২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দাওয়াত ও তাবলিগ

-

দাওয়াত আরবি শব্দটির অর্থ হচ্ছে ডাক, আহ্বান ও প্রচার। তাবলিগ শব্দটিও আরবি। এর মানে হচ্ছে প্রচার, ঘোষণা বা পৌঁছে দেয়া, দ্বীনি দাওয়াত তথা ধর্মের বাণী প্রচার করা বা পৌঁছে দেয়া। সুতরাং সহজবোধ্যভাবে আমরা বলতে পারি, দাওয়াত ও তাবলিগ মানে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামের বাণী পয়গাম, আমল ও আদর্শ সারা বিশে^ পৌঁছে দেয়া, ছড়িয়ে দেয়া।
দাওয়াত কার জন্য?
আরেকটি অনিবার্য প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের দাওয়াত কাকে দেয়া হবে? বাস্তবতার নিরিখে তার জবাব হচ্ছে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার প্রতি ধর্মের আহ্বান পৌঁছে দিতে হবে। অমুসলিমদের প্রতি দাওয়াত দিতে হবে, মূল ধর্ম গ্রহণের তথা ঈমান গ্রহণের এবং মুসলিমদের প্রতি দাওয়াত হবে, গৃহীত ধর্ম ও ঈমানের দাবি তথা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর সাথে কৃত চুক্তি অনুযায়ী নেক আমল করার এবং তা শিক্ষাদীক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার।
উল্লেখ্য, কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ পাঠ করা মানেই হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর সাথে এমন চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট করা যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় বিধিবিধান মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শ অনুযায়ী মেনে চলব।
এ ক্ষেত্রে সমকালীন বিজ্ঞ গবেষক মুফতি ( যার বহুমুখী তাহকিক গবেষণা এ যুগের বিজ্ঞ মুফতিদের কাছে গৃহীত হয়ে আসছে) হজরত শায়খ রশীদ আহমদ লুধিয়ানী রহ: ‘ফরজে কিফায়া’ দাওয়াত বা তাবলিগ সম্পর্কে বলেন : দাওয়াত ও তাবলিগের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে ‘ফরজে কিফায়া’। তার অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীতে যদি এমন কোনো স্থান পাওয়া যায়, যার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি বোঝা যায় যে, ‘ইসলাম’ ধর্ম সম্পর্কে তাদের জানা নেই। তেমন ক্ষেত্রে/স্থানে, সব মুসলমানের জন্য ফরজ তারা এমন কিছু মুসলমানকে তাদের কাছে পাঠাবে যারা তাদেরকে ‘ইসলাম’-এর দাওয়াত দিয়ে মুসলমান বানাবে এবং তারপর তাদেরকে ইসলামের বিধিবিধান ও আবশ্যকীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেবে। মুসলমানদের মাঝে যদি কেউ এ ফরজ আদায় না করে, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে। আর যদি শুধু একজন মুসলমানও এ দায়িত্ব পালন করে, তাহলে সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে।
বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীর কোনো দেশেরই এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো মুসলমানদের ওপর ‘ফরজে কিফায়া’ হতে পারে। তার কারণ, এ যুগে ‘ইসলাম’-এর খ্যাতি-প্রসিদ্ধি নিজেই দাওয়াত হয়ে পুরো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিস্তৃত, প্রসারিত হয়ে আছে। বিশ^জগতের প্রতিটি মানুষই ‘ইসলাম’ নামে যে একটি ধর্ম আছে তা জানে। যে কারণে বর্তমানে ওই ফরজ ও দায়িত্ব খোদ তাদের ওপরই বর্তায় যে, বিভিন্ন ধর্মের অনুসন্ধান করে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝে, সত্য-সঠিক ধর্মটি গ্রহণ, অনুসরণ করবে। তেমন চিন্তা ও পার্থক্যজ্ঞান মহান আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকেই দান করেছেন। যে কারণে শরিয়তের বিধান হচ্ছেÑ
‘কোনো মানুষ যদি এমন স্থানে জন্ম নেয় যেখানে অন্য কোনো মানুষের বাস নেই; তাহলে সাবালক হওয়ার পর তারও ফরজ দায়িত্ব হবে, সে আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে তাঁর সত্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৯, পৃ-১১৩)।
বিজ্ঞ গ্রন্থকার অতঃপর লিখেছেন, “একইভাবে যেসব লোক জন্মগতভাবে মুসলমান, মুসলমানের গৃহে লালিত-পালিত হয়ে বড় হচ্ছে, সাবালক হচ্ছে; ওই ফরজ ও দায়িত্ব তাদের ওপর বর্তায় যে, তারা নিজেরাই ইসলামের আদেশ, নিষেধ ও বিধিবিধান জেনে নিয়ে সে মোতাবেক আমল করবে। অন্য মুসলমানদের ওপর এটা ফরজ ও দায়িত্বভুক্ত নয় যে, তারা দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদেরকে ইসলামের বিধিবিধান শিক্ষা দেবে! কোনো ব্যক্তির ‘মুসলমান’ হওয়া মানেই হচ্ছে, সে ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান মেনে নিয়েছে। যে কারণে সে কোনো কাজই ‘ইসলামী আইন’পরিপন্থী করবে না।”
