২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলাম ইহজাগতিক জীবনব্যবস্থা

-

ধর্ম বলতে সাধারণত আল্লাহ বা ঈশ্বরকে ঘিরে কিছু বিধিবিধানের সমষ্টিকেই বেশির ভাগ মানুষ বুঝে থাকেন। অর্থাৎ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শাস্ত্র নির্দিষ্ট বিধিবিধান হলো ধর্ম। আবার ‘ধর্ম’ অর্থ হতে পারে সৎকর্ম, পুণ্যকর্ম, সদাচার, কর্তব্যকর্ম, স্বভাব, প্রকৃতি প্রত্যেক জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ। যেমনÑ ‘লোকটির স্বধর্ম খারাপ’ এই বাক্যে ধর্ম অভ্যাস বা খাসলত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার অন্য অর্থেও ধর্মকে বোঝা যেতে পারে। যেমনÑ আগুনের ধর্ম, মনের ধর্ম, মানবধর্ম, নদীর ধর্ম, শয়তানের ধর্ম; এমনিভাবে ইসলামের ভেতরও একটা ধর্ম রয়েছে। ইসলামের ভেতর যে ধর্ম রয়েছে, সেই ধর্মের অর্থ হলো ‘শান্তি’ নিশ্চিত করা। এই শান্তি ইহজাগতিক ও পরজাগতিক। বস্তুত ইহজগতে শান্তি ও পরজগতে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে যে পন্থা বা ধর্ম, সেই স্বভাব বা পন্থাকে বলা হয়েছে ইসলাম। ইসলাম অপরাপর ধর্মের মতো কোনো ধর্ম নয়। এই ধর্ম মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে শান্তির ওপরে স্থিত করার উত্তম একটি জীবনব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা শুধু পরজাগতিক মুক্তির পন্থাও নয়। ইহজগতেও অশান্তির দাবানল থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে কার্যকর।
কুরআনের মাধ্যমে মুহাম্মদ সা:কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত করতে, সমাজকে শুদ্ধ করতে এবং রাষ্ট্রকে মানবকল্যাণের জন্য প্রস্তুত করতে। সে জন্য আল্লাহ তার রাসূলের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনÑ ‘হে রাসূল! তাদেরকে বলুনÑ এসো আমি তোমাদেরকে পড়ে শুনাই যে তোমাদের রব তোমাদের ওপর কী কী বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। তা এই যে, তার সাথে কোনো জিনিসকে শরিক করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। অভাবের সময় তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমরাই তোমাদের ও তাদের রিজিক দেই। প্রকাশ্য হোক আর অপ্রকাশ্যই হোক, কোনো প্রকার অশ্লীলতার কাছেও যেও না। আল্লাহ যে জীবনকে সম্মানের পাত্র করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করো না, (এ হচ্ছে তোমাদের জন্য কিছু নির্দেশ) আল্লাহ এর মাধ্যমে তোমাদের আদেশ দিয়েছেন, এগুলো তোমরা মেনে চলো, আশা করা যায় তোমরা অনুধাবন করতে পারবে। তোমরা কখনো এতিমের সম্পদের ধারে-কাছেও যাবে না, তবে উদ্দেশ্য যদি নেক হয় তাহলে সে একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমায় পৌঁছা পর্যন্ত; পরিমাপ এবং ওজন ন্যায্যভাবেই তা করবে, আমি কারো ওপর তার সাধ্যসীমার বাইরে কোনো দায়িত্ব চাপাই না, যখন তোমরা কোনো ব্যাপারে কথা বলবে তখন ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে, যদিও তা তোমার আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে যায়। আল্লাহকে দেয়া সব অঙ্গীকার পূরণ করো। আল্লাহ এসবের আদেশ দিয়েছেন, আশা করা যায় তোমরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে। [সূরা আনয়াম : ১৫১-১৫২]।
পবিত্র কুরআনের এসব নির্দেশনা পৃথিবীতেই সম্পন্ন করার তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে লক্ষ্য করে পবিত্র কুরআন ঘোষণা করেছেÑ ‘নারীদের মোহরানার অঙ্ক একান্ত খুশি মনে তাদের মালিকানায় দিয়ে দাও। অতঃপর তারা যদি নিজেদের মনের খুশিতে এর কিছু অংশ তোমাদের দেয়, তাহলে তোমরা খুশি মনে ভোগ করতে পারো। [সূরা নিসা : ০৪]। এই নির্দেশ মানুষের বৈবাহিক জীবনে পালনীয়। বিয়েশাদি দুনিয়ার জীবনে অনুষ্ঠিত হয়; আখেরাতে কারো কোনো বিয়ের সুযোগ থাকবে না। পবিত্র কুরআনের আদেশ-নিষেধগুলো ইহজগতে পালন করার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শান্তির আধার বানানো এবং ধর্মকে মান্য করে চলা। পরজগতে ধর্মকে মান্য করার মতো বিষয় থাকবে, এ ধরনের কোনো নির্দেশনা পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পাওয়া যায় না। ইহজগৎই সব। ইহজগৎ মানুষের কর্মস্থল; পরজগৎ কর্মফল ভোগ করার স্থান। কর্মস্থলের কাজকর্ম সঠিক হলে পরজগতে সাফল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হতে থাকবে। পরজগতে কী হবে? এই চিন্তা নিয়ে বেসামাল না হয়ে ইহজগতের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিকমতো হচ্ছে কি না সে দিকে একনিষ্ঠ হতে পারাই পরজগতের সাফল্য। ইহজগতে কর্তব্যে মানুষ যেন সত্যাশ্রয়ী হতে পারে, সেজন্যই নাজিল হয়েছে পবিত্র কুরআন। এটি মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা। দেখা গেছে, ইহজগতে মানুষ অর্থসম্পদের প্রতি মারাত্মকভাবে দুর্বল। অর্থসম্পদের লোভ মানুষকে তার নীতিনৈতিকতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সে কারণে জন্ম নেয় খুনের মতো জঘন্যতম অপরাধ। এই অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ অর্থসম্পদের ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত করতে পারে তারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনে।
ইহজগতে সন্তানসন্ততি; জায়গাজমি ও অর্থসম্পদ নিয়ে মানুষ ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পরকাল বা পরজগতে এসব নিয়ে ঝামেলা বাধার অবকাশ নেই। অর্থসম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সেগুলোর ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন-ব্যবস্থার রূপরেখা আল্লাহ দিয়েছেন এবং দুনিয়াতেই এ সমস্যার সমাধান করে যেতে হবে, আখেরাতে নয়। পরজগতে কারো ধনসম্পদ, বিয়েশাদি, সন্তান লালন-পালন; দালানকোটা নির্মাণ ইত্যাদি থাকবে না। সব কিছু দুনিয়াতেই মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। কুরআনে বর্ণিত রয়েছেÑ ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে তোমাদের জন্য বিধান জারি করেছেন, এক ছেলের অংশ হবে দুই কন্যাসন্তানের মতো, কিন্তু কন্যারা যদি দুয়ের বেশি হয় তবে তাদের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ; আর কন্যা যদি একজন হয় তাহলে তার অংশ হবে অর্ধেক; মৃতব্যক্তির সন্তান থাকলে তার পিতামাতার প্রত্যেকের জন্য থাকবে ছয় ভাগের একভাগ; মৃতব্যক্তির যদি সন্তান না থাকে এবং পিতামাতাই একমাত্র উত্তরাধিকার হয় তাহলে মায়ের অংশ হবে তিন ভাগের এক ভাগ; অছিয়ত ও ঋণ পরিশোধের পর এসব ভাগবাটোয়ারা; তোমরা জানো না তোমাদের পিতামাতা ও সন্তানসন্ততির মধ্যে কে তোমাদের জন্য উপকারের দিক থেকে বেশি নিকটবর্তী; এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান, অবশ্যই আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তিনিই হচ্ছেন বিজ্ঞ, পরমকুশলী।’ [সূরা নিসা :১১]।
যৌনতা বা যৌনদাসত্ব মানুষকে মানুষ থাকতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সে জন্য যৌনদাসত্ব থেকে মানুষ যেন মুক্তি পেতে পারে তারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যৌনতার মধ্যে একধরনের আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। মানুষের সেই আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র জায়গা হচ্ছে ইহজগৎ। আবেগের সেই পরিস্থিতিতে যেন শৃঙ্খলা থাকতে পারে এবং আত্মীয়তা, বংশধারা ও অংশীদারিত্ব যেন ঠিক থাকতে পারে; সে ব্যাপারে পবিত্র কুরআন বলছেÑ ‘তোমাদের ওপর বিয়ের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে তোমাদের মা, তোমাদের মেয়ে, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভাইদের মেয়ে, বোনদের মেয়ে, দুধমাতা, দুধবোন, স্ত্রীদের মা, সহবাস করা স্ত্রীদের আগের স্বামীর ঔরসজাত কন্যা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে রয়েছে তাদের; যদি তাদের (স্ত্রীদের) সাথে শুধু বিয়ে হয়েছে কিন্তু সহবাস হয়নি তালাকপ্রাপ্ত এমন স্ত্রীর মেয়েদেরকে বিয়ে করতে দোষ নেই; নিজের ছেলেদের স্ত্রীকে হারাম করা হয়েছে; দুই বোনকে একত্র করাও হারাম করা হয়েছে; তবে যা কিছু আগে সংঘটিত হয়েছে তা তো হয়েই গেছে, অবশ্যই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও একান্ত দয়াবান। [সূরা নিসা : ২৩]। পবিত্র কুরআনের এসব নির্দেশও ইহজগতের জন্য।
ইহজগতেই মানব সমাজকে শান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে আল্লাহ মানুষের সমাজিক জীবনসম্পৃক্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ও সৌহার্দ্যরে ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেনÑ ‘হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছ তোমরা একে অপরের ধনসম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; ব্যবসা-বাণিজ্য যা করবে তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই করবে এবং কখনো একে অপরকে হত্যা করবে না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের প্রতি মেহেরবান। [সূরা নিসা : ২৯]। পরজগতে মানুষের জন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য থাকবে না; খুন-জখমও থাকবে না; এ আদেশ ইহজগতের জন্য। মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিশুদ্ধ খাবার-দাবার বিষয়েও নির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কুরআনে। পরজগতে খাবারের ব্যাপারে বলা হয়েছে। সেখানে কোনো প্রকার খাবার নিষিদ্ধ নয়। যা যা সেখানে পাওয়া যাবে তার সবই ভক্ষণ করতে বাধা থাকবে না। সেখানে উন্নত পানীয় ও খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ইহজগতে খাদ্য-খাবারের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছেÑ ‘মৃত জন্তু, রক্ত, শুয়োরের গোশত ও যে জন্তু আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কারো নামে জবাই করা হয়েছে তা সবই তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরা, আঘাত খেয়ে মরা, ওপর থেকে পড়ে মরা, শিংয়ের আঘাতে মরা, হিংস্র জন্তুর খাওয়া জন্তুও তোমাদের জন্য হারাম, তবে তা যদি জীবিত অবস্থায় পেয়ে জবাই করতে পারো তবে ভিন্ন কথা; পূজার বেদিতে বলি দেয়া জন্তুও হারাম, জুয়ার তীর নিক্ষেপ করে ভাগ্য নির্ণয় করাও হারাম।’ [সূরা মায়েদা : ০৩]।
উল্লেখিত নির্দেশনার সবই ইহজগতের জন্য নির্ধারিত। এসবের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারলে ইহজগৎ ও পরজগতে শান্তির নিশ্চয়তা রয়েছে। ‘এগুলো হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সীমারেখা; যে ব্যক্তি (এর ভেতর থেকে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হবে সেখানে সে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে; এ হবে এক মহাসাফল্য।’ [নিসা : ১৩]। ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দুনিয়াতেই পুরস্কার পেতে চায় তার জেনে রাখা উচিত আল্লাহর কাছে তো ইহকাল-পরকাল উভয় কালের পুরস্কারই রয়েছে; আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও সব কিছু দেখেন।’ [সূরা নিসা : ১৩৪]। কাজেই ইসলাম ধর্ম ইহজাগতিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইহজগৎ ও পরজগতে উচ্চাসনেই থাকবে। সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ এ ব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি।

লেখক : গবেষক

 


আরো সংবাদ



premium cement