১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

মহানবী সা:-এর মহানুভবতা

-


হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’। (সূরা আল-আহযাব : ২১) তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-বিনম্রতা, সত্যনিষ্ঠা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বর্বর আরব জাতির আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তুমি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত’। (সূরা আল-কালাম : ৪) মুহাম্মদ সা: জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাঁকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি’। (মিশকাত)
হিলফুল ফুজুুল গঠন : তৎকালীন সমাজের শোচনীয় অবস্থা দর্শণে মহানবী সা: ব্যথিত হন। এ অবস্থা পরিবর্তনে ১৭ বছর বয়সে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর চাচা জোবায়েরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ‘হিলফুল ফুজুুল’ নামে একটি সেবাসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের দুর্বল, নিরীহ, দরিদ্র, বিধবা ও অসহায় মানুষকে সাহায্য করা, অন্যায়-দুষ্কর্ম প্রতিরোধ করা। মানুষে মানুষে, সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। নবুওয়াত লাভের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর এভাবেই তিনি সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে মহানুভবতার স্বাক্ষর রাখেন।
হজরে আসওয়াদ স্থাপন : ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে কাবাঘর সংস্কারের সময় কুরাইশরা ‘হজরে আসওয়াদ’কে কেন্দ্র করে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে আগায়। গোত্রপতিরা এ মর্মে শপথ করেন, প্রয়োজনে আমরা প্রাণ দেবো তবুও হজরে আসওয়াদ অন্য কোনো গোত্রকে সংস্থাপন করতে দেবো না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুহাম্মদ সা:-এর উপর মীমাংসার ভার ন্যস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ সা: সমস্ত ঘটনা শুনে নিজেই একখানা চাদরের ওপর হজরে আসওয়াদ সংস্থাপন করলেন এবং গোত্রপ্রধানদের হজরে আসওয়াদসহ ওই চাদরটি নবনির্মিত কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্বকোণে আনতে বললেন। অতঃপর তিনি স্বয়ং চাদর থেকে তা উঠিয়ে যথাস্থানে সংস্থাপন করলেন। এতে সবাই খুশি হলেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ সা: এক অনিবার্য ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে সমাজকে রক্ষা করলেন।
মুহাম্মদ সা:-এর মহানুভবতা : মুহাম্মদ সা: সবসময় মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন ও সদালাপ করতেন। তাঁর মধুর বচনে সবাই অভিভূত হতো। তিনি জনগণকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো, ুধার্তকে খাদ্য দাও, সালামের বহুল প্রচলন করো এবং এসব কাজের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করো’। (সহিহ বুখারি)
রাসূলুল্লাহ সা:-এ মহানুভবতায় সিক্ত হজরত আনাস রা: বলেন, ‘আমি ১০ বছর রাসূলুল্লাহ সা:-এর খেদমত করেছি। আমার কোনো কাজে আপত্তি করে তিনি কখনো বলেননি, এমন কেন করলে? বা এমন করোনি কেন?’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
উকাজ মেলা থেকে জায়েদকে কিনে এনেছিলেন হজরত খাদিজা রা:। তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর স্নেহ-মমতায় বড় হতে লাগলেন। বাবা-চাচা তাঁকে বিপুল ধনসম্পদের বিনিময়ে ফেরত নিতে এলে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সত্ত্বেও তিনি তাদের সাথে যাননি। বরং তাদেরকে বলেছিলেন, আমি মহান ব্যক্তির মহানুভবতা সম্পর্কে অবগত। তাঁর সান্নিধ্যের বিনিময়ে দুনিয়ার অন্য কোনো সান্নিধ্য আমার কাম্য নয়’। (মিশকাত)
অমুসলিমদের প্রতি মহানুভবতা : মুহাম্মদ সা: অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিলেন। নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। কোনো দিন তাঁর প্রচারিত ধর্ম কোনো অমুসলিমের প্রতি চাপিয়ে দেননি। তিনি তার প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাতেন। এ জন্য তিনি জীবনে অনেক যাতনা-লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, কিন্তু কোনো দিনই ব্যক্তিগত কারণে কোনো অমুসলিমের প্রতি প্রতিশোধ নেননি। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে কোনো অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিলো আমি তার (অমুসলিমের) বাদি হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো, কিয়ামতের দিনে আমি হবো বিজয়ী’।
অমুসলিমদের নিরাপত্তার ব্যাপারে বলেছেন, ‘তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধনসম্পদ আমাদের ধনসম্পদের মতো।’
কিছু দৃষ্টান্ত : এক ইহুদি কিশোর রাসূলুল্লাহ সা:-এর খেদমত করত। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সা: তাকে দেখতে গেলেন। তার শিয়রে বসলেন। তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন। সে তখন নিজের বাবার দিকে তাকাল। বাবা বলল, তুমি আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও। এবার ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করল। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় বললেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহর। তিনি ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছেন’। (সহিহ বুখারি)
একবার নাজরানের একদল নাছারা মুহাম্মদ সা:-এর কাছে মেহমান হিসেবে আগমন করে। তিনি তাদের মসজিদে নববীতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি তাদেরকে তাদের নিয়ম অনুযায়ী সেখানে উপাসনা করার জন্য এবং নিজ এলাকায় গির্জা নির্মাণ, মেরামত ও পাদ্রি নিয়োগের অনুমতি দিয়েছিলেন।
শত্রুদের প্রতি মহানুভবতা : ইসলামের চরম শত্রুদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ যেন ইসলামের দিকে ধাবিত করেন এ জন্য দোয়া করতেন মহানবী সা:। কেউ ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস কামনা করলেও তিনি তাদের জন্য দোয়া করতেন। আবু হুরায়রা রা: বলেন, একদা আবুত তোফায়েল ও তার সঙ্গীরা এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (ইয়েমেনের) দাউস গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং কুফরি করেছে। আপনি তাদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করুন। উপস্থিত লোকেরা বলতে লাগল ‘দাউসের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে। দাউস ধ্বংস হয়ে গেছে। নবী সা: বদদোয়া না করে তাদের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি দাউস গোত্রের লোকদের হেদায়েত দিন এবং তাদেরকে (আমার কাছে) এনে দিন। (সহিহ বুখারি)
উপসংহার : মহানবী সা:-এর উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে কাফের-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। ফলে শত বাধা-বিপত্তি ও বিপদসঙ্কুুল পথ পাড়ি দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলাম বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজো মুহাম্মদ সা:-এর মহানুভবতার আলোকে নিজেদের জীবনকে গড়ে তুললে সর্বত্র শান্তি নিশ্চিত হবে ইনশা আল্লাহ।
লেখক : গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement