১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখার উপায়

-

নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র এখনো আমরা পত্রিকায় দেখি। কোমলমতি শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউই রেহাই পাচ্ছেন না নির্যাতনের হাত থেকে। নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমেই ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। চার থেকে পাঁচ বছরের যে শিশু, সেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে পাষণ্ড লম্পট দ্বারা। অবস্থা এমন হয়েছে, নারী মানেই নির্যাতন, নারী মানেই বৈষম্য। নারী নির্যাতন সমাজের মারণব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। বিশেষত নারীকে পণ্য করে বাজারে তোলার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাও নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, নারী ধর্ষণ, নারীর শ্লীতাহানির অন্যতম কারণ। পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীকে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ব্যবহার, ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমে নারীকে শারীরিকভাবে আবেদনময়ী করে উপস্থাপন নারীর যৌন হয়রানিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সবচেয়ে আফসোসের বিষয় হলো, নারী আজ আপন ঘরে পরম আপনজন কর্তৃক নিপীড়িত হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, বিবাহিত নারীদের প্রতি চারজনের একজন স্বামীর নির্যাতনের শিকার। নারী যখন উপেক্ষিত হয় এমন কারো কাছে, যাকে নিয়ে সে তার স্বপ্নের সৌধ নির্মাণ করে, তখন সে পরকীয়ার মতো ভয়াবহ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। তবে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, কোনো কোনো দেশ তো নারীর পরকীয়া সম্পর্ককে আর অপরাধ গণ্য করছে না। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরকীয়া আর অপরাধ থাকল নাÑ এমন একটি রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অনেক নারী বলেছে, ওই রায়ে নাকি নারীর অধিকার পূর্ণতা পেয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, কোনো নারী যখন তার স্বামীর কাছেই অবজ্ঞার শিকার হয়, তার ন্যায্য অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয় তখন সে জেদি হয়, মারমুখী বা আক্রমণাত্মক হয়। নারী স্বামীকে চায়ের সাথে ঘুমের ট্যাবলেট প্রয়োগ করে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুব একটা কম নয়।
আমাদের মনে রাখা উচিত, একজন নারী তার স্বামীর কাছে শুধু ভাত-কাপড়ের জন্যই আসে না। তাহলে তো ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েদের বিয়েরই প্রয়োজন হতো না। বরং স্ত্রীর অর্থনৈতিক (ভরণ-পোষণের) অধিকারের পাশাপাশি তার আরো কিছু অধিকার রয়েছে, যেগুলো অপূর্ণ থেকে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। বৈবাহিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। স্ত্রীর মানসিক বিনোদন তার অন্যতম। একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে শুধু ভরণ-পোষণে তুষ্ট থাকতে পারে না। বরং স্বামীর কাছে তার আরো কিছু চাওয়া-পাওয়ার আছে। সেগুলো সে পূর্ণভাবে পেতে চায়। কোনো স্ত্রী যদি সত্যিকার অর্থে স্বামীভক্ত হয়, তাহলে সে তার স্বামীকে মনে-প্রাণে ভালোবাসে, স্বামীকে নিয়ে সে তার স্বপ্নের সৌধ নির্মাণ করে। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীও চায় স্বামী তাকে ভালোবাসুক, তার প্রতি আলাদাভাবে খেয়াল করুক, তাকে গুরুত্ব দিক, তার সাথে হাসিমুখে কথা বলুক এবং আবেগপূর্ণ আচরণ করুক।
স্বামীভক্ত কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর কাছ থেকে এসব অধিকার না পায় অথবা কোনো কারণে সে তা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে মারাত্মক অপমান বোধ করে এবং মানসিকভাবে আহত হয়। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কিংবা হালকা হওয়ার এটাও একটি কারণ।
অনেক স্বামী আছেন, স্ত্রীর এসব বিষয়ের প্রতি খেয়াল করেন না; বরং তারা ভরণ-পোষণটাকেই বড় কিছু মনে করেন। তাদের ধারণা, স্ত্রীর খরচ বহন করা, তার ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করা, তাকে বাসস্থান দেয়া হলেই তার প্রতি সবটুকু দায়িত্ব পালন হয়ে যায়। তারা নিজেদের বিনোদনের জন্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে বিনোদন ও নিয়মিত সময় কাটান। কিন্তু স্ত্রীর মানসিক প্রত্যাশার ব্যাপারটার প্রতি একদম খেয়াল করেন না। এটা স্ত্রীর প্রতি একপ্রকার জুলুম। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এই মনোভাবের কঠোর নিন্দা করেছে ইসলাম। নিশ্চিত করেছে স্ত্রীর নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবন।
স্ত্রী হিসেবে ইসলাম নারী জাতিকে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে। স্বামীকে নির্দেশ দিয়েছে স্ত্রীর সাথে ভালো আচরণ করার। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সাথে বসবাস করো সদাচারের সাথে। আর যদি তোমরা কোনো কারণে তাদের অপছন্দ করো, তাহলে হয়তো তোমরা এমন একটি বস্তুকে অপছন্দ করলে, যাতে আল্লাহ তায়ালা প্রভুত কল্যাণ রেখেছেন। (সূরা নিসা : ১৯) এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ যেন কোনো মুমিন নারীকে অপছন্দ না করে।’ (সহিহ মুসলিম : হাদিস-১৪৬৯, সুনানে ইবনে মাজা : হাদিস-১৯৭৯) এই হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাম্পত্য জীবনের কলহ নিরসন ও নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণের একটি মূলনীতি বলে দিয়েছেন। স্ত্রীর সব আচরণ স্বামীর কাছে ভালো লাগবে, এটা অসম্ভব। আবার স্বামীর সব আচরণ স্ত্রীর কাছে ভালো না লাগাই স্বাভাবিক। কারণ আল্লাহ তায়ালা কাউকেই পূর্ণতা দান করে সৃষ্টি করেননি। প্রত্যেকের ভেতরেই কিছু না কিছু মন্দ স্বভাব থাকবেই। ভালো ও মন্দ মিলেই মানুষ। কাজেই স্ত্রীর কোনো স্বভাব স্বামীর কাছে অপছন্দ হলে সে যেন ধৈর্যধারণ করে এবং ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। স্ত্রীর ভালো গুণগুলোর দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহর শোকর আদায় করে এবং তার প্রশংসা করে।
এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্বামীর জন্য রাসূল সা:-এর জীবনই উত্তম আদর্শ। রাসূল সা: যখন ঘরে যেতেন, স্ত্রীদের সাথে ঘরের কাজে শরিক হতেন। তাদের সাথে সদাচার করতেন। স্ত্রীদের সাথে খোশগল্প করতেন। তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। রাসূল সা: কখনো কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি। তিনি যখন তাহাজ্জুদের সময় উঠতেন, তখন খুব আস্তে দরজা খুলতেন, যাতে ঘরের লোকদের ঘুমে ব্যাঘাত না হয়। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ করো।’ (তিরমিজি : হাদিস-১১৬৩) অন্য হাদিসে আছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই নারী উত্তম, যে তার স্বামীর কাছে উত্তম।’ (জামে তিরমিজি : হাদিস-১১৬২)
স্ত্রীদের বিনোদনের সুযোগ করে দেয়া, তার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ রাখা স্বামীর কাছে স্ত্রীর হক বা অধিকার। ইসলামী শরিয়ত স্ত্রীর মানসিক বিনোদনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ যেমন স্বামীর দায়িত্বে, তেমনি তার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখাও তার দায়িত্বে। তাই স্ত্রীদের বিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিনোদন আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেয়াও স্বামীর নৈতিক দায়িত্ব। বিয়ের দ্বারা অনেক জৈবিক চাহিদা পূরণ হয়। তবে তা শুধু জৈবিক ও বৈষয়িক ব্যাপারের মধ্যে সীমিত নয়। বরং বিয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হলোÑ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসাপূর্ণ ও আবেগময় পারিবারিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
