২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইসলামী-উম্মাহ বনাম জাতি-রাষ্ট্র

-

বর্তমান সময়ে মুসলিম-বিশ্বের যে দুঃখজনক অবস্থা, সে বিষয়ে খুব সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম শাসকদের দায়ী করা চলে। এ বিষয়ে আদৌ কোনো সন্দেহ নেই যে, তারা অন্যায়-অবিচার ও কুকর্মের সহযোগী। মুসলিম শাসকেরা যদি সবাই একযোগে সক্রিয় হয়ে উঠতেন, তাহলে আফগানিস্তান, বসনিয়া, কসোভা, কাশ্মির, চেচনিয়া, ইরাক ফিলিস্তিন ইত্যাদি কোনো স্থানেই দুশমনের পক্ষে নরহত্যা চালানো সম্ভব হতো না। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু এইজন যে, মুসলিম শাসকেরা বস্তুতপক্ষেই নীতিভ্রষ্ট, ভীরু ও দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন নির্বিবেক। ১২০ কোটি মানুষ নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী উন্মাহ আজÑ যে দুর্ভোগের শিকার, তার কারণ তারা ৫৭ জন দুষ্টমতি ব্যক্তির শাসনাধীন।
এই শাসকেরা অবশ্য তাদের কোনো পরিকল্পনা ও কার্যক্রমই একেবারে ব্যক্তিগত অভিপ্রায় দ্বারা বাস্তবায়ন করেন না। তাদের রয়েছে অনুগত সেনাবাহিনী, রয়েছে পর্যাপ্ত সরকারি-আমলা ও সরকারের সব পর্যায়ে অসংখ্য কর্মচারী এবং তারাই সম্মিলিতভাবে শাসকের সব অসৎ অভিপ্রায় ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এতদসঙ্গে, সমাজও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সব ধরনের দুর্নীতি ও দুষ্কর্মকে অবাধ ও স্থায়ী রূপদানে সহায়তা অব্যাহত রাখে। আমরা যদি ভালোভাবে দেখতে চাই, তাহলে দেখব, আমাদের মূল সমস্যা হলো দুর্নীতি এবং এই দুর্নীতি শুধু শাসকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে সব স্তরে সর্বসাধারণের মধ্যে।
আলাদা-আলাদা রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধ খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিবেচনার বিষয় তা হলো, বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যথোচিত ব্যবস্থা ও প্রণালী। ইসলামের যে উত্তরাধিকার-আইন সেটা এ ক্ষেত্রে একটি শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে। উত্তরাধিকার বণ্টন নিয়ে এমনকি নিকটাত্মীয় স্বজনের মধ্যেও বিবাদ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। কিন্তু যেহেতু ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ককে গভীর মূল্য দেয় এবং এ ক্ষেত্রে সামান্যতম কলহও সৃষ্টি না হয়, বণ্টনের ক্ষেত্রে শরিয়াহ পুক্সক্ষানুপুক্সক্ষরূপে সুনির্দিষ্ট ও অলঙ্ঘনীয় বিধান তৈরি করে দিয়েছে এবং এই বিধান এমনই অকাট্য যে, কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা এমনকি সরকারও তার বিরুদ্ধাচরণ বা আলাদা কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। এভাবে একটা অকাট্য ব্যবস্থা-প্রণালী এই জাতীয় বিবাদকে স্থায়ীভাবে রুদ্ধ করে দেয়। একই রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সমন্বয়ে সমঝোতা ও মীমাংসার জন্য এই রকমই একটা ব্যবস্থা-প্রণালী থাকা আবশ্যক, যাতে যেকোনো বিবাদ ও বিরোধের সহজ নিরসন হতে পারে। সর্বোপরি প্রত্যেকের মধ্যে এই তীব্র উপলব্ধি সর্বদা সজাগ এবং সক্রিয় থাকা আবশ্যক যে, তারা একই নৌকার যাত্রী।
১৯৯১ সালে ইরাক যে যুদ্ধের সম্মুখীন হলো, সেখানেও এই একইভাবে একই ধরনের বৈধতার মুখোশ পরিয়ে দেয়া হলো। এ ক্ষেত্রে যদি কোনোরূপ সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তা হলে দু’টি মুসলিম দেশের সীমান্ত যে অলঙ্ঘনীয়, এ কথা বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধের বৈধতা দিতে হবে। আফগানিস্তান ও ইরাকের ওপর যে অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হলো, সেটা যে ইসলাম এবং জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ, তারই অন্যতম উদাহরণ। ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে কোনো মুমিন নিজের মতো আহার করে নিদ্রা যেতে পারে না। অথচ সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি জাতিসঙ্ঘের নির্দেশ, খাদ্যাভাব ও ওষুধপত্রের অভাবে যত প্রাণহানিই হোক, ইরাকে কোনোভাবেই খাদ্য ও ওষুধ পাঠানো যাবে না। আবার উল্লেখ করি, মুসলিম দেশগুলোও জাতিসঙ্ঘের ওই নির্দেশ পালনে এতটুকু অন্যথা করল না; করল না তার কারণ তাদের মনের অবচেতনে রয়েছে জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রতি অটুট ও অবিচল আনুগত্য। অথচ আল কুরআন সাবধান করে দিচ্ছে, আমরা যেন কোনোক্রমেই বিবাদ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকারে পরিণত না হই; যদি হই, আমরা তাহলে দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়ব। কিন্তু আমরা আজ এ নিষেধ শুধু অমান্যই করছি না, আমাদের মুসলিম-বিশ্বে কুরআন প্রদত্ত এই নিষেধ-নির্দেশকে উপেক্ষা করে আত্মকলহ এবং অন্তর্দ্বন্দ্বকেই স্থায়ী ও আইনসম্মত করে তুলেছি।
জাতিরাষ্ট্রের এই ব্যাখ্যা ও প্রদর্শনী অনিবার্যভাবেই মানসিক অবরুদ্ধতার দিকে চালিত করে। প্রথমত, এটা একটা বিভ্রম। অবশ্য বর্তমান বিশ্বায়নের জোয়ারে জাতিরাষ্ট্রের ব্যাপারটি ক্রমশ নি®প্রভ হয়ে আসছে। দৃশ্যত উত্তমই বটে, কারণ জাতিরাষ্ট্রের অনেক বাধা ও প্রতিবন্ধকতাকে শিথিল করে দিয়ে তদস্থলে বিশ্বায়ন নতুন কিছু প্রতিস্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে এবং এটা অনেকাংশে মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা হলো, বিশ্বায়ন যেসব বিষয়ে শৈথিল্য আনতে চায়, সেই তালিকা, যেসব ক্ষেত্রে শক্তি বৃদ্ধি প্রয়োজন তার সাথে রীতিমতো বিপরীতধর্মী।
দ্বিতীয় যে মানসিক বৈকল্য বা বাধা তা হলো, জাতিরাষ্ট্রের বাস্তবতা, যা থেকে সরে আসা প্রায় অসম্ভব। কয়েক শতাব্দী আগেও আমাদের ছিল ‘খিলাফাহ সিস্টেম’। তারপর এই খিলাফাহ আলাদা স্বাধীন এলাকার উদ্ভব ঘটল। আজ আমাদের ৫৭টি রাষ্ট্র এবং এই অবস্থার যেকোনো পরিবর্তন হবে, সেটা বোধ হয় আমরা আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না। বহু শতাব্দী ধরে আমাদের রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র মোটামুটি একটাই ছিল; আর তখন মুসলিমবিশ্বে বিদ্যমান ছিল অভাবনীয় সংহতি। তখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই মুসলিম বিশ্ব ছিল এক ও অবিভাজ্য। ভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা, মুদ্রা ও আইনকানুন সর্বত্র একই ছিল। ভ্রমণ, মালামাল ও মূলধনের চলাচলে কোথাও কোনো বাধা ছিল না। একজন মুসলমান যেকোনো স্থানে বসবাস করতে পারত, চাকরি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যও করতে পারত। ইবনে বতুতা তিউনিসিয়া থেকে হিযাজ, পূর্ব আফ্রিকা, ভারতবর্ষ, মালয় এবং চীন মিলিয়ে ৭৫ হাজার মাইল এমনভাবে পরিভ্রমণ করেন যে, তিনি কখনো একই পথে দ্বিতীয়বার গমনাগমন করেননি। তার এই দীর্ঘ ২৫ বছরের ভ্রমণকালে তিনি যেখানে ইচ্ছা ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করেছেন এবং তিনি এমনকি কাজী (বিচারক) হিসেবে সরকারি কাজেও যোগ দিয়েছেন। ভারত-সুলতানের পক্ষ থেকে চীনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে যা বলতে চাই তা হলো, তখন যদি এটা সম্ভব ছিল, তা হলে বর্তমানের সহজ ও বিশাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহন প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির যুগে আরো অনেক বেশি সহজতর হওয়া উচিত।
নিশ্চয়ই আমরা ৫৭টি মুসলিম-সরকারকে রাতারাতি সরিয়ে দিয়ে তদস্থলে খেলাফত কায়েম করতে পারি না। কিন্তু আমরা ক্রমশ আমাদের মধ্যকার নিরর্থক বাধাগুলো তো সহজেই ভেঙে দিতে পারি। ভ্রমণ, ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা, তাকে অপসারণ করা আদৌ দুরূহ নয়। আর এটা অনুধাবন করা কিছুমাত্র কঠিন নয় যে, একত্রীভূত মুসলিম বিশ্ব যথেষ্ট শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক সহায়তা ও সহাযোগিতা সৃষ্টি হলে এক অপরের পরিপূরক হিসেবে সবার মধ্যেই এক অপ্রতিহত শক্তির উন্মেষ ঘটবে। উল্লেখ করা বাহুল্য, মুসলিম বিশ্বের যে কৃত্রিম সীমান্ত ব্যবস্থা, সেটা আসলে মুসলিম উম্মাহকে হীনবল করার একটি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর চক্রান্ত ও অপকৌশল মাত্র। যা-ই হোক, এই বাধা যদিও অত্যন্ত বাস্তব ও গুরুতর, কিন্তু সর্বাপেক্ষা গুরুতর যে প্রতিবন্ধকতা সেটা হলোÑ মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক। এই মানসিক শৃঙ্খল ও সঙ্কীর্ণতাকে অবশ্যই ভেঙে ফেলতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে, অন্য এক নতুন মুসলিম বিশ্ব রচনা করা অসম্ভব কিছু নয়। আর এই উপলব্ধি থেকেই শুরু হবে আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যের দিকে নতুন অভিযাত্রা।
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর


আরো সংবাদ



premium cement
ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের সেতু ভাঙ্গার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে! নাশকতার মামলায় চুয়াডাঙ্গা বিএনপি-জামায়াতের ৪৭ নেতাকর্মী কারাগারে হারল্যানের পণ্য কিনে লাখপতি হলেন ফাহিম-উর্বানা দম্পতি যাদের ফিতরা দেয়া যায় না ১৭ দিনের ছুটি পাচ্ছে জবি শিক্ষার্থীরা বেলাবতে অটোরিকশা উল্টে কাঠমিস্ত্রি নিহত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন

সকল