ইসলামের আইন-বিধান কী কী? তা জেনে নিয়ে সে মোতাবেক কাজ, আমল করা তার নিজের ফরজ দায়িত্ব; অন্য কারো নয়। একই কারণে কেউ আইন-বিধানপরিপন্থী কোনো কিছু করে, এমনটি বলে শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে না যে, ‘আমার ওই আইন-বিধান বা মাসয়ালা জানা ছিল না।’ (প্রাগুক্ত: পৃ-১১৪)।
তাবলিগ ও আল কুরআন : পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনের নি¤েœাক্ত আয়াতগুলোর প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করলে, আমরা দাওয়াত ও তাবলিগের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো অধিক উপলব্ধি করতে পারব। উদাহরণত (১) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখবে। (০৩ : ১১০)।
(২) তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল থাকতে হবে, যারা ভালো কাজের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকর্মের নির্দেশ দেবে ও অসৎকর্মে নিষেধ করবে; আর এরাই সফলকাম।’ (০৩ : ১০৪)।
(৩) মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘ওই ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম, যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে আহ্বান করে, নেক আমল করে এবং বলে, ‘আমি তো অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।’ (৪১ : ৩৩)।
(৪) তিনি আরো বলেন, ‘আপনি উপদেশ দিতে থাকুন, কারণ উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসে।’ (৫১ : ৫৫)।
(৫) তিনি আরো বলেন, ‘আর আপনি আপনার পরিবার-পরিজনকে নামাজের আদেশ দিন এবং তাতে নিজেও অবিচল থাকুন।’ (২০ : ১৩২)।
উপরিউক্ত সবগুলো আয়াত থেকেই আল্লাহর দিকে আহবান করা, কল্যাণের দিকে ডাকা, সৎকাজে আদেশ দান, অসৎকাজে নিষেধ করা, নামাজের নির্দেশদান ইত্যাদি যা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেÑ এসবই প্রকারান্তরে দাওয়াত ও তাবলিগের অন্তর্গত।
অসৎকাজে নিষেধও ফরজ : গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, কুরআন ও হাদিসের প্রায় সর্বত্রই ‘সৎকাজের আদেশের পাশাপাশি অসৎকাজে নিষেধের নির্দেশ সমান্তরালে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ‘অসৎকাজে নিষেধ’ বাদ দিয়ে কেবল সৎকাজে আদেশদানের তাবলিগ করলেই ওই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ফরজ দায়িত্ব পালিত হয়েছে বলে গণ্য হবে না। দু’টি দায়িত্বই পাশাপাশি চালিয়ে যেতে হবে। অবশ্য অসৎকাজে নিষেধের তাবলিগকালীন, এইÑ (‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে প্রজ্ঞা-কৌশলের মাধ্যমে এবং উত্তম উপদেশ দ্বারা আহ্বান করুন।’(১৬ : ১২৫) আয়াতখানার আলোকে নম্রভাবে, দয়াদ্র হয়ে, সংশ্লিষ্টদের কল্যাণ চিন্তায়, কৌশলী পন্থা অবলম্বন করে তাবলিগ করতে হবে। সুতরাং এমন চিন্তা ও বক্তব্য যে, ‘অসৎকাজে নিষেধ করতে গেলে হিংসা, হঠকারিতা ও অসন্তোষ জন্ম নিতে পারে; তাই কেবল সৎকাজে আদেশদানের মধ্যেই তাবলিগকে সীমিত রাখতে হবে’Ñ এমন ধারণা আদৌ সঠিক নয়। (প্রাগুক্ত : ৫১৩পৃ.)।
তাবলিগ ও শাস্তি: অসৎকাজে নিষেধের তাবলিগ করতে গিয়ে কখনো সাজা-শাস্তি, শাসনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে কি তেমন প্রয়োজনে কাউকে শাস্তি দেয়া জায়েজ হবে? তার জবাব হচ্ছে, পাপকাজ থেকে বিরত রাখার জন্য যে কেউ যাকে ইচ্ছা, তেমন শাস্তি প্রদান জায়েজ হবে না। যে কারণে প্রচলিত তাবলিগ জামাতেও তেমন শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে ‘ফরজে আইন’ তাবলিগের ক্ষেত্রে যাদের দায়দায়িত্ব নিজের ওপর বর্তায় তাদেরকে তা’যির প্রকৃতির সাধারণ কিছু সমীচীন শাস্তি দেয়া যেতে পারে। উদাহরণত, পিতামাতার পক্ষে নিজ নাবালক সন্তানকে, স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে, শিক্ষকের পক্ষে ছাত্রকে এবং শায়খ বা পীরের পক্ষে মুরিদকে। যেমন অবস্থা বুঝে কিছু বকাঝকা, শরীয়তের সীমার ভেতরে থেকে হালকা প্রহার ইত্যাদি। এতেও আবার শর্ত হচ্ছে, নিয়ত একান্ত বিশুদ্ধ হতে হবে। একমাত্র মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা উদ্দেশ্য হতে হবে। এমনটি হতে পারবে না যে, তার প্রতি ক্রোধান্বিত অন্য কোনো কারণে; অথচ শরিয়তের তেমন বৈধতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করা হচ্ছেÑ এমনটি যেন না হয়।
ওইসব সম্পর্ক ও স্বজন ছাড়া অন্য কারো পক্ষে তাবলিগ করতে গিয়ে অপরাধী বা অভিযুক্তকে কোনো প্রকার শাস্তিদান জায়েজ নেই। আর শাস্তি যদি ইসলামী শরিয়তের ‘হুদুদ’ তথা দণ্ডবিধি প্রকৃতির হয়, তা হলে তেমন শাস্তিদান রাষ্ট্র ও প্রশাসন ছাড়া কারো পক্ষেই জায়েজ নেই।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে শরিয়তের মাপকাঠি অনুযায়ী দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের গুরুত্ব বোঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুফতি, ইফা

 


আরো সংবাদ



premium cement