২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জ্ঞান-অনুসন্ধান ও অর্জন

-

‘ঈমানদার লোকদের সবারই (যুদ্ধের জন্য) বহির্গত হওয়া জরুরি ছিল না। কিন্তু এরূপ কেন হলো না যে, তাদের প্রতিটি অংশ থেকে কিছু লোক সামনে অগ্রসর হতো এবং কিছু লোক দ্বীনের সঠিক জ্ঞানার্জনের জন্য পেছনে থেকে যেত; যাতে তারা ফিরে গিয়ে নিজ নিজ এলাকার বাসিন্দাদের সাবধান করত, যেন তারা (অমুসলমানি আচরণ থেকে) বিরত থাকতে পারে।’ (সূরা তাওবা- ১২২)
প্রখ্যাত কুরআন বিশেষজ্ঞ ও ইসলামী চিন্তাবিদ আবু আবদুল্লাহ আল কুরতুবির (মৃত্যু-৬৭১ হিজরি) মতে, ইসলামের যে শিক্ষানীতি, এই আয়াতে তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এবং সেই শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছেÑ ‘তাফাককু ফিদ দ্বীন’, পিকথলের অনুবাদে যাকে বলা হয়েছে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান। ধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সঠিক উপলব্ধি হিসেবেও কথাটি অনূদিত হতে পারে। ‘জ্ঞান’ বা ইলমের (কহড়ষিবফমব) পরিবর্তে ফিকহ বা ‘উপলব্ধি’ (টহফবৎংঃধহফরহম) কথাটা গ্রহণ করার অর্থ হলো, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন সেটা শুধু পঠন-লিখন ক্ষমতা নয়, সেটা হলো অন্তর্দৃষ্টি (রহংরমযঃ) এবং এটা সেই পর্যায়ে পৌঁছতে হবে, যাতে সব অনিষ্ট, অসমতা ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সে একটি শক্তিরূপে ভূমিকা রাখতে পারে। বলা আবশ্যক, বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন বাস্তব প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ কাজে আসে না, বরং নৈরাশ্যকরই হয়ে ওঠে।
আলোচ্য বার্তাটি আপন মূল্যেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট সামনে রাখলে বিষয়টি আরো অধিক গুরুত্বে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। তাবুক অভিযানের অব্যবহিত পরই আয়াতটি অবতীর্ণ; আর স্বয়ং রাসূল মুহাম্মদ সা:-এর নেতৃত্বে এই তাবুক অভিযানই ছিল তখনো পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ রণসমাবেশ। প্রতিপক্ষ ছিল তৎকালীন বিশ্বের দু’টি পরাশক্তির একটি রোমান বাহিনী। এই জিহাদে প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক এবং অবর্ণনীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও সবাই জিহাদে যোগদান করেন। ১০ জন সাহাবি রা: বিরত ছিলেন। কিন্তু আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়ায় তারা ক্ষমা লাভ করেন। সূরা তাওবায় এ ঘটনার বর্ণনা বিদ্যমান; বিশেষ করে এ বিষয়টির ওপর সবিশেষ জোর দেয়া হয়েছে যে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জিহাদের আহ্বান জানানোর সাথে সাথে সাড়া দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা-ই হোক, তার পরই এ আয়াত জানিয়ে দিচ্ছে, শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জিহাদই ইসলামী রাষ্ট্রের একমাত্র অগ্রাধিকার বহন করে না। জ্ঞানের সাধনা ও অনুসন্ধানও এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, যুদ্ধ চলা অবস্থায়ও সমাজের একটি অংশকে অবশ্যই জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত ও নিবিষ্ট থাকতে হবে।
আমরা বেশির ভাগই হজরত আনাস রা: বর্ণিত এই হাদিসটির সাথে পরিচিত : ‘জ্ঞান অনুসন্ধান প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য।’ (ইবনে মাজাহ : ২২০) কিন্তু কী ধরনের ‘জ্ঞান’-এর কথা এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রাসঙ্গিক অন্য একটি হাদিসে :
‘আলেমরাই নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারী। নবী-
রাসূলগণ তাঁদের পশ্চাতে কোনো স্বর্ণ-রৌপ্যের
উত্তরাধিকার রেখে যান না; তাঁরা রেখে যান জ্ঞানৈশ্বর্যের
উত্তরাধিকার। যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করেন, তিনি অর্জন