কুরআনে কারিমের একাধিক আয়াতের মাধ্যমেও এ বিষয়টি বুঝে আসে। যেমন সূরা রুমের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘আর আরেক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকতে পারো এবং তিনি তোমাদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা রূম : ২১)
এই আয়াতের এ কথা স্পষ্ট বুঝে আসে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো শান্তি, স্বস্তি ও ভালোবাসা। আর এ বিষয়গুলো সম্পূর্ণই মানসিক উপাদান, বৈষয়িক উপাদান নয়। এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতিতে বৈবাহিক জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। বিয়েটা একটা দৈহিক চাহিদা পূরণের উপকরণ হয়ে যায়। তাই ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আবেগ ভালোবাসাকেন্দ্রিক চাহিদাগুলোর প্রতি যত্মবান হতে নির্দেশ দিয়েছে। স্ত্রীর মানসিকতার প্রতি লক্ষ রাখা আদর্শ স্বামীর একান্ত দায়িত্ব। যেমন স্ত্রী কোনো কাজ করতে পছন্দ করলে তাকে সে কাজ করতে সুযোগ করে দেয়া, প্রতিদিন কিছু সময় স্ত্রীর সাথে হাসি-মজাক করা, তাকে নিয়ে বাড়ির ছাদে বা ঘরের আঙ্গিনায় পায়চারি করা, তাকে সমুদ্রসৈকত, চিড়িয়াখানা, জাদুঘর বা কোনো দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাওয়া, অথবা বিদেশ ভ্রমণের সময় স্ত্রীকে সঙ্গী করা, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে স্ত্রীর সাথে বৈধ কোনো খেলাধুলা করা ইত্যাদি। হাদিস শরিফে আছে, তিন ধরনের খেলাধুলা বৈধ : তীর নিক্ষেপ, ঘোড় প্রতিযোগিতা, স্ত্রীর সাথে খেলাধুলা’। রাসূল সা: তার স্ত্রীর সাথে খেলাধুলা করতেন। হাদিস শরিফে আছে, ‘রাসূল সা: হজরত আয়েশা রা:-এর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন’। আয়েশাকে নিয়ে মসজিদে তিনি আবিসিনিয়দের খেলা দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন যার চরিত্র সুন্দর, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (রিয়াদুস সালিহীন ১/১৯৭)
বিয়ের আসল উদ্দেশ্য হলো, শান্তি ভালোবাসা ও দয়া। হাদিস শরিফে আছে, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো স্বামী স্ত্রীর দিকে দয়া ও ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার দিকে দয়া ও রহমতের দৃষ্টি নিয়ে তাকান।’ এই হাদিসে বোঝা যায়, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা তাদের প্রতি রহম করা ইসলামী শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রত্যক স্ত্রীই তার স্বামীর কাছে ভালোবাসা চায়। স্বামীর উচিত, স্ত্রীর ভালোবাসা ও তার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। অনেক স্বামী আছে, স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন না। অথচ স্ত্রীরা স্বামীদের কাছ থেকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ চায়। এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া জরুরি। স্ত্রীর কাজে প্রশংসা করতে হবে। তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, তার স্বামী তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতে হবে। সামান্য বিষয়গুলো তার সাথে শেয়ার করতে হবে।
মোট কথা, স্বামীকে বিভিন্ন আচরণের দ্বারা এ কথা বোঝাতে হবে, সে তার স্ত্রীকে একজন রাঁধুনি বা দৈহিক আনন্দের উপকরণ ভাবছে না। বরং স্ত্রীকে সে তার জীবন-সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে তার প্রধান সহযোগী, সম্মানের ক্ষেত্রে তার সন্তানের মা, বিপদাপদের ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গিনী বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আর ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ভাবছে। এতে স্বামীর প্রতি তার ধারণা স্বচ্ছ হবে। স্বামীকে সে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসবে। তখনই সংসারে শান্তির সুবাতাস বইবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া রহমানিয়া,গাজীপুর


আরো সংবাদ



premium cement