২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামে স্বাধীনতার সীমা

-

পৃথিবীতে ভালো মানুষের অভাব নেই। কিন্তু আমরা অনেকেই ভালো মানুষ সেজে, ভালো মানুষের অভিনয় করে, স্বাধীনতার সীমা লঙ্ঘন করছি, পরকালের মহা বিজয়ের কথা ভাবছি না। তাই তো সমাজে ও রাষ্ট্রে টাউট-বাটপার, তৈলবাজ, স্বার্থপর, মিথ্যাবাদী, মোনাফেক, ভ্যাবিচারী, সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, হিংসুক, লোভী, অহঙ্কারী, ভণ্ড আর জুলুমবাজের হাটবাজার। পরিশুদ্ধ সুন্দর মনের, সৎ চিন্তার ও সৎকর্মের ভালো মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
ভালো মানুষ : ভালো মানুষ সত্যের উপাসক। যে নিজে ভালো কর্ম করে এবং অন্যকে ভালো কর্মে উদ্বুদ্ধ করে। ভালো মানুষ অন্যেল ভালো দেখে আনন্দ পায়, অন্যের কষ্টে দুঃখ পায়। মন্দ কর্ম ও গুনাহ থেকে নিজে বাঁচে, অন্যকে বাঁচাতে চেষ্টা করে এবং নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে। রাসূল সা: ভালো মানুষের তিনটি সহজ-সরল চিহ্ন বা পরিচয় উল্লেখ করেছেন : এক. ‘ভালো মানুষকে দেখার সাথে সাথে আল্লাহর কথা মনে হবে, ‘দুই. ‘তার কথা শুনলে তোমার মনের দরজা খুলে যাবে এবং তুমি হেদায়েতের রাস্তা পেয়ে যাবে,’ তিন. ‘তার আমলের বা কর্মের দিকে তাকালে তোমার আখিরাতের জিন্দেগির কথা স্মরণ হয়ে যাবে।’ (ফাজায়েলে আমল)
ভালো মানুষের মোহব্বতে : ভালো মানুষের মহব্বতে (সংসর্গে) জীবন বদলে যায়, আত্মার বিপ্লব ঘটে। দেশী টক আম গাছে আম্রপালি আমের কলম দিয়ে টক ও আঁশযুক্ত আমকে আশহীন মিষ্টি আমে রূপান্তরিত করা সম্ভব, এতে এর স্বাদ-গুণ সবই বদলে যায়। তেমনি ভালো মানুষের মহব্বতে মন্দও ভালো হয়ে যায়। জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তাই মানুষ সৎ ও কর্মঠ ভালো মানুষকে নেতা নির্বাচন করলে, নিজেরা তার মাধ্যমে সুসংগঠিত হয়ে সমাজ ও দেশের কল্যাণে ভালো কাজ করতে পারবে এবং মহা বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
বাইরে সুন্নাহ অন্তরে তাকওয়া : বাইরে নবী সা:-এর সুন্নাহ আর অন্তরে আল্লাহর ভয় বা তাকওয়া মানুষকে আমিত্বের ব্যাধি থেকে রক্ষা করে, উন্নত চরিত্রের অধিকারী করে। তাই ভালো মানুষ হয় ‘তওবাকারী, ইবাদতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, সিয়াম পালনকারী, রুকু ও সিজদাকারী, সৎ কাজের নির্দেশদাতা, অসৎ কাজের নিষেধকারী।’ (সূরা তাওবা ১১২) ভালো মানুষকে নেক সুরতে শয়তান ধোঁকা দিতে ব্যর্থ হয়। ‘লাক্বাদ কানা ফি রাসূলুল্লাহি উসওয়াতুল হামালা।’ রাসূল সা:-এর চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্য (ভালো মানুষের জন্য) উত্তম আর্দশের নমুনা। রাসূল সা:-এর চরিত্র হলো জীবন্ত কুরআন, যা ভালো মানুষ হওয়ার গাইডলাইন। তাঁর মহান চরিত্র ও সুন্নাহ চির আধুনিক এবং সব সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তাঁর মহান চরিত্র ও সুন্নাহ পৃথিবীর যেকোনো সমস্যার কার্যকর প্রতিষেধক। যে তা গ্রহণ করবে সে তাকওয়ার অধিকারী হবে।
স্বাধীনতার সীমাবদ্ধ : মানুষের স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। মানুষ নিজের স্বাধীনতা বা পছন্দ অনুযায়ী পৃথিবীতে আসেনি। যখন তার অস্তিত্ব ছিল না, তখন সে ইচ্ছানুসারে অস্তিত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। আবার মৃত্যুর সময়টাকেও মানুষ স্বাধীনভাবে পিছিয়েও দিতে পারবে না। তাই জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকুতে যে যা ইচ্ছা, তা করতে পারে না। মন চাহে জিন্দেগি পালন করা বা স্বেচ্ছাচারিতার নাম স্বাধীনতা নয়। কোনো স্বাধীন দেশের সরকার তা মেনে নেবে না। আর আল্লাহপাক তো ঘোষণাই করে দিয়েছেন : ‘তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা ছাড়া কোনো ইচ্ছা করতে পারবে না।’ (সূরা তাকাওয়ার-২৯) আল্লাহপাক মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি, কর্মশক্তি, স্বাদ গ্রহণের ও স্বাদ পূরণের স্বাধীনতাও দিয়েছেন, তবে সে স্বাধীনতা সীমাহীন নয়, সীমাবদ্ধ। ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমাগুলোকে রক্ষা করতে হবে।’ (সূরা তাওবা-১১২) ‘আর তোমরা সীমা লঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা দেখেন।’ (সূরা হুদ-১১২) ‘যার ইচ্ছা সে ইমান আনুক, আর যার ইচ্ছা কাফের থাকুক, আমি জালেমদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি জাহান্নামের আগুন।’ (সূরা কাহাফ-২৯) মানুষের স্বাধীন ক্ষমতার প্রতি ক্ষেত্রেই সদ্ব্যবহার করা ভালো মানুষের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই ভালো মানুষ মন চায় জিন্দেগি গঠন করে না, বরং রব চাহে জিন্দেগি গঠন করে এবং স্বাধীনতার সীমা লঙ্ঘন করে না।
