২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী রাসূল সা:

-

হজরত আদম আ: থেকে হজরত ঈসা আ: পর্যন্ত যত নবী-রাসূল এসেছেন তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন, শাফিউল মুজনেবীন মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সা:। তিনি নবী ও রাসূলদের সর্দার। তাঁর আগমনে বিশ্ববাসী পেয়েছে আলোর সন্ধান এবং তাঁর শিা ও আদর্শ মানুষকে দিয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাঁর কাছে পেয়েছে তাদের আশার বাণী এবং লাভ করেছে ইহকাল ও পরকালের মুক্তি। আল্লাহপাক রাসূল সা:-কে সারা বিশ্বের জন্য রহমতের প্রতীক হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনÑ ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ অতএব, তিনি বহন করে এনেছেন বিশ্বমানবের জন্য চিরশান্তি ও নাজাতের পয়গাম।
রাসূলে করীম সা:-এর বিশেষ একটি মর্যাদা হলো কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা যত নবীকে ডাক দিয়েছেন, তাঁদের নাম ধরেই ডাক দিয়েছেন। যেমন : ইয়া আদম, ইয়া ইব্রাহিম, ইয়া মুসা, ইয়া নূহ, ইয়া জাকারিয়া; কিন্তু রাসূলে কারিম সা:-কে পুরো কুরআনে কোথাও ‘ইয়া মুহাম্মদ’ বলে নাম ধরে ডাকা হয়নি। তাঁকে ইয়া আইয়্যুহান নবীয়্যু, ইয়া আইয়্যুহাল রাসূলু, ইয়া আইয়্যুহাল মুযাম্মিল, ইয়া আইয়্যুহাল মুদাসসির বলে ডাকা হয়েছে।
সৃষ্টির প্রথম দিন হজরত আদম আ:-কে সৃষ্টি করার পর তাঁর ডান পাশ থেকে সব সন্তানকে আল্লাহ তায়ালা বের করে আনলেন। তখন তারা ছিল পিঁপড়ার মতো। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এ পৃথিবীতে আসবে সবাই আল্লাহ তায়ালা সেদিন একত্র করেছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আলাসতু বিরাব্বিকুম’ আমি কি তোমাদের রব নই? সৃষ্টির সাথে এটিই ছিল সৃষ্টার প্রথম কথা। সেদিন সর্বপ্রথম যিনি এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সা:। এটিও রাসূল সা:-এর একটি বিশেষ মর্যাদা।
আখিরাতে রাসূল সা:-এর মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমি কিয়ামত দিবসে আদম সন্তানদের সর্দার। এতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই। তিনি আরো বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি সর্বপ্রথম কবর থেকে উঠে আসব যখন জমিন বিদীর্ণ হবে। এতে কোনো অহঙ্কার নেই। প্রিয় নবী সা:-এর হাদিসে আরো এসেছে, তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই সর্বপ্রথম কবুল করা হবে। এতে আমার কোনো গর্ব নেই।’ (মুসলিম)।
উবাই ইবন কা’ব রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করিম সা: বলেছেন, যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন আমি হবো নবীদের ইমাম। তাদের কথক এবং তাদের মধ্যে এক অনন্য সুপারিশকারী। এতে আমার কোনো গর্ব নেই। (তিরমিজি)। তিনি আরো বলেছেন, বেহেশতের সর্বোচ্চ সম্মানিত ও প্রশংসিত স্থান তা কেবলমাত্র এক ব্যক্তিই লাভ করবে। আশা করি আমিই হবো সেই ব্যক্তি। (তিরমিজি)।
হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করিম সা: বলেছেন, কিয়ামত দিবসে নবীদের মধ্যে আমিই হবো সর্বাধিক অনুগামী (সুপারিশের জন্য)। আমি বেহেশতের কাছে উপনীত হয়ে দ্বার উন্মোচন করতে বলব। তখন বেহেশতের প্রহরী বলবে, আপনি কে? আমি বলব, আমি মুহাম্মদ। তখন সে বলবে কেবলমাত্র আপনার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আমি অন্য কারো জন্য এ দ্বার উন্মোচন করার নই। (মুসলিম)।
প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা:-কে হজরত আদম আ:-এর আবির্ভাবের অনেক আগেই ঊর্ধ্বজগতে নবুয়তের অভিষেকে অভিষিক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবুয়তের মাধ্যমেই নবুয়তের ধারাবাহিকতার সূচনা করেন এবং তাঁর দ্বারাই পৃথিবীতে নবী আগমনের সমাপ্তি ঘটান। রাসূলে করিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আমি রাসূলদের ভূমিকা এবং নবীদের উপসংহার। এতে আমার কোনো গর্ব নেই।’
রাসূল সা:-এর অতুলনীয় মর্যাদা সম্পর্কে এসেছে, হজরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ আনসারী রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করিম সা: বলেছেন, আমাকে আল্লাহ তায়ালার প থেকে এমন পাঁচটি বিষয় দেয়া হয়েছে, যা আমার আগে আর কাউকে দেয়া হয়নি। এতে আমার কোনো গর্ব নেই। ০১. পূর্ববর্তী নবী-রাসূলরা কোনো বিশেষ জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। আর আমি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি। ০২. আমার জন্য দুনিয়ার সমগ্র মাটি মসজিদের মতো পরিণত করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ জমিনের যেকোনো অংশে উম্মতে মুহাম্মদিয়া যাতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারে। এর আগে অন্য কোনো উম্মতের এ সুযোগ ছিল না। ০৩. আমার জন্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গণিমত) হালাল করে দেয়া হয়েছে। যা আমার আগে কারো জন্য হালাল ছিল না। ০৪. আমাকে সাহায্য করা হয়েছে শত্রুর অন্তরে ভয়ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে। ০৫. আমাকে ব্যাপকভিত্তিক সুপারিশের মতা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে একটি করে বিশেষ সুপারিশের অধিকার দান করেছেন। অন্য নবীরা দুনিয়াতেই সেই অধিকার ব্যবহার করেছেন; কিন্তু আমি বিশেষ সুপারিশের এ অধিকার আমার উম্মতের জন্য সংরণ করেছি। যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করেনি, সে কিয়ামতের দিন এ সুপারিশের ফল লাভ করবে ইনশা আল্লাহ। (বুখারি ও মুসলিম)।
হাশরের ময়দানে রাসূল সা: মর্যাদার যে সুমহান স্থান লাভ করবেন তার নাম হলো মকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থান। সেদিন তাঁকে হাউজে কাওসারের সার্বিক অধিকার দেয়া হবে। নবী সা: এক দিন সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান কাওসার কী? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন রাসূল সা: বললেন, এটা জান্নাতের নহর। আমার প্রভু আমাকে এটি দেবেন বলে অঙ্গীকার বলেছেন। এতে অনেক কল্যাণ রয়েছে। আর আমার উম্মতরা হাশরের সেই ভীষণ দিনে এর থেকে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করবে।
একবার সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে এই আলোচনা হচ্ছিল যে, আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম আ:-কে খলীলুল্লাহ আর আদম আ:-কে শফিয়ুল্লাহ, হজরত ঈসা আ:-কে কালিমাতুল্লাহ ও রুহুল্লাহ এবং মুসা আ:-কে কলিমুল্লাহ উপাধি দিয়েছেন, ঠিক এ মুহূর্তে রাসূল সা: আগমন করেন এবং বলেন আমি হাবিবুল্লাহ। এ জন্য আমার কোনো গর্ব নেই।
কিয়ামতের কঠিন দিনে মানবজাতির প থেকে আল্লাহ তায়ালার দরবারে সুপারিশ করার জন্য অন্যান্য নবী-রাসূলদের অনুরোধ করা হবে; কিন্তু তারা সবাই একই কথা বলবেন, আজ নিজের ব্যাপারে ব্যাকুল হয়েছি, অন্যের ব্যাপারে সুপারিশ করার সাধ্য নেই। কিন্তু একমাত্র রাসূল সা: সেদিন মানবজাতিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলবেন, আমি রয়েছি এর জন্য। আমি তোমাদের জন্য সুপারিশ করব আল্লাহ পাকের দরবারে।
রাসূল সা:-এর বিশেষ আরেকটি মর্যাদা হচ্ছে শবেমিরাজ। এই মিরাজে তিনি সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়ে আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভে ধন্য হয়েছেন। যা অন্য কারো পে সম্ভব হয়নি। যেমন : আল্লাহ তায়ালা বলেন, পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত পরিমাণ বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাঁকে কুদরাতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১)।
সব নবীর ইন্তিকালের মাধ্যমে তাঁদের নবুয়াত শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রাসূলে করিম সা:-এর নবুয়ত তাঁর ওফাতের পরেও শেষ হয়নি; বরং তিনি নবী ছিলেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত নবী থাকবেন। এ জন্য সারা বিশ্বে আজানের সময় দৈনিক পাঁচবার ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ উচ্চারণ করে সমগ্র বিশ্বের আকাশ বাতাসকে মুখরিত করা হয়। এটিও একটি রাসূল সা:-এর বিশেষ মর্যাদা। রাসূল সা: হচ্ছেন হাবিবুল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করেন, ফেরেশতারা দরুদ পাঠ করেন এবং মুমিনদেরও আল্লাহ তায়ালা দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে এসেছে, নিশ্চয় আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করো এবং তাকে যথাযথভাবে সম্মান করো। (সূরা আল আহযাব, ৫৬)।
রাসূলে কারিম সা:-এর উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, ‘ওয়ারাফানা লাকা জিকরাক’ আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি। (সূরা ইনশিরাহ, ৪) রাসূল সা: বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার হাতেই থাকবে আল্লাহ তায়ালার হামদের পতাকা। আদম আ: এবং তাঁর পর যত লোক এসেছে এবং আসবে সবাই আমার পতাকাতলে আশ্রয় নেবে। এটিও রাসূল সা:-এর অন্যতম একটি মর্যাদা।
নাতে রাসূল সা:-এর শ্রেষ্ঠ রূপকার আল্লামা জামির ভাষায়Ñ ‘ইয়া সাহিবাল জামালি, ইয়া সায়্যিদাল বাশার, বি-ওয়াজহিকাল মুনিরি লাকাদ নাওয়্যারাল কামার
লা-য়ুমকিনুস সানাউ কামা কানা হাক্কুহু
বাদ আজ খোদা বুযুর্গ তুয়ি কিসসা মুখতাসর।’
অর্থাৎ : হে জ্যোতির্ময়! হে মানব শ্রেষ্ঠ! আপনার পূত চেহারার দীপ্তি থেকেই চাঁদ আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা আপনার যথোপযুক্ত প্রশংসা করতে অক্ষম; বরং সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এটিই বলতে পারি আল্লাহর পর তাঁর সৃষ্টিকুলে আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান।
আসুন, আমরা রাসূল সা:-এর অতুলনীয় মর্যাদাকে যথাযথ স্থান দেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ

 


আরো সংবাদ



premium cement