২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সভ্যতার ইতিহাসে মুহাম্মদ সা:

-


মুহাম্মদ সা:-কে যে মক্কাবাসীরা প্রথমে নবী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলÑ মুহাম্মদ সা:-এর মানুষি অবয়ব ও নবুওয়াত, একাধারে এ দু’টি বিষয় তাদের কাছে মনে হয়েছিল পরস্পরবিরোধী। তারা ধারণা করত, আল্লাহ যদি সর্বমানবের কল্যাণার্থে সত্যের বার্তাবহ কোনো নবীই পাঠাবেন, সেই নবী হবেন কোনো ফেরেশতা। আর যদি আল্লাহ কোনো মানুষকেই নবী হিসেবে মনোনীত করেন, তাহলে সেই মানুষটির হওয়া উচিত এমন, যিনি ধনাঢ্য, রাজক্ষমতা কিংবা অন্য কোনো অভিনবত্বের গুণে সর্বসাধারণের কাছে স্বাভাবিকভাবেই সম্ভ্রম দাবি করতে পারেন। জীবনের শুরু থেকেই যিনি পিতৃমাতৃহীন এতিম ও অসহায়, দারিদ্র্য যাঁর নিত্যসঙ্গী, মুহাম্মদ সা:-এর মতো অতি সাধারণ এমন একটি মানুষ কী করে নবী হবেন! এটি যুগপৎ অসঙ্গত ও অসম্ভব। সত্য যে, বহু সৎগুণের আধার এই মানুষটি; তাই বলে নবুওয়াতের মতো অসাধারণ মুকুট কি তাঁর শিরে শোভা পায়! অতএব বেশির ভাগ মক্কাবাসী এ জন্যও মুহাম্মদ সা:-কে মেনে নিতে পারেনি যে, তিনি ছিলেন সাধারণ, অতি সাধারণ এমন এক মানবসন্তান যাঁর জাগতিক অবস্থান নবুওয়াতের মতো অতি বিশিষ্ট উচ্চাসনের পক্ষে একেবারেই ‘বেমানান’ ও ‘সঙ্গতিহীন’।
‘হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন বিশ্বমানবের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কও।’ সাধের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে মক্কা থেকে যখন হজরত মুহাম্মদ সা: ইয়াসরিবে পা রাখলেন, ইয়াসরিবের জনসমষ্টি তাঁকে অভূতপূর্ব পরিবেশে অত্যন্ত আবেগঘন আবহে স্বাগত জানাল। ইয়াসরিব নগরীর চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শুধু প্রিয়তম বক্তিত্বরূপে আপন করে নিলো তাই নয়; এই নগরীর পরিচালনার সব দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁর নেতৃত্ব অনবত মস্তকে স্বীকার করে নিলো। এই স্বীকৃতির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ইয়াসরিবের জনগণ তাদের প্রিয় নগরীর নামকরণ করল মদিনাতুন্নবী অথবা মদিনাতুর রাসূল। দিনটি ১২ রবিউল আউয়াল। খ্রিষ্টীয় ৬২২ অব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের খ্যাতনামা দর্শনিক জন লক যে তত্ত্বের ভিত্তিতে বলেছিলেনÑ ‘সেই রাষ্ট্রই সর্বশ্রেষ্ঠ যা শাসিতদের সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে মদিনায় ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে এবং এই অনবদ্য সৃষ্টির মূলে ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মনীষী হজরত মুহাম্মদ সা:। এই নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবীর নেতৃত্বে মসজিদে নববী। এই মসজিদই ছিল গণতান্ত্রিক মদিনা রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রাণকেন্দ্র। আইন প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং ন্যায়নীতির শীর্ষস্থান, বিচার বিভাগের শীর্ষস্থান।
মদিনা রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল মদিনা সনদ-৫৩ অনুচ্ছেদ সংবলিত লিখিত সংবিধান। এর ভূমিকায় সনদকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘কিতাব’ রূপে এবং আধুনিক অর্থে সংবিধান। সনদের ২৩, ৪০, ৪৬ ও ৫১ অনুচ্ছেদে সনদকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সহিফা’ হিসেবে এবং আধুনিক অর্থে তাও হলো সংবিধান। প্রকৃত প্রস্তাবে মদিনা সনদ ছিল একটি সংবিধান এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটিই হলো সর্বপ্রথম লিখিত পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। পাশ্চাত্যের প্রচারণায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতায় এবং মুসলিম পণ্ডিতদের ঔদাসীন্যের ফলে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের ছাত্রছাত্রীরা জানে, আমেরিকার সংবিধানই সমগ্র বিশ্বের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ১৭৮৯ সালে এর প্রায় সাড়ে ১১ শ’ বছর আগেই