২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খুলুকে আজিম

-


‘ওয়া ইন্নাকা লা’আলা খুলুকিন আজিম’ অর্থাৎ এবং নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা কলম, আয়াত-৪) বলেছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আল আমিন, যিনি নিজে সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম। আয়াতে ব্যবহৃত ‘আজিম’ শব্দটি আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর একটি। যার অর্থ আল্লাহ তায়ালা এমন মহান বা বিশাল সত্তা যার মহানত্ব ও বিশালতা সীমা-পরিসীমা আমাদের কল্পনা, চিন্তা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে। অর্থাৎ তিনি সীমা বা আয়ত্বের দুর্বলতা থেকে পবিত্র। রাসূলুল্লাহ সা:-এর নৈতিক চরিত্রের মহানত্ব প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা ‘আজিম’ শব্দ ব্যবহার করে এই কথাই বুঝানো হয়েছে যে, তাঁর চরিত্রের বিশালতাও সীমাহীন। আমাদের কল্পনা, চিন্তা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে।
‘আজিম’ শব্দটি সম্পর্কে শুরুতেই বলা হয়েছে, এটি এমন বিশালতার প্রকাশ ঘটায় যার সীমা-পরিসীমা আমাদের কল্পনা, চিন্তা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে। যা পরিমাপক যন্ত্র আয়ত্ব করতে পারে না। যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও উচ্চতা মানুষের সাধ্যের বাইরে। যেই মানুষ গ্রহ-নক্ষত্র, চাঁদ-সূর্য ও সৌরজগত সম্পর্কে মোটামুটি একটি আনুমানিক ধারণা হলেও আয়ত্ব করতে পেরেছে। আল্লাহর সৃষ্টি জগতে সূর্য হলো একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী সৃষ্টি। আধুনিক আকাশ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞগণ সূর্য সম্পর্কে পরিমাপ করতে পেরেছে যে, সূর্য সমগ্র সৌরজগত নিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২০ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে চলছে। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫ কোটি ৬৬ লাখ মাইল। কিন্তু ‘আজিম’ এর পরিমাপ করা কোনো বিশেষজ্ঞের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়নি।
রাসূল সা:-এর ওফাতের পরপর ভিনদেশী একজন নওমুসলিম মদিনা আগমন করেন। উদ্দেশ্য হলোÑ রাসূল সা:-এর চরিত্র সম্পর্কে জানা। সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত শোকাগ্রস্ত। তিনি যার কাছেই যাচ্ছেন তিনি অন্য একজনকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে ব্যক্তি পরম্পরায় অবশেষে তিনি হজরত আলী রা:-এর কাছে এলেন। তিনি আলী রা:-কে প্রশ্নাকারে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর চরিত্র কেমন ছিল? তখন আলী রা: পাল্টা ওই ব্যক্তিকে বললেন, আচ্ছা আপনি তো রাসূল সা:-এর চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন, তার আগে আপনি পৃথিবীর দ্রব্যসামগ্রীর একটা বর্ণনা আমার কাছে পেশ করুন তো? আগন্তুক আশ্চর্য হয়ে বললেন, তা কি করে সম্ভব হতে পারে? পৃথিবীর দ্রব্যসামগ্রীর বর্ণনা দেয়া কি কারো পক্ষে আদৌ সম্ভব? তখন আলী রা: বললেন, আরে ভাই আল কুরআনে দুনিয়ার দ্রব্যসামগ্রীকে মহান আল্লাহ ‘কালিলা’ বা স্বল্প বলে আখ্যায়িত করেছেন, অথচ আপনি এই স্বল্পের বর্ণনাই দিতে পারছেন না, তাহলে আমি রাসূল সা:-এর চরিত্রের বর্ণনা কিভাবে দেবো যাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে ‘আজিম’ তথা বিশাল বা মহান চরিত্রের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সজ্ঞা দিয়েছেন উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা:। তিনি বলেছেন, কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র। কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে,‘ওয়া লাকাদ আতাইনা সাবয়াম মিনাল মাসানি ওয়াল কুরআনিল আজিম’ অর্থাৎ ‘আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়ে রেখেছি যা বারবার আবৃত্তি করার মতো এবং তোমাকে দান করেছি মহান কুরআন’। (সূরা হিজর, আয়াত-৮৭) কুরআনের বেলায়ও ‘আজিম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ এ এক মহান বা বিশাল কিতাব, যার মহত্ব ও বিশালতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এটি সব কালের জন্য প্রযোজ্য, যা কখনো সেকেলে বা পুরাতন হয় না। সব কালের জন্য এটি নতুনভাবে আবির্র্ভূত হয়। কুরআনের মহত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি যদি এ কুরআন কোনো পাহাড়ের ওপরও অবতীর্ণ করে দিতাম, তাহলে হে নবী! আপনি ল করতেন যে, আল্লাহর ভয়ে ধসে যাচ্ছে, দীর্ণ-বিদীর্ণ হচ্ছে’। (সূরা হাশর, আয়াত-২১) ‘আমি আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে এ আমানত (আল কুরআন) পেশ করলাম। কিন্তু তারা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলো না, তারা ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মানুষ তার স্কন্ধে তুলে নিলো’। (সূরা আহযাব, আয়াত-৭২) ‘অচিরেই আমি তোমার ওপর একটি ভারী কিছু রাখতে যাচ্ছি’। (সূরা মুজাম্মিল, আয়াত-৫)
যেহেতু রাসূল সা: ছিলেন জীবন্ত কুরআন, সেহেতু তাঁর চরিত্রও ছিল মহান। তাঁর চরিত্র বা সুন্নাহ সব কালের জন্য প্রযোজ্য। তাঁর চরিত্র বা সুন্নাহ কখনো সেকেলে বা পুরাতন হয় না। বরং সব যুগে সব কালে রাসূলের চরিত্র ও সুন্নাহ নতুনভাবে কার্য প্রতিষেধক। তাই তাঁর মহান চরিত্র চীর আধুনিক এবং যেকোনো যুগ বা কালের সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে। আর এটিই ‘খুলুকে আজিম’ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ পৃথিবী যখন যেই সমস্যার সম্মুখীন হবে, রাসূল সা:-এর চরিত্র ও সুন্নাহ তখন কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা রাসূল সা:-এর সেই মহান চরিত্র ও সুন্নাহকে ভুলে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তার দ্বারস্থ হই, ফলে সমাধানের পরিবর্তে হাজারো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জালে আবদ্ধ হয়ে জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলি। তাই বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য, পৃথিবীকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য, পৃথিবীকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য ও পৃথিবীকে মানুষের বাস উপযোগী করার জন্য তাদের উচিত হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মহান চরিত্রের অনুসরণ করা। আমি জানি, একটু শান্তির প্রত্যাশায় বিশ^ নেতৃবৃন্দ দিন-রাত মাড়িয়ে চলেছেন। তাদের আন্তরিকতার প্রশ্নে কোনো মন্তব্য না করে তাদের এ চলা যে অনেকটা তারাহীন রাত্রির দিকভ্রান্ত পথিকের মতো তাতে সন্দেহ নেই। শান্তির প্রত্যাশায় প্রয়োগকৃত তাদের হাজারো ভ্রান্ত উদ্যোগ বারবার চপেটাঘাত করে শুধু ফিরিয়েই দিচ্ছে। দুর্ভাগ্য ও দুঃখ তাদের জন্য, যারা দেখে না, বুঝে না অতি নিকট ইতিহাসে ঘটে যাওয়া দিবালোকের মতো স্পষ্ট একজন মানুষ এসেছিলেন নিকষ অন্ধকারে ডুবে থাকা জাজিরাতুল আরবের বুক চিরে, তপ্ত বালুকায় চিক চিক আলোকরশ্মির ঢেউ তুলে মরু সাইমুম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:। তিনি আল্লাহর নির্দেশনায় শত শত বছরের অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুললেন। অন্ধকার দূরীভূত হলো, মানুষ জেগে উঠল একরাশ সোনালি আভায়। পথহারা মানুষ ফিরে পেলো সঠিক পথের দিশা।
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের বিশে^র নেতৃবৃন্দ ও প্রতিটি দেশের শাসকবৃন্দকে আবারো বলছি, সত্যিই আপনারা যদি বিবেকের সাথে প্রতারণায় লিপ্ত না হন, সত্যি সত্যিই পৃথিবীতে বা প্রত্যেকের সংশ্লিষ্ট দেশে সার্বিক শান্তি আনতে চান এবং পৃথিবীকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত করতে চান, যা কোনোক্রমেই পারছেন না, খুব দ্রুত রাসূল সা:-এর আদর্শের কাছে ফিরে আসুন। আবারো জোর দিয়ে বলছি, আপনার রাষ্ট্র ও সমাজ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল হিসেবে শতভাগ গড়ে উঠবে।
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement