২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হালাল-হারাম ঘোষণার অধিকার

-


হালাল-হারাম ঘোষণা করার অধিকার কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার। সৃষ্টির হাত থেকে এ কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনের বা বৈষয়িকতার দৃষ্টিতে তার মর্যাদা যাই হোক না কেন, এ অধিকার কারোরই নেই। এ কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহর অধিকার বলে স্বীকৃতব্য। আলেম, পীর-দরবেশ, রাজা-বাদশাহ, নেতা, আল্লাহর বান্দাদের ওপর কোনো কিছু হারাম করার কোনো অধিকার কারো নেই। যদি কেউ তা করার দুঃসাহস করে, তা হলে বুঝবে হবে সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করছে। দ্বীনি আইন-বিধান প্রণয়নে আল্লাহর নিরঙ্কুশ অধিকারকে যারা কেড়ে নিতে চাচ্ছে, তাদের এ কাজকে যারা খুশি মনে মেনে নেবে ও গ্রহণ করবে, অনুসরণ করবে, তারা আল্লাহর সাথে তাদের শরিক করার মতো মারাত্মক অপরাধ করবে। শিরকের এ অপরাধ আল্লাহ কিছুতেই মা করবেন না। সূরা আশশুরার পূর্বোদ্ধৃত আয়াতটি এখানেও পঠিতব্য :
ওদের কি এমন শরিক বা উপাস্য আছে নাকি, যারা ওদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান রচনা করে দিচ্ছে, যার জন্য আল্লাহ কোনো অনুমতিই দেননি? ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা হালাল-হারাম নির্ধারণের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব দিয়েছিল তাদের পাদ্রি ও পণ্ডিতদের। কুরআন মজিদ এ দিকে ইঙ্গত করেই বলেছে : ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওদের পাদ্রি-পণ্ডিতদের খোদা বানিয়ে নিয়েছে আর ঈসা মসিহকে। অথচ ওদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব ও বন্দেগি করতে। আসলে সে আল্লাহ ছাড়া ইলাহ আর কেউ নয়Ñ নেই। তিনি সর্বাত্মকভাবে পবিত্র, ওদের শিরকের অনেক ঊর্ধ্বে তিনি। (সূরা তাওবা : ৩১)
আলী ইবনে হাতিম পূর্বে খ্রিষ্টধর্ম অবলম্বনকারী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে যখন দেখতে পেলেন, নবী করিম সা: ওই আয়াত পড়ছেন, তখন তিনি বললেন: হে রাসূল! ওরা তো ওদের পাদ্রি-পণ্ডিতদের ইবাদত করেনি?
রাসূলে করিম সা: জবাবে বললেন, ‘তাই নাকি? এ পাদ্রি-পণ্ডিতরাই তো ওদের জন্য হালাল-হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং ওরা তাই সাগ্রহে ঐকান্তিকভাবে মেনে নিয়েছে। আর কুরআনে এটাকেই বলা হয়েছে ওদের ‘ইবাদত’ অর্থাৎ এ রূপ করাই ইবাদত। ‘ইবাদত’ বলতে যা বোঝায়, তা ওরা করেছে সেই পাদ্রি-পণ্ডিতদের। (তিরমিজি) মুশরিকদের সম্পর্কে কুরআন মজিদে বলা হয়েছেÑ ‘তারা আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে নিজেরাই হালাল-হারাম নির্ধারণ করেছে।’
ইরশাদ করা হয়েছে : ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদের রিজিক দিয়েছেন, তার মধ্যে হালাল-হারাম তোমরা নির্ধারিত করে নিয়েছে? রব, আল্লাহ কি তোমাদের তা করার অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছ?’ (সূরা ইউনুস : ৫৯)
আল্লাহ আরো বলেছেন : ‘তোমাদের মুখে যা আসে তাই বলে দিও নাÑ এটা হালাল ও এটা হারাম। এতে আল্লাহর নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা চালানো হবে। আর যারাই আল্লাহর নামে এ ধরনের মিথ্যা কথা প্রচার করে, তারা কখনই কল্যাণ বা সাফল্য লাভ করতে পারে না।’ (সূরা নহল : ১১৬)
এসব সুস্পষ্ট অকাট্য আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে ও বুঝতে পারা যায় যে, হালাল-হারাম নির্ধারণ ও ঘোষণার একমাত্র অধিকার মহান আল্লাহর। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এ অধিকার অন্য কারো নেই, থাকতে পারে না। তিনি নিজেই এ কাজ করেছেন এবং তা তিনি তাঁর নিজের কালাম কুরআন মজিদে বলে দিয়েছেন, না হয় তাঁর নবী-রাসূলের বাণীতে ঘোষণা করিয়েছেন। হালাম-হারামকরণ পর্যায়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে লঙ্ঘন করার কোনো অধিকারই কারো নেই। ফিকাহবিদরা তা করেনও নি। কুরআন মজিদে বলেই দেয়া হয়েছে : ‘আল্লাহ যা কিছু তোমাদের জন্য হারাম করেছেন তা তিনি নিজেই সুস্পষ্ট ও ভিন্ন ভিন্ন করে তোমাদের জন্য বলে দিয়েছেন।’ (সূরা আন’আম : ১১৯)
বস্তুত হালাল-হারাম নির্ধারণও কী জায়েজ, কী নাজায়েজ, তা মৌলিকভাবে ও নিজস্ব মর্জি অনুযায়ী চিহ্নিত করার কোনো অধিকার বা কর্তৃত্বই ফিকাহবিদদের নেই। কেননা এটা তো দ্বীনি শরিয়ত রচনাপর্যায়ের কাজ। ফিকাহবিদরা ইজতিহাদ করতে পারেন, শরিয়তের ব্যাপারে তাদের মতামত-নেতৃত্ব স্বীকৃতব্য। ঈমাম শাফেয়ি তার ‘আলিফ-লাম-মিম’ গ্রন্থে ঈমাম আবু হানিফার ছাত্র কামি আল ইউসুফের কথা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘আমি বিপুলসংখ্যক সুবিজ্ঞ ও দ্বীন পারদর্শীদের দেখেছি। তারা ফতোয়া দেয়া পছন্দ করেন না। কোনো জিনসকে তারা সরাসরি হালাল বা হারাম বলার পরিবর্তে কুরআনে যা আছে, কোনোরূপ ব্যাখ্যা ছাড়া তা বলে দেয়াকেই যথেষ্ট মনে করতেন। বিশিষ্ট তাবেয়ি আলেম ইবনুস সায়েব বলেছেন: তোমরা সে রকম লোক হবে না যে বলে, আল্লাহ অমুক জিনিসটি হালাল করেছেন কিংবা এটা আল্লাহর খুব পছন্দ। কেননা কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘না আমি ওটাকে হালাল করেছিলাম, আর না ওটা আমার পছন্দ ছিল।’ তেমনি সে ব্যক্তির মতোও যেন তোমার অবস্থা না হয়, যে বলে ‘অমুক জিনিসটা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন।’ কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘তুই মিথ্যাবাদী, আমি তো ওটাকে হারাম করিনি ও কাজ করতে নিষেধও করে দেইনি। কুফার প্রখ্যাত তাবেয়ি ফিকাহবিশারদ ইবরাহিম নখয়ি সম্পর্কে উদ্ধৃত হয়েছে, তার ছাত্র-শাগরেদরা যখন ফতোয়া দিতেন, তখন এটা মাকরূহ কিংবা এতে কোনো দোষ নেই, প্রভৃতি ধরনের কথা বলতেন। কেননা কোনো জিনিসকে হালাল বা হারাম বলে নির্ধারণ করার মতো দায়িত্বহীন কাজ আর কিছু হতে পারে না।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন : যে জিনিসটার হারাম হওয়ার কথা নিশ্চিত-নির্দিষ্ট-অকাট্যভাবে জানা গেছে, কেবল সেই জিনিসটা ছাড়া অন্য কোনো জিনিসের ক্ষেত্রে প্রাথমিককালের মনীষীরা কখনো হারাম শব্দটি প্রয়োগ করতেন না। অনুরূপভাবে ইমাম ইহমদ ইবনে হাম্বল র:-কে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলতেন : ‘আমি ওটাকে মাকরূহ মনে করি অথবা আমি ওটাকে ভালো মনে করি না বা পছন্দ করি না’ ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা ও অন্যান্য ইমামদের সম্পর্কেও এ কথাই সত্য।
অনুবাদ : মুহাম্মদ আবদুর রহীম


আরো সংবাদ



premium cement