ভালো মানুষের নীরবতা : ভালো মানুষগুলোকে আজ সরব ও সুসংগঠিত হতে হবে। নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সৎ, কর্মঠ, দেশপ্রেমিক, চরিত্রবান ও ভালো নেতা নির্বাচন করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ, দলাদলি ও নানা ফেরকায় বিভক্ত হয়ে দুর্বল ও সাহসহারা হওয়া যাবে না। তাহলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে রোজ হাশরে। ভালো মানুষের নিরবতায় আজ সমাজে, দেশে, বিদেশে সর্বত্র অস্বস্তি ও অশান্তি বিরাজ করছে। নিপীড়িত, নির্যাতিত গুম ও খুন হচ্ছে নির্দোষ, সৎ ও ভালো মানুষ। সত্য ও সুন্দরের পতাকা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না মুমিন বান্দারা। তা কিন্তু পৃথিবীবাসীর জন্য সুখকর নয়।
তাই নিজে ভালো মানুষ হয়ে নীরবে ইবাদত করার পাশাপাশি ভালো কর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জরুরি, যা দেখে অন্যেরা উদ্বুদ্ধ হবে। অন্যায়, জুলুম, দুর্নীতি ও মন্দ কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে, নিজেরা সুসংগঠিত হয়ে। জোরালো বয়ানে বা বক্তৃতায়, প্রাণবন্তু লেখায়, সুশিক্ষায়, হেকমতে, উত্তম ব্যবহার দ্বারা ভালো মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করা ভালো মানুষেরই পবিত্র দায়িত্ব। ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। সাবধান! তোমরা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান ১০৩) রাসূল সা:-এর দাওয়াতি মিশনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলÑ ১. ঈমানে আমলে, জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ সৎ ও ভালো মানুষ তৈরি করা, ২. ভালো মানুষগুলোকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে মহাশক্তিতে পরিণত করা, যাতে শয়তানি শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব হয়, ৩. কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে কল্যাণরাষ্ট্র গঠন করে দুনিয়ার সুখ-শান্তি ও পরকালের মুক্তির ব্যবস্থা করা।
মহা বিজয় দিবস : প্রতিটি মানুষের ভেতরে দু’টো সত্তা রয়েছে। একটি পশুসত্তা অন্যটি ফেরেশতা প্রকৃতি। ভালো মানুষ পশুসত্তা মিটিয়ে ফেরেশতা প্রকৃতি। ভালো মানুষ পশুসত্তা মিটিয়ে ফেরেশতাবৃত্তি ফুটিয়ে তোলার জন্যই নিরন্তর সাধনা করে। ইবনে ইলাহির জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে ঈমানি নূর পয়দা করে। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নেক আমলের সিঁড়ি বেয়ে পরমাত্মায় লীন হয়। তখনই মানুষের মধ্যে প্রকাশ পায় পবিত্র সিফাত তথা দয়া, মায়া, মানবপ্রেম, মমত্ববোধ, সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি গুণগুলো। মানুষের চারিত্রিক ও নৈতিক উন্নতি ঘটে। পশুবৃত্তির দোষ হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা, কাম, ক্রোধ, লোভ-মোহ, ইত্যাদি দূরীভূত হয়। মানুষ হয় বড় মনের প্রকৃত ভালো মানুষ। আল্লাহ পাক তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। রোজ হাশরে আল্লাহ তায়ালা তাদের বিজয় ঘোষণা করেন।’ যে আত্মশুদ্ধি লাভ করেছে নিশ্চয়ই সে সফলকাম বা বিজয়ী হয়েছে।’ (সূরা আলা ১৪) ‘(বিচার দিবস) কারো প্রতি অবিচার করা হবে না এবং তোমাদের কেবল তারাই প্রতিদান প্রদান করা হবে (ভালো-মন্দ কর্ম) যা তোমরা করতে।’ (সূরা ইয়াসিন ৫৪) মানুষকে সে দিন তার ভালো-মন্দ কর্মের তিল তিল করে হিসাব দিতে হবে। সে দিন হবে মানুষের জন্য মহাপরাজয় দিবস বা মহান বিজয় দিবস। ‘স্মরণ করো সে দিন তিনি (আল্লাহ) তোমাদিগকে সমবেত করবেন সমাবেশ দিবসে, সেদিন হবে লাভ-লোকসানের দিন।’ (সূরা তাগাবুন ৯) ‘নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের পূর্ণ প্রতিদান কিয়ামত দিবসেই পাবে। অতএব যাকে দোজখ থেকে মুক্তি দেয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, প্রকৃতপক্ষে সেই পূর্ণ সফলকাম বা মহা বিজয়ী।’ (সূরা আলে ইমরান ১৮৫)।
এ বিজয় ক্ষণিকের সীমাবদ্ধ বিজয় বা রাষ্ট্রীয় বিজয় নয়, জীবনের চূড়ান্ত মহা বিজয়, অনন্ত অন্তকালের বিজয়ী। এমন ভালো মানুষগুলো প্রেমভরা দরদি কণ্ঠে ইয়া আল্লাহ, ইয়া রহমান, ইয়া রাহিম বলে ডান দিলে আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দেন। ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।’ (সূরা মুমিন ৬০)।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement