২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল

-

ভরসা, আস্থা ও নির্ভরতার আরবি প্রতিশব্দ তাওয়াককুল। তাওয়াককুল আলাল্লাহ অর্থÑ আল্লাহর ওপর ভরসা। ইসলামে আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ ছাড়া কারো ওপর ভরসা করা জায়েজ নেই; বরং গাইরুল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করা শিরক।
নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ওপরই ভরসা করতেন : নবী-রাসূলগণ সব ধরনের বিপদ আপদে কাফির কর্তৃক নির্যাতনে, সব কার্যক্রমে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করতেন। আল্লাহর বাণীÑ ‘আর তাদেরকে শুনিয়ে দাও নূহের অবস্থাÑ যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! যদি তোমাদের মধ্যে আমার উপস্থিতি এবং আল্লাহর আয়াতগুলোর মাধ্যমে নসিহত করা ভারী বলে মনে হয়ে থাকে, তবে আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করছি।’ ( সূরা ইউনুস-৭১) আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবিবকে নির্দেশ দান করেনÑ ‘আর আপনি সেই চিরঞ্জীবের ওপর ভরসা করুন, যার মৃত্যু নেই এবং তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করুন। তিনি বান্দার গুনাহ সম্পর্কে যথেষ্ট খবরদার।’ (সূরা আল ফুরকান-৫৮)
আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেনÑ ‘অতঃপর (হে হাবিব!) আপনি যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)
মহানবী সা: হিজরতকালে গারে সাউরে অবস্থানকালে ভীতিকর অবস্থায় পড়েছিলেন। তখন হজরত আবুবকর সিদ্দিক রা: বলেছিলেন, ‘আমাদের কী অবস্থা হবে, আমরা মাত্র দুজন, আর কাফিররা অনেক।’ তখন রাসূল সা: বলেছিলেন, ‘আমরা দুজন নই, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’ এক যুদ্ধে রাসূল সা: তরবারি গাছে ঝুলিয়ে রেখে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তখন এক কাফির এসে তরবারি নিয়ে বলেছিল, এখন আপনাকে কে রক্ষা করবে? রাসূল সা: বলেছিলেন, ‘আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন’। এসব কিছু বিশ^নবীর আল্লাহর ওপর ভরসার জ্বলন্ত প্রমাণ।
মুমিনগণ আল্লাহর ওপর ভরসা করেন : নবী-রাসূলদের অনুসরণ করে মুমিনগণও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑ ‘আর আল্লাহর ওপর ভরসা করো, যদি তোমরা বিশ্বাসী হয়ে থাকো।’ (সূরা মায়েদা-২৩)
তাওয়াককুল অর্থ চেষ্টা ও উপকরণ ত্যাগ করা নয় : মহানবী সা: বলেছেন, ‘অন্বেষণে মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করো এবং উপকরণের মাধ্যমে চেষ্টা করার পর তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দাও।’ (মায়ারিফুল কুরআন)
হজরত আমর বিন উমাইয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ ‘হে আল্লার রাসূল, আমি কি উট ছেড়ে দিয়ে ভরসা করব? রাসূল সা: বলেন, উট বাঁধো তারপর তাওয়াককুল করো।’ (বাইহাকি) জনৈক সাহাবি তার উট ছেড়ে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে দেখা করতে এলে তিনি বলেন, ‘আগে তোমার উট বাঁধো, তারপর দেখা করতে আসো।’ (বুখারি) হজরত হাকিম বিন হেজাম থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক সাহাবি একদা প্রশ্ন করেনÑ হে আল্লার রাসূল! আমরা কী রোগে কী ওষুধ সেবন করব, নাকি তাকদিরের ওপর নির্ভর করব? রাসূল সা: বলেন, ওষুধ সেবন করো, এটিই তাকদির।’ (সুনানে ইবনে হেজাম) হজরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, ইয়েমেনের লোকেরা কোনো পাথেয় না এনে হজ করার জন্য এসেছিল, অতঃপর মক্কায় এসে মানুষের মুখাপেক্ষী হলো। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করেনÑ ‘পাথেয় সংগ্রহ করো, উত্তম পাথেহ হলো তাকওয়া অর্জন।’
তাওয়াককুলে ফায়দা : ১. শয়তান থেকে বাঁচার মাধ্যম : আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াককুল মুমিনকে পাপি শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑ ‘তাদের ওপর শয়তানের আধিপত্য চলে না, যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং স্বীয় রবের ওপর ভরসা রাখে।’ (সূরা আন নাহল) ২. দুনিয়ায় অপদস্ত হয় না : বদরের যুদ্ধে মুষ্ঠিমেয় (৩১৩ জন) মুসলমান বিরাট কাফির (এক হাজার) বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসার কারণে কাফিররা বলেছিলÑ এই বেচারাদের তাদের দ্বীনই প্রতারণায় ফেলে মৃত্যুমুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের উত্তরে বলেছেনÑ ‘যারা আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল ও ভরসা করে, (জেনে রাখো, তারা কখনো অপমানিত হয় না) কারণ, আল্লাহ তায়ালা (সব কিছুর ওপর) পরাক্রমশীল, সুবিজ্ঞ, তিনি তাদের রক্ষা করেন।’ (সূরা আল আনফাল ৪৯) ৩. আল্লাহ তার সহায় হন : যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে, তিনি তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’ ৪. আল্লাহ তার সব সমস্যা সমাধান করেন : তিরমিজি ও ইবন মাজায় হজরত ওমর ইবন খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী সা: বলেছেনÑ ‘যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা করতে, তবে আল্লাহ তোমাদের পাখির মতো রিজিক দান করতেন। পাখিগুলো সকাল বেলায় ুধার্ত অবস্থায় নীড় থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় উদরপূর্তি করে নীড়ে ফিরে আসে।’ (তিরমিজি) ৫. বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ : সহিহ বুখারি ও মুসলিমে হজরত ইবন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছে, মহানবী সা: বলেছেনÑ ‘আমার উম্মতের ৭০ হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের অন্যতম গুণ এই যে, তারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে।’ (তাফসিরে মাজহারি) হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেনÑ ‘এমন জাতি জান্নাতে প্রবেশ করবে যাদের অন্তর পাখির অন্তরের ন্যায়।’ (তাদের তাওয়াককুল আল্লাহ তায়ালার ওপর, এ বিশ্বাস নিয়ে খালি পেটে বাসা থেকে বের হয় এবং ভরা পেটে বাসায় ফিরে) তাওয়াককুলের সম্পর্ক ঈমানের সাথে। মুমিন সব কাজে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে। আর মুশরিক ভরসা করে গাইরুল্লাহর ওপর। যার ঈমান যত মজবুত, আল্লাহর ওপর তার তাওয়াককুল ও ভরসা তত সুদৃঢ়।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী

 


আরো সংবাদ



premium cement