১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘মুসলিম উম্মাহকে অভিন্ন উন্নয়নের পথে এগোতে হবে’

সম্মেলনের ফাঁকে নয়া দিগন্তকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ জার্নাল সম্পাদক মোহাম্মদ জাকির হোসেন(ডানে) -

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার করে তাদের অভিন্ন উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে পবিত্র মক্কাভিত্তিক সংগঠন মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ (এমডব্লিউএল)। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন ইসলামী দেশে সংস্থা সভা-সম্মেলন-সেমিনার এবং ধর্মীয় ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আয়োজিত এবারের মক্কা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা সাম্প্রদায়কেন্দ্রিকতা ও চরমপন্থা মোকাবেলার জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে একটি কাঠামো গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

অতি সম্প্রতি পবিত্র মক্কায় মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের উদ্যোগে ইসলামী ঐক্যের ওপর দু’দিনব্যাপী আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষপর্যায়ে সাইড লাইনে নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আয়োজক সংস্থার ইংরেজি জার্নাল দি মুসলিম ওয়াল্ড লিগ জার্নাল এর সম্পাদক মোহাম্মদ জাকির হোসেন। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের মক্কা নগরীর প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন।

এর আগে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের সাথে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিলিত হন তিনি। এ সময় প্রতিনিধিদলের সদস্য শোলাকিয়ার ইমাম মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ কাউন্সিল ও বাংলাদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান মওলানা কামাল উদ্দিন জাফরি, কলামিস্ট টিভি আলোচক ও সাবেক জজ ইকতেদার আহমদ, আহলে হাদিসের সেক্রেটারি জেনারেল শহীদুল্লাহ খান মাদানি, খুলনার জামেয়া মাদানিয়ার অধ্যক্ষ এমদাদ উল্লাহ কাশেমি উপস্থিত ছিলেন। অলোচনার সময় বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্য এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করার জন্য সবাই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ এখন বিশ্বব্যাপী কি ভূমিকা পালন করছে, এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন বলেন- মুসলিম বিশ্ব লিগ মক্কায় পবিত্র নগরীভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি ইসলামী সংগঠন। এটি ইসলামের যথার্থ ধারণা এবং তার সহনশীল নীতিগুলো উপস্থাপন করে, মানবিক সহায়তা প্রদান করে, সংলাপে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে এবং সবার মধ্যে সহযোগিতাকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া, মুসলিম বিশ্ব লিগ সব সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিবাচক উন্মুক্ততা বজায় রাখা আর ইসলাম ও উম্মাহর মধ্যকার পারস্পরিক বার্তাকে উপলব্ধি করার জন্য সংযমের পথ অনুসরণ করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করে। চরমপন্থা, সহিংসতার পথ পরিত্যাগ করে শান্তি-ন্যায়বিচার ও সহনশীলতাসম্পন্ন বিশ্ব গড়তে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই সংগঠন বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের লক্ষ্য অর্জনে এবারের মক্কার ইসলামী ঐক্য সম্মেলন কতটা সফল হয়েছে বলে মনে করেন, প্রশ্ন করা হলে জবাবে জাকির বলেন- বিশ্বের ১২৭টি দেশ থেকে ১২৯৯ জন ধর্মীয় ও একাডেমিক ব্যক্তিত্ব ও নীতিনির্ধারক এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। বিভিন্ন দেশের ধর্মমন্ত্রী ও তাদের প্রতিনিধিরা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। খাদেমুল হারামাইন চাচ্ছেন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সব ধরনের বিভেদ দূর করে ঐক্য সৃষ্টি করতে। এ ব্যাপারে মুসলিম দেশ এবং অমুসলিম দেশগুলোর ইসলামী বিশেষজ্ঞরা তাদের ধারণা উপস্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। এ আলোচনা উম্মাহকে ঐক্য সহনশীলতা ও সম্মৃদ্ধির পথে পরিচালিত হতে সহযোগিতা করবে। মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের সেক্রেটারি জেনারেল শায়খ মোহাম্মদ বিন আবদুল করিম আলিসা এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজনের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এ সম্মেলনে উপস্থাপিত তার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ঘৃণা এবং সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সৃষ্টির প্রকল্প মোকাবেলার জন্য উম্মাহকে একটি ব্যাপকভিত্তিক কৌশলগত পরিকল্পনা নিতে হবে।

বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাধারার অনুসারীদের মধ্যে যোগাযোগের চ্যানেল গড়ে তুলতে হবে। যার লক্ষ্য হবে সব বিশ্বাসীদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করা। তিনি আরো বলেছেন, একটি সাধারণ ঐক্য গড়ার জন্য দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দূরত্ব ভেঙে ফেলতে হবে। আর একক অবস্থানের অধীনে মুসলমানদের ঐক্যের ধারা ও রীতিনীতিগুলোকে জোরদার করতে হবে। সংযমের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সাদৃশ্যের বন্ধনকে জোরদার করতে হবে এবং পরিত্যাগ করতে হবে শত্রুতা ও বিভাজনের অহঙ্কার।

চরমপন্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা আপনি বলেছেন- এ ব্যাপারে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ কতটা ভূমিকা পালন করতে পারছে মর্মে প্রশ্ন করা হলে জাকির বলেন, ঐক্যই মুসলিম উম্মাহকে কার্যকর ও স্বতন্ত্রমণ্ডিত করে তুলতে পারে। তবে এই ঐক্য-সংহতি, যৌথ উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই সম্ভব হবে। এমডব্লিউএলের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- আমাদের মধ্যে মতপার্থক্যের যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলোকে সংলাপের মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি এবং সংশোধন করতে হবে। উগ্রপন্থা ও টাকফিরি বিদ্রোহের সাথে যুক্ত করার জন্য একে অন্যকে অভিযুক্ত করার প্রবণতা সবাইকে পরিহার করতে হবে। একই সাথে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বর্জন করার প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। চরমপন্থার ধারণা মোকাবেলার জন্য সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, সুশিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। উগ্রবাদিতার বিস্তার ঘটে সঠিক শিক্ষা ও ধারণা না থাকার কারণে। আর উগ্রবাদিতা নিজ নিজ রাষ্ট্র ও সমাজকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলো বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কৃতির মধ্যে বিভক্ত। বিভাজনের বহুমাত্রিকতা গ্রহণ করে নিয়ে অন্য সবার সাথে সমঝোতা ও সহমর্মিতার সাথে বসবাস করতে হবে। আমাদের ঐক্যের সূত্র নিয়ে এগোতে হবে, বিভেদকে তিক্তভাবে ছড়িয়ে দিয়ে বিভক্তি সৃষ্টি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এবারের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা সাম্প্রদায়িকতা ও চরমপন্থা মোকাবেলার একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আহ্বান জানিয়েছেন। এতে অংশগ্রহণকারীরা বিভ্রান্তি দূর করতে এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির চিন্তার জন্য বিভিন্ন ইসলামি স্কুলের অনুগামীদের মধ্যে যোগাযোগের কার্যকর চ্যানেল সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। তারা সর্বসম্মতিক্রমে সাম্প্রদায়িক মতামত ও চরমপন্থী ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা পালন করার জন্য ইসলামিক স্কলার ও প্রচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মুসলিমদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং বিভিন্ন চিন্তাধারাগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আইন প্রণয়ন করার লক্ষ্যে একটি ব্যাপক ইসলামী সনদের খসড়া তৈরির জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেন। আমার ধারণা, এ নিয়ে এমডব্লিউএল আরো সামনে এগিয়ে যাবে এবং এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

আপনি বলছেন, এবারের সম্মেলনে ঐক্যের ওপর জোর দেয়া হয়েছে- এটি অর্জনের জন্য কিভাবে কাজ করা হবে মর্মে প্রশ্নের জবাবে জনাব জাকির হোসেন বলেন, সম্মেলনে বলা হয়- রাষ্ট্রীয় ধারণাটি উম্মাহর ধারণার একটি সম্প্রসারণ, যা এমডব্লিউএলের ছাতার অধীনে অন্য মুসলিম দেশগুলোকে একত্র এবং সমন্বিত করে। এর আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক কাঠামো আসে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) থেকে এবং এর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামো আসে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ছাতা থেকে। এর বাইরে ইসলামী সামরিক সন্ত্রাসবিরোধী জোটও রয়েছে। এসব কাঠামো লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া সম্মেলনের সমাপনী বিবৃতিতে এমডব্লিউএলকে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুসারীদের মধ্যে সাধারণ মান উন্নয়নের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং সহনশীলতা ও সহ-অবস্থানকে উৎসাহিত করার জন্য আরেকটি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক উন্নত করার ক্ষেত্রে কাজ করতে পারবে।

ঐক্য সম্মেলনের মূল বার্তা প্রসঙ্গে জাকির বলেন, এবারের সম্মেলনে বিশেষভাবে সংবিধান ও ঐক্যের মানকে আরো শক্তিশালী করতে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায় বা চিন্তাধারার স্কুলগুলোর মধ্যে বিভেদমূলক বিতর্ক পরিহারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয় এবং প্রচারমাধ্যম ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে তার ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। এতে অংশগ্রহণকারীরা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায় বা চিন্তার স্কুলগুলোর কথা উল্লেখ না করে, শুধু ‘মুসলমান’ হিসেবে নিজেদের বর্ণনা করেন। তারা ঘৃণা উদ্রেককারী ধর্মীয় ফতোয়ার নিন্দা করেন এবং প্রতিটি দেশের জন্য একক বৈজ্ঞানিক রেফারেন্স খোঁজা এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর ওপর জোর দেন। কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মক্কার গভর্নর প্রিন্স খালেদ আল ফয়সাল বাদশাহ সালমানের পক্ষ থেকে একটি বক্তৃতা দেন। এতে তিনি সংলাপের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের ভুল ধারণা দূর করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি মুসলমানদের ক্ষুদ্র পার্থক্যগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ অর্জনের জন্য একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর মক্কার মসজিদুল হারামসংলগ্ন হোটেল জেবেল ওমর হিলটনের কনভেনশন সেন্টারে এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। পবিত্র নগরী মক্কাভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি ইসলামী সংগঠন মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের প্রতিনিধি হিসেবে মক্