করেন প্রভূত ঐশ্বর্য’। (তিরমিজি : ২৬০৬)
এই হাদিস থেকে কি এটা প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিটি ব্যক্তি-মুসলমানকেই ধর্মীয় মনীষা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী হতে হবে? না, আদৌ নয়। ব্যক্তি-পুরুষ বা ব্যক্তি-নারীর ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন। সেটা হলো, তাকে তার অপরিহার্য ধর্মীয় কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। ন্যূনতম বিবেচনায়, প্রতিটি মুসলমানকে অবশ্যই ঈমান ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির কী-যথার্থ অর্থ, সেটা শিক্ষা করতে হবে। নারী-পুরুষ সবাইকেই আপনাপন জীবনের সাথে সম্পর্কিত ইসলামী বিধান ও শিক্ষা এবং বিধি-নিষেধ সম্পর্কে অবশ্যই উত্তমরূপে শিক্ষা নিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে মৌলিক নীতি হলো, প্রতিটি ধর্মীয় কর্তব্যের সাথে অবিচ্ছেদ্য বিষয়গুলোর অর্থ ও কার্যকারিতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করাও যথোচিত জ্ঞান ও দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং এভাবেই নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ সম্পর্কিত শরিয়াহ নির্ধারিত যে রীতি ও বিধান, তা আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেয়া কর্তব্য। একজন ব্যবসায়ীর জন্য এটি শিক্ষা করা অবশ্যই ধর্মীয় কর্তব্য যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি-নিয়ম কী এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম কী জিনিস! একজন বিয়ে করবে, এ সময় তার ধর্মীয় কর্তব্য হলো, বিয়ে ও দা¤পত্য-জীবনের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলামের কী শিক্ষা, সে বিষয়ে সম্যক অবহিত হওয়া এবং অন্য সব বিষয়েও একই কথা।
একইভাবে কিছু আত্মিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানও প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তিকে অবশ্যই ঔদ্ধত্য ও অহমিকার প্রকৃতি এবং স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা প্রয়োজন, যাতে তা পরিহার করা যায়। ক্রোধ, ঈর্ষা ও অপকারেচ্ছা বা অনিষ্টকামিতাও একই রকম, যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য কিছু নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন। বিনয়, সহিষ্ণুতা ও কৃতজ্ঞতাবোধ প্রভৃতি কাক্সিক্ষত আত্মিক গুণ সম্পর্কেও একজন ব্যক্তির সম্যক শিক্ষা থাকা অপরিহার্যরূপে আবশ্যক। বলা বাহুল্য, এসব বিষয়ের যে জ্ঞান, ইসলামী সাহিত্যে তা বস্তুতই বিস্ময়কর গভীরতা নিয়ে বিদ্যমান। অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন, এসব বিষয় আপাতভাবে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবস্তু রূপে বিবেচনা করা হয় না। অথচ এটি খুবই সত্য যে, এমন অসংখ্য ঘটনার কথা বর্ণনা করা সম্ভব, যেখানে এ শিক্ষা না থাকায় ‘উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের’ দ্বারা ইসলামী সম্প্রদায় অনেক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
এই জ্ঞান আমাদের বিশেষজ্ঞ তৈরি করে না। দক্ষতা ও সুনিপুণ- সূক্ষ্মজ্ঞান পণ্ডিত ব্যক্তিদের আয়ত্তাধীন; যারা কুরআন-হাদিস, তাফসির (ব্যাখ্যা), আইনশাস্ত্র (ফিকহ), ইতিহাস ও ইসলামী জ্ঞানের আরো বহু বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। সব ইসলামী সম্প্রদায়েই এ ধরনের কিছু বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন, যারা তাদের জীবন গভীর ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইসলামী জ্ঞান আহরণের জন্য উৎসর্গ করেছেন। সবাই নয়, এমন কিছুসংখ্যক নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি থাকলেই অন্য সবাই দায়মুক্ত থাকতে পারে। এ জন্যই একে বলা হয় ‘ফরজে কিফায়াহ’-সামষ্টিক দায়িত্ব।
জীবিকার জন্য সহায়ক কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন, যা বর্তমান সময়ে প্রায় সব শিক্ষারই লক্ষ্যস্থল, শ্রেণীগতভাবে ইসলামে ‘মুবাহর’ (চৎসরংংরনষব) পর্যায়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনো ব্যক্তির জন্যই অবাধ ও পর্যাপ্ত অবকাশ রয়েছে। নিষিদ্ধ বা হারামের পর্যায়ে না পড়লে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো পেশাকে গ্রহণ করতে পারে এবং জীবিকার জন্য পেশ অনুযায়ী শিক্ষাও নিতে পারে। অনুরূপভাবে অনুসন্ধিৎসা বা কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যও কোনো বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণে কোনো বাধা নেই। এটি সুস্পষ্ট যে, সামর্থ্য ও নিজস্ব প্রবণতা বিচারে মানুষ-মানুষে পার্থক্য বিরাজমান; আর এ পার্থক্য শরিয়াহ কর্তৃক অনুমোদনযোগ্য; যে কারণে এ ধরনের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবল কোনো তাগিদও নেই, আবার বাধাদানেরও কোনো আবশ্যকতা নেই। অবশ্য সমস্যা দেখা দেয়, যখন সমাজবিজ্ঞান, এমনকি পদার্থবিদ্যাও যখন ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিত (চবৎংঢ়বপঃরাব) সামনে রেখে শিক্ষাদান করা হয়। কারণ এ ক্ষেত্রে সমাজবিদ্যা বা ইতিহাস অথবা জীববিজ্ঞান, সর্বক্ষেত্রেই মুখোশ পরিহিত ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনই প্রাধান্য লাভ করে। ইসলাম কোনোভাবেই এ ধরনের শিক্ষাকে প্রশ্রয় দেয় না। একজন বিশ্বাসী বা ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই এই শিক্ষা দিতে পারে না যে, মানুষ বানর বা বানরজাতীয় কোনো প্রাণীর বিবর্তিত রূপ। নিশ্চয়ই এ এক বিরাট সমস্যা, যা নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আছে।
বড় ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটে তখন, যখন বিভিন্ন পর্যায়ের ফরজ এবং মুবাহ (অপরিহার্য ও অনুমোদিত) নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়, যা অভাবনীয় ভারসাম্যহীনতার দিকে চালিত করে। কেউ যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করে, হাদিসে বর্ণিত শিক্ষাগ্রহণের দায়িত্ব সে পালন করেছে বলেই ধরে নেয়া যায়, কিন্তু এ কথা কি পুরোপুরি সঠিক? না, সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয়। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ মানের বিজ্ঞানী হতে পারে। প্রকৌশলী হতে পারে এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু সে যদি মৌলিক ও অপরিহার্য ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন না করে, তা হলে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সে তার দায়িত্ব পালন করেনি। ইসলামের দৃষ্টিতে সে একজন অশিক্ষিত ব্যক্তি।
আজ মুসলিম-বিশ্বে এমন লাখ লাখ মানুষ রয়েছে, যারা বহু রকমের বহু ডিগ্রির অধিকারী; কিন্তু তারা কুরআন পাঠ শিক্ষা করেনি, কী করে সালাত আদায় করতে হয় জানে না, এমনকি অজু করতেও জানে না এবং তাদের কোনো ধারণাই নেই, ইসলামের শিক্ষানুযায়ী পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো কিভাবে মোকাবেলা করতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা কী, এ বিষয়ে কজন এমবিএ কিছু জানে? ক’জন মুসলিম চিকিৎসক ইসলামের চিকিৎসা নীতি ও নেতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করেছে? আমরা আসলে ঔপনিবেশিক শিক্ষাপদ্ধতি থেকে উৎপাদিত এমন একশ্রেণীর ফসল, যাকে বলা যায় ‘শিক্ষিত নিরক্ষর’ (ঊফঁপধঃবফ রষষরঃবৎধঃব) বস্তুতপক্ষে আমাদের ‘শিক্ষা’ আমাদের অজ্ঞতাকে যে বোঝে উঠতে দেয় না, এ বিষয়টি আমরা কি জানি ও অনুধাবন করি?
অনুবাদ : অধ্যাপক আবু জাফর


আরো সংবাদ



premium cement
ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৭ বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে?

সকল