রচিত হয়েছে মদিনা সনদ। রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক রাষ্ট্রনায়ক, শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় বিভূষিত একজন জননেতা। যদি তিনি চাইতেন তিনি হতে পারতেন পরম পরাক্রমশালী সম্রাট। হতে পারতেন প্রবল প্রতাপান্বিত বাদশাহ। মহামহিম সুলতান। আর তখনকার এটিই ছিল নিয়ম। সূচনা করতে পারতেন রোমান সম্রাটদের অথবা পারস্য সম্রাটের মতো অথবা চীনের রাজাধিরাজের মতো, মিসরের ফেরাউনের মতো এক পারিবারিক ধারা। সাধারণ রাজনীতিকেরা সব সময় বর্তমানকালেই বসবাস করেন। তাদের দৃষ্টি থাকে ক্ষমতার দিকে এবং ক্ষমতাপ্রসূত সুযোগ-সুবিধা অথবা বৈভব-প্রভাবের দিকে। দৃষ্টি থাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অথবা পারিবারিক পর্যায়ে বিলাসিতার দিকে। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক। বর্তমানে বসবাস করেও তিনি দৃষ্টি রেখিছিলেন মানবজাতির ভবিষ্যতের দিকে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। মানবজাতির ঐক্য-সংহতির দিকেই তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন।
মানবজাতির শিক্ষক এই মহামানবের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পর্যালোচনার আগে তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ও অত্যন্ত সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। হেরা গুহায় তাঁর ধ্যানমগ্নতা, তারপর বাস্তবতার জগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন, এক কথায় পারমার্থিকতা এবং যুক্তির তথা আধ্যাত্মিকতা ও কর্মনিষ্ঠার সুষ্ঠু সমন্বয়Ñ এই হলো এক দিকে যেমন তার জীবনের সৌন্দর্য, তেমনি ইসলামের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান। মরমিবাদ দিয়ে যার শুরু, রাষ্ট্রের মধ্যে তার পরিপূর্ণতা। এই তো মানবজীবনের সারবত্তা। এই সারবত্তার মূর্ত রূপ হলেন আদর্শ মানব হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন। এক অর্থে, এ তো এক পরশমণি। এর স্পর্শে সব কিছুই সোনা হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব যে অসাধারণ তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
ইসলাম ধর্মে মূর্খতা ও নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এবং জ্ঞান ও জ্ঞানীদের যথাযোগ্য মর্যাদার বিধান করা হয়েছে। জ্ঞানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে অবগত হতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ঘোষণাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ)।
এতটুকু জেনে রাখাই যথেষ্ট যে, প্রিয় নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সা:-এর ওপর অবতীর্ণ প্রথম আসমানি বাণীতে আবৃত্তি ও কলম এবং কলমের সাহায্যে জ্ঞানচর্চার সুমহান মর্যাদার কথা উচ্চকণ্ঠে ব্যক্ত করা হয়েছে। মানবতার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত এ ধর্মের প্রথম আহ্বান ছিল নিম্নরূপ :
‘পড়–ন (হে মুহাম্মদ), আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে; পড়–ন, আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলম দ্বারা জ্ঞান দান করেছেন। মানুষ যা জানত না তা তিনি তাকে শিখিয়েছেন।’ (সূরা আলাক : ১-৫)।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাঁর অনুসৃত রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো বিষয়ে শপথ করেছেন। এর উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। ক. শপথকৃত বিষয়টির মাহাত্ম্য ও বিপুল উপকারের ব্যাপারে সচেতন করা। খ. তাঁর প্রতি সৃষ্টিকুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর অক্ষরজ্ঞান ছিল না। তিনি লিখিত কোনো কিছু পড়তে পারতেন না এবং কিছু লিখতেও সক্ষম ছিলেন না। কারণ যদি তিনি লেখাপড়া জানতেন, তবে মিথ্যাবাদীদের জন্য কুরআন ঐশীগ্রন্থ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকত। তারা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিত, কুরআন কোনো আসমানি কিতাব নয়। বরং তা মুহাম্মদ সা:-এর অধ্যায়ন-গবেষণার ফসল কিংবা পূর্ববর্তী ইঞ্জিল ও তাওরাত অবলম্বনে রচিত। কিন্তু একজন নিরক্ষর ও লেখাপড়ার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ও উম্মি নবী রাসূলুল্লাহ সা:-এর শিক্ষাকার্যক্রম আপনাকে কেবল বিস্ময়ের জগতেই নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা: জাতিকে লেখাপড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার নিমিত্তে কেবল শিক্ষা দর্শন প্রচারেই ব্যাপৃত ছিলেন তা নয়, বরং নিরক্ষরতা প্রতিরোধ ও শিক্ষা সম্প্রসারণের যাবতীয় কার্যকর উপায় উদ্ভাবনের জন্যও নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
তিনি মানুষকে দেখেছেন সব যুগ ও পরিবেশের আলোকে। একই সাথে তার জীবনযাপনের জন্য এমন নৈতিক ও ধর্মগত পথনির্দেশনা দান করেছেন, যা সর্বকালে সর্বাবস্থায় একইভাবে খাপ খেয়ে যায়। তিনি সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত নন, ইতিহাস যাদের সেকেলে লোকদের তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের পরিচয় আমরা এভাবে দিতে পারিÑ তারা সে যুগের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক ছিলেন। মানবতার জন্য সবচেয়ে ব্যতিক্রম এবং বিশিষ্ট নেতা হলেন ওই ব্যক্তি যিনি ইতিহাসের চলমান ধারার সাথে এগিয়ে যেতে পারেন। যিনি তার যুগের যেমন আদর্শ ও উত্তম নেতা তেমনি প্রত্যেক যুগেই তিনি আধুনিক নেতা প্রমাণিত হন; যেমনÑ তার আগের যুগে ছিলেন। আপনি যাদের উদারতার সাথে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বলে আখ্যায়িত করেন প্রকৃতপক্ষে তারা ইতিহাসের সৃষ্টি; সমগ্র মানবেতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব একজনই। পৃথিবীর ইতিহাসে যত নেতাই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তার অবস্থার ওপর পর্যালোচনার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে লক্ষ করবেন যে, কার্যকারণ বা উপাদানগুলো স্বয়ং বিপ্লবের লক্ষ্য ও পন্থা নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। বিপ্লবের নায়ক শুধু এতটুকু ভূমিকা পালন করেছেন, সময়ের চাহিদানুযায়ী বিপ্লবের দিক ও পথ নির্দেশ করেছিলেন। বিপ্লবের নেতা অবস্থা ও পরিবেশের চাহিদাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য এমন একজন অভিনেতার ভূমিকা পালন করেছেন যার জন্য মঞ্চ আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ইতিহাস ও বিপ্লব সৃষ্টিকারী উভয় শ্রেণীর মধ্যে মহানবী সা: এমন ব্যক্তি যেখানে বিপ্লবের উপাদান বিদ্যমান ছিল না, সে ক্ষেত্রে তিনি নিজেই বিপ্লবের উপাদান ও কার্যকারণগুলো উদ্ভাবন করেন যেখানে লোকদের মধ্যে বিপ্লবের সৃষ্টি এবং কর্মক্ষমতার মধ্যে বর্তমান ছিল না সেখানে তার নিজস্ব চেষ্টায় বিপ্লবের উপযোগী লোক তৈরি করেন, নিজের প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বকে দ্রবীভূত করে সহস্র মানুষের দেহে প্রবিষ্ট করিয়ে তাদের এবং তাদের নিজের মনের মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন। এমনই একজন ইতিহাস স্র্রষ্টা এবং এ ধরনের বিপ্লবী মানুষ মানবেতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement
মধুখালীর ঘটনায় সঠিক তদন্ত দাবি হেফাজতের ফর্মে ফিরলেন শান্ত জামায়াতের ৫ নেতাকর্মীকে পুলিশে সোপর্দ যুবলীগ কর্মীদের, নিন্দা গোলাম পরওয়ারের চায়ের সাথে চেতনানাশক খাইয়ে স্বর্ণালঙ্কার চুরি ঈশ্বরগঞ্জে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার ফারজানাকে সংবর্ধনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে‘ভিত্তিহীন' তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের মোদির মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় সংখ্যালঘু নেতাকে বহিষ্কার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নতুন কনসাল জেনারেল সেহেলী সাবরীন চান্দিনায় পানিতে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশু মৃত্যু কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ

সকল