২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিজ্ঞান ধর্মীয় বিশ্বাসকে দৃঢ় করে

-

ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। একপক্ষ মনে করেন সম্পূরক, অন্যপক্ষ পরিপূরক মনে করেন। অন্য দল মনে করেন, বিজ্ঞান ও ধর্ম নিজস্ব স্বকীয়তার জন্যই স্বতন্ত্র। আমার মনে হয়, এর সব ক’টিই এখানে প্রযোজ্য। পরিস্থিতি বিবেচনায় একে অপরের অবস্থান হতে পারে ভিন্ন। কিন্তু সূক্ষ্ম বিবেচনায় সম্পর্কটা যথেষ্ট সুদৃঢ় ও যথাযথ।
ইসলামি জ্ঞানের মূল উৎস দু’টির প্রধান হলো আল-কুরআন। আল-কুরআনকে বিজ্ঞানময় বলা হয়েছে। (সূরা ইয়াছিন, ৩৬:০১) জ্ঞানের এই আধারকে যে আঙ্গিকেই বিবেচনা করা হয় সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই যথাযথ মনে হবে সংশ্লিষ্ট বিবেকবানদের। এখানের প্রতিটি জ্ঞানই সূক্ষ্মতার বিচারে বিশেষ। কিছু আমরা বুঝি, কিছু বুঝি না। যা বুঝি তা বোঝার একটি পরিমাপক হলো আমাদের অর্জিত জ্ঞান। জ্ঞানের ব্যাপকতা ও পরিধির ওপর নির্ভর করে কুরআন বোঝার বিষয়টি। তার মূল কারণ হলো, কুরআনের মৌলিক ও বিশেষত্ব হলো এটি কোনো নির্দিষ্ট সময় ও মানুষের জন্য নয়। বরং সর্বকালের সবার জন্য প্রযোজ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের চিন্তারও উন্নতি চিরন্তন। বর্তমান ও ভবিষ্যতের এই উন্নত চিন্তারও খোরাক মেটাবে এই আল-কুরআন; দ্বীনি জ্ঞান।
আধুনিক বিজ্ঞান কুরআনের বিভিন্ন বিষয়কে যেমন বাস্তবিক করে তুলছে প্রতিনিয়ত, তেমনি কুরআনের তত্ত্বগুলোও সাহায্য করছে সংশ্লিষ্টদের। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা সেগুলো দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কুরআন যখন বলেছিল দুই সাগরের পানি একে অপরের সাথে মেশে না, কারণ তাদের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম পর্দা (সূরা আল-ফুরকান : ৫৩ ও সূরা আর-রহমান : ২০) কিংবা চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই (সূরা ইউনুস : ৫) অথবা সব গ্রহ, নক্ষত্র তাদের নিজস্ব ও নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে (সূরা ইউনুস : ৫, সূরা ইবরাহিম : ৩৩, সূরা আন-নাহল : ১২, সূরা আল-আম্বিয়া : ৩৩, সূরা লুকমান : ২৯, সূরা আল-ফাতির : ১৩, ইয়াছিন : ৪০, সূরা আয-যুমার : ৫) তখন বিজ্ঞান এগুলো চিন্তাও করতে সক্ষম ছিল না। প্রাথমিক যুগের কুরআনের ব্যাখ্যাকারীরা এসবের বাস্তবিক ও প্রায়োগিক উপস্থাপনে যতটা সফলতা পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি সফলতা এসেছে আধুনিক বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারগুলো। ষোলো শ’ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানও কিছু বিষয়ে আমাদের ভিন্ন মত দিয়েছে। যেমন, প্রথম দিকে তারা জানিয়েছিল সূর্য পৃথিবীর চার দিকে ঘোরে। কিছু দিন পরে তারা বলল, না, না। পৃথিবীই সূর্যের চার দিকে ঘোরে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, প্রতিটি গ্রহ, উপগ্রহই তার নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। বিজ্ঞানের এ আবিষ্কারের প্রায় সাড়ে ৯ শত বছর আগে কুরআন আমাদের জানালেও বাস্তবিকভাবে তা বুঝতে কষ্টকর হলেও এখন বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে সেগুলো খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ রকম অসংখ্য বিষয়ে আমাদের বুঝতে সক্ষম করেছে আধুনিক বিজ্ঞান।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে বস্তুগত আবিষ্কারের জিনিসগুলো ছোট হয়ে যাচ্ছে। ইকুয়েশনটা (সমীকরণ) এমন দাঁড়িয়েছে যে, জ্ঞানের যত বৃদ্ধি ও উন্নত হয়, আবিষ্কারের বস্তুগুলোও তত ছোট ও ক্ষুদ্র হয়। যেমন, মাইক্রোসফটের আবিষ্কৃত প্রথম কম্পিউটারের হার্ডডিস্ককে আমরা কেস স্টাডি হিসেবে নিলে দেখব, কম্পিউটারের জ্ঞান যত বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি দিনে দিনে এটি ছোট থেকে ছোটতর হচ্ছে। মেমরি হিসেবে ‘গুগল কাউডের’ ভার্সনটা অন্তত আমাদের তাই মনে করিয়ে দেয়। কয়েক দশকে যদি এমন হয় তাহলে আগামী হাজার বছর কিংবা লক্ষ বছর পরে কী হবে ভাবা যায়? এজিনিসগুলো কি ‘ইনভিজিবল’ (অদৃশ্য) হয়ে যাবে না? বুদ্ধিমান যে কেউ তা মেনে নেবে এটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা, অদৃশ্য এ বস্তুগুলো কি ‘এক্সিস্ট’ (অস্তিত্ব) করে না? অবশ্যই করে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এমন যে, জ্ঞানের বৃদ্ধি ও উন্নতির কারণে বস্তুগত আবিষ্কারগুলো ক্ষুদ্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আবার অদৃশ্য জিনিসগুলোরও অস্তিত্ব আছে।’ এখন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম যে আল্লাহর অস্তিত্বের সাথে সাথে অসংখ্য অদৃশ্য জিনিসের অস্তিত্বের কথা বলেছে সেগুলোতে বিশ্বাস করাটা অতি সহজে পরিণত হচ্ছে। অদৃশ্য সেসব বিষয়ে বিশ্বাসে ঈমানের দৃঢ়তা তাই দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের ‘গড পার্টিকেলের’ (ঈশ্বরকণা) যার প্রকৃত নাম হিগস-বোসন আবিষ্কার (যেখানে বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. লস্কর মোহাম্মদ কাশিফের অবদান অনস্বীকার্য) তাই বিশ্বাসের ধারাকে অন্য স্তরে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। ভরহীন মৌলকণাগুলোর অস্তিত্ব আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের একটি যা পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে শুধু পাল্টে দেবে না; পাল্টে দেবে জীবনব্যবস্থা, দৃঢ়তা আনবে ধর্মীয় বিশ্বাসে।
হ্যাঁ, কথা সত্য যে, অসংখ্য বিষয়ে কুরআনের তথ্যের সাথে বিজ্ঞানের কিছু বিষয়ে মতানৈক্য আছে। সেগুলোর জন্য কী আরো একটু অপেক্ষা আমরা করতে পারি না। যুক্তি দু’টি। এক. বিজ্ঞান এখনও দাবি করেনি যে, বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার শেষ হয়ে গেছে এবং দুই. বিজ্ঞান কখনও দাবি করেনি যে, তাদের আবিষ্কারটাই সর্বশেষ সেখানে কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন আসবে না কিংবা মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে না। অসংখ্য উদাহরণ আছে এসবের।
আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন, কুরআনে কোনো সন্দেহ-সংশয় নেই। প্রত্যেকটি তথ্যই ধ্রুব সত্য। এসবে বিশ্বাস করা যেমন ঈমানের জন্য জরুরি তেমনি সেসবের বিশ্বাসে দৃঢ়তা থাকাও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের জন্য অতীবও সহায়ক। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বিজ্ঞানের এসব তথ্য বিচার ও বিবেচনার জন্য দরকার মৌলিক বিশ্বাসের সাথে ধর্মীয় শিক্ষাগুলোর প্রাথমিক ধারণা। সেখানে ত্রুটি থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে। তাই সতর্কতা জরুরি। তবুও বলব, ঈমানের পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী বিশেষ করে দাঈদের (ইসলাম প্রচারকারীদের) উচিত বিজ্ঞানের চর্চা করা। দ্বীনকে অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য বর্তমান যুগে বিজ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি করে সে মতে দ্বীনকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে পারলে সফলতা আসবেই, ইনশা আল্লাহ।
লেখক : শিক্ষাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement