২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তাওবার বিধান

-

বিশুদ্ধ, খাঁটি বা পরিপূর্ণ ইবাদতই আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। তাওবার েেত্রও আল্লাহ তায়ালা বিশুদ্ধভাবে তাওবা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা তোমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে বিশুদ্ধভাবে তাওবা করো। আশা করা যায়, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পাপগুলো মা করে দেবেন এবং তোমাদের এমন এক জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নিম্নদেশে বহু ঝরনা প্রবাহিত হবে। এটা সেই দিবসের কথা, যেদিন আল্লাহ তাঁর নবী, তাঁর ঈমানদার সাথীদের লাঞ্ছিত করবেন না।’ (সূরা তাহরিম : ৮)
বিশুদ্ধ বা খাঁটি তাওবা কী? এ ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে সবগুলোর মতের সার নির্যাস একই। হজরত নুমান ইবনে বাশির রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি ওমর রা:-কে বলতে শুনেছেন, ‘হে ঈমানদার বান্দারা তোমরা আল্লাহর কাছে এমনভাবে তাওবা করো, যা দিয়ে আর পাপকাজের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’ অন্য বর্ণনায় আছে, ওই পাপকাজের আর ইচ্ছাও করবে না। পূর্ববর্তী আলেমরা বলেন, গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর তাওবা করা, লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া, পরবর্তীতে আর এ পাপকাজ করবে না বলে দৃঢ় সঙ্কল্প করাই হলো খাঁটি বা বিশুদ্ধ তাওবা। ওবাই ইবনে কা’ব রা:-কে প্রশ্ন করা হলোÑ খাঁটি তাওবা কী? তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:-কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাসূল সা: বলেন, ‘ভুলক্রমে গুনাহ হয়ে গেছে তার জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হওয়া, আল্লাহর কাছে মা চাওয়া এবং ওই গুনাহের প্রতি আর ঝুঁকে না পড়া।’ হাসান রা: বলেন, ‘বিশুদ্ধ তাওবা হলো, যে পাপের প্রতি আকর্ষণ ছিল, তার প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়া, যখন ওই পাপের কথা মনে হয়, তখন আল্লাহর কাছে মা প্রার্থনা করা।’ বিশুদ্ধ তাওবার শর্ত হলোÑ তাওবাকারী মৃত্যু পর্যন্ত আর এই পাপকাজ করবে না। কালবি রা: বলেন, ‘বিশুদ্ধ তাওবা হলোÑ মুখে মা প্রার্থনা করা, অন্তরে অনুতপ্ত হওয়া আর অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে পাপমুক্ত রাখা।’ ইমাম কুরতুবি রা: বিশুদ্ধ তাওবার সংজ্ঞায় বলেন, ‘মুখে মা প্রার্থনা করা, অন্তরে অনুতপ্ত হওয়া, পুনরায় পাপ না করার সঙ্কল্প করা ও অসৎ বন্ধুর বন্ধুত্ব ত্যাগ করা।’ ইমাম বায়যাবি রা: বলেন, বিশুদ্ধ তাওবা সম্পর্কে আলী রা: প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিশুদ্ধ তাওবা হলো ছয়টি গুণের সমম্বিত অবস্থা, ১. কৃত পাপের জন্য অনুশোচনা; ২. ত্যাগকৃত ফরজ দায়িত্বগুলো আদায় করা; ৩. অন্যের হক পরিশোধ করা; ৪. যাকে কষ্ট দেয়া হয়েছে তার কাছে মাফ চাওয়া; ৫. পুনরায় পাপ না করার দৃঢ় সঙ্কল্প, ৬. আল্লাহর আনুগত্যে প্রতিষ্ঠিত থেকে আত্মশুদ্ধি অর্জন।’ ইমাম গাজ্জালি রা: বলেন, ‘বিশুদ্ধ তাওবা হলোÑ মন্দ কর্ম দূরীভূত হওয়ার সাথে সাথে ভালো কর্মের দিকে আকৃষ্ট হওয়া।’
খাঁটি তাওবা হলোÑ একটি মানুষ এমনভাবে তাওবা করবে, তার তাওবার মধ্যে লোক দেখানো বা রিয়াকারীর ভাব, মুনাফেকি বা কপটতার লেশমাত্র থাকবে না। ব্যক্তি নিজে অনুতপ্ত হয়ে তার নিজের জন্য কল্যাণ কামনা করতে থাকবে। গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে মারাত্মক পরিণতি থেকে হেফাজত করবে। অথবা গুনাহ করার কারণে তার ইবাদতে যে ফাটল ধরা দিয়েছে, তাওবা করে তা মেরামত বা সংশোধন করবে। তাওবা করে সে নিজেকে এতটা মর্যাদা সম্পন্ন, আলোকিত করবে অন্য লোক তাকে দেখে দ্বীনের পথে আকৃষ্ট হবে। তাকে অন্য মানুষ দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করবে। তাফসিরে ইবনে আব্বাসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা করো পাপরাশি থেকে বিশুদ্ধ বা খাঁটি তাওবা অন্তরের সততার সাথে। আর তা হচ্ছেÑ অন্তরে অনুতপ্ত হওয়া, মুখে মা চাওয়া, দৈহিক ও আন্তরিকভাবে সে কাজ থেকে ফিরে আসা যে, কখনো আর সে দিকে যাবে না।’
বাগাবি রা: বলেন, ওমর রা: ও আবু মুয়ায রা: বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ তাওবা হচ্ছেÑ গুনাহ থেকে তাওবা করে পুনরায় গুনাহের দিকে ধাবিত না হওয়া। যেমন দুধ স্তনের দিকে কখনো ফিরে যায় না।’ হাসান বসরি রা: বলেন, ‘অতীতের পাপাচারের জন্য লজ্জিত হওয়া এবং ভবিষ্যতে গুনাহ না করার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প করাই হলো তাওবাতুন নাসুহা। আল কারখি রা: বলেন, ‘তিনটি জিনিসের সমষ্টি হচ্ছে তাওবাতুন নাসুহা।’ মুখে মাফ চাওয়া, অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে গুনাহ থেকে বিরত রাখা এবং পুনরায় গুনাহ না করার দৃঢ় সঙ্কল্প করা।’ ইবনে জারির রা: হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণনা করেন, ‘ভুলবশত কোনো অপরাধ হয়ে গেলে পুনরায় তা না করা। সুফিয়ান সাওরি রা: বলেন, ‘কোনো গুনাহ হয়ে গেলে তাওবা করা এবং পুনরায় তা না করা কিংবা পুনরায় তা করার ইচ্ছা না করা।’ ইবনে হাতিম রা: হাসান বসরি রা: থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘খাঁটি তাওবা হলো অপরাধকে ঘৃণা করা এবং তা থেকে মাফ চাওয়া।’
তাফসিরে উসমানিতে তাওবাতুন নাসুহা বা বিশুদ্ধ তাওবা সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ‘স্বচ্ছ অন্তরে তাওবা অর্থ পুনরায় পাপ করার ইচ্ছা অন্তরে না থাকা। তাওবা করার পরও যদি পাপ করার ইচ্ছা জাগে তবে বুঝতে হবে, তাওবা করার মধ্যে কোনো না কোনো ত্রুটি ছিল এবং পাপের শেকড় মন থেকে উৎপাটিত হয়নি।’ খাঁটি তাওবার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত হয়। তার গুনাহ মাফ হয়। সম্মান ও মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়; সে তাওবা হতে হবে লৌকিকতামুক্ত। লৌকিকতা ও কৃত্তিমতা সমেত তাওবা আল্লাহ তায়ালার কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।
আমাদের সমাজে হুজুর ডেকে যে তাওবার প্রচলন রয়েছে তা কি আন্তরিকতা সমেত, লৌকিকতা মুক্ত? লোকসমাগমের মধ্যে আমরা যখন তাওবা করি, আমরা তখন কতটুকু লজ্জিত, অনুতপ্ত, আবেগাল্পুত, মাওলার ভালোবাসায় উদ্বেলিত হই পরকালীন ভয় ও আল্লাহর রহমতের আশাকে সামনে রেখে নিজেকে সংশোধন করা একান্তই জরুরি।
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement