী করেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের জন্য মহা পুরস্কারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং ব্যবসায় সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারি ইত্যাদির উপস্থিতি অতিব জরুরি। বিশ্বনবী সা: হাদিস শরিফে ইরশাদ করেন, ‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক এবং শহীদদের সাথে থাকবে।’ (সহিহ তিরমিজি, সহিহ আত তারগিব ওয়াত তারহিব) অন্যত্র পাওয়া যায়, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা: বলেন, কোনো ব্যক্তি যখন ত্যাগ স্বীকার করে সওয়াবের আশায় মুসলিম জনপদে কোনো প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করে এবং ন্যায্যমূল্যে তা বিক্রয় করে, আল্লাহর কাছে তিনি শহীদের মর্যাদা লাভ করবেন। (তাফসিরে কুরতুবি)
ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসেবে হালাল পথে ব্যবসা করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি অবৈধ পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতেও নিষেধ করেছে। মিথ্যা, অন্যায়, জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারি, মজুদদারি ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও এর শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা-অপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লøাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ছাড়া। (সহিহ তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)
পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় বেশির ভাগ ব্যবসায়ীকে দেখা যায় মিথ্যা কসম করতে। অথচ তা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যার কারণে ব্যবসা ভালো হলেও বরকত কম হয়। হজরত আবু কাতাদা রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হতে বিরত থাকো। এর দ্বারা মাল বেশি বিক্রি হয় বটে, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম)
রাসূলুল্লøাহ সা: আরো বলেন, ‘অধিক কসম খাওয়ার প্রবণতা ব্যবসায় কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত দূর করে দেয়।’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
তাই ব্যবসার ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে জন্যই রাসূলুল্লøাহ সা: ব্যবসায়ীদের মিথ্যা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া রা: বলেন, রাসূলুল্লøাহ সা: আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন, হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে।’ (সহিহ আত তারগিব ওয়াত তারহিব)
ব্যবসায় মিথ্যা কসম ইসলামে নিষিদ্ধ হওয়ায় মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিণতি সম্পর্কে হাদিসে সাবধানের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লøাহ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দেবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। হজরত আবু যার রা: বললেন, হে আল্লøাহর রাসূল সা:! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত? তিনি সা: বললেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ওই ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে।’ (সহিহ মুসলিম ও মিশকাত)
মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। কেননা, মজুদদারি পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে মজুদদারি করে সে পাপী।’ (সহিহ মুসলিম)
ব্যবসায় ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোনো দোষ-ত্রুটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখে তা প্রকাশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোনো প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। রাসূলুল্লøাহ সা: পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করার পাশাপাশি এর পরিণতিও উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত হাদিস বর্ণনাকারী বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, ‘একদা নবী করিম সা: কোনো এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তাঁর হাত ভিজে গেছে। তিনি সা: বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! বৃষ্টিতে তা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লøাহ সা: তাকে বললেন, তাহলে ভেজা অংশটা শস্যের ওপরে রাখলে না কেন (?) যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়।’ (সহিহ মুসলিম ও মিশকাত)
সর্বোপরি বলা যায়, আমরা মুসলিম হিসেবে অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি যেমন ইসলামী অনুশাসন মেনে করি, তেমনি ব্যবসায়ও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা উচিত। উল্লিøখিত নিয়মনীতি মেনে না চললে হক্কুল ইবাদ, তথা বান্দার হক নষ্টের গোনাহ অভিযুক্ত ব্যবসায়ীর ওপর পতিত হবে। যা কিয়ামত দিবসে পরিশোধ করতে জীবনের সব নেক আমল দিলেও হবে না। তাই দুনিয়াতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে এ সমঝোতা করতেই বিশ্বনবী সা: এমন বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে তাহলে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
লেখক : আলেম ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement