২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানবতার নবী মুহাম্মদ সা:

-

সৃষ্টির জন্য সর্বশেষ নিয়ামত মুহাম্মাদুর রাসূল সা:-কে মহান আল্লাহ কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে এমন এক ভূখণ্ডে প্রেরণ করলেন, যা ছিল ধূসর মরু, শস্য, শ্যামলহীন এক অনুর্বর ভূমি। আর এমন কওমের মাঝে প্রেরণ করলেন, যারা দীর্ঘ দিনের অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিল। যদিও চার পাশে ইব্রাহিম, ইসমাইল, নূহ, লুত ও সালেহ আ:-এর জনপদ ছিল; কিন্তু দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর এ জনপদে কোনো হাদির (পথপ্রদর্শক) আবির্ভাব না ঘটায় তখনকার ধর্মীয় ও তামাদ্দুনিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক।
মহানবী সা: খাদিজার বাণিজ্য শুরু থেকে শৈশবেই যে ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্য শুনে, আবেগ-উদ্দীপনা দেখে বনু আমের গোত্রের গোত্রপতি বুখাইয়া বিন কিয়াস এত অভিভূত হলেন যে, তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ লোকদের বললেন, এ যুবককে হাতে পেলে আমি সমগ্র আরব গ্রাস করে ফেলতে পারব। বিশ্বনবীর কৃতিত্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো মানুষকে ভেতর থেকে বদলে দেয়া। মানবতার বন্ধু মহানবী সা:-এর বাণী ও চরিত্র তৎকালীন আরবসমাজ একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারকারীদের অপপ্রচারের মায়াবী প্রভাবকে একেবারেই নি®প্রভ ও পণ্ড করে দিচ্ছিল।
মক্কায় নিজের লোকদের হাতে নির্যাতিত হয়ে এবং নিজের অনুসারীদের ওপর তাঁরই সামনে অমানসিক নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে মনে করলেন, তায়েফের লোকেরা তুলামূলক ভালো হতে পারে, সে বিবেচনায় নিত্যসহচর জায়েদকে নিয়ে তায়েফ গেলেন, সেখানেও চূড়ান্ত নির্যাতিত হলেন।
অবশেষে নিজের বাল্যসাথী হজরত আবু বকর রা:-কে সাথে নিয়ে রাতের আঁধারে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতেও বহু মুজিজা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও ত্যাগের উজ্জ্বল নমুনা পরিদৃষ্ট হলো। ইতঃপূর্বে মদিনাবাসীর সাথে আকাবায় রাসূল সা:-এর সাথে চুক্তি হয়েছিল, তোমরা তোমাদের সন্তান ও পরিবার-পরিজনকে যেভাবে রক্ষা করে থাকো, সেভাবে আমাকেও রক্ষা করবে। তারপর আনসারদের জবাব লক্ষণীয়। আপনি নিশ্চিত থাকুন আমরা যুদ্ধবাজ লোক, কিন্তু শর্ত থাকে যে, শেষ পর্যন্ত বিজয়ের পর আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না তো? রাসূল সা: কর্তৃক আমি তোমাদের এবং তোমরা আমার বলে আশ্বাস দেয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
রাসূল সা:-এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা হচ্ছে মদিনা সনদ। ইহুদিরা ভেবেছিল এই বাস্তুভিটাচ্যুতে সর্বহারা লোকদের তারা অচিরেই নিজেদের অনুগত বানাতে পারবে। এই আশায় তারা মুসলমানদের সাথে তেমন কোনো বাদানুবাদ ছাড়াই চুক্তি সম্পাদন করবে এবং মদিনার যে রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল তাকে মেনে নেয়। রাসূল সা: মদিনার শরণার্থী সমস্যা যেভাবে সমাধান করলেন তা পুরো দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়।
ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল যুক্ত-প্রমাণের শক্তি। ইসলামী আন্দোলনের পরিবর্তে রাসূল সা: যদি পীর-মুরিদির কোনো ব্যবস্থা চালু করতেন তাহলে শ্রোতা বিবেকবুদ্ধিকে অবশ করে দিতেন। এক কথায় ইসলামী আন্দোলনের সর্বপ্রধান কর্তৃত্ব হলো তা মানুষের ওপর শাহে সিয়াতের (বাদশাহীর প্রভুত্ব) চাপিয়ে দেয়া বুদ্ধিভিত্তিক স্থবিরতার অবসান ঘটায়। কেননা বাতিলের বিলুপ্তি ছাড়া সত্যের প্রতিষ্ঠা পুরোপুরি সম্ভব নয়। এখানে আল্লাহর ওপর ঈমান আনা আর তাগুতকে অস্বীকার করা পরস্পর নির্ভরশীল। একটি না করে অন্যটা করা যায় না। পাশাপাশি অসৎ কাজ প্রতিহত না করলে সৎ কাজের আদেশ দেয়া ফলপ্রসূ হয় না। এখানে ‘ইল্লাল্লাহু’ বলার আগে ‘লা ইলাহা’ বলতে হয়। শুধু কথা দিয়েই কোনো কালে কোনো বিপ্লব সাধিত হয়নি। কথা দ্বারা তখনই কিছু প্রভাব সৃষ্টি হয় যখন কাজের মাধ্যমে তার কিছু অর্থ নিশ্চিত হয়। ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত নিছক তাত্ত্বিক বা যুক্তিভিত্তিক দাওয়াত ছিল না। ইসলামের দাওয়াতই ছিল পুরোপুরি কর্মের আহ্বান। রাসূল সা: দুর্ভিক্ষের সময় মক্কায় খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ পাঠিয়ে সেখানকার দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এ জন্য আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, মুহাম্মদ সা: আমাদের লোকদের এভাবে বিপথগামী করতে চাইছে।
মদিনার ইসলামী সরকার ইহুদি ও কুরাইশদের সামরিক হুমকির জবাব যে সাহস ও দৃপ্ততার সাথে দিয়েছে তার উদ্দেশ্য তরবারির জোরে রণাঙ্গনে কিছু লোককে ইসলামে দীক্ষিত করা ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধংদেহী প্রতিরোধ থেকে আত্মরক্ষা করার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের সাহস যেন বাড়ে এবং মদিনার বিপ্লবী শক্তির ওপর যেন তাদের আস্থা জন্মে। নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা শহীদ হয়েছেন এমন সাহাবির সংখ্যা নেহাত কম নয়, বরং বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের মুসলিম শহীদদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি।
নির্যাতন, হিজরত, মদিনার সনদ, হুদায়বিয়ার সন্ধি, সব যুদ্ধবিগ্রহ, মুনাফেক ও ইহুদিদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র, যা হুজুর সা:-এর আন্দোলনকে ঠেকানোর জন্য হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর নুসরত (সাহায্য) সত্য ও জনগণ আল্লাহর নবী সা:-এর পক্ষে থাকায় সবই বিফল হলো।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গারাঙ্গীয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম

 


আরো সংবাদ



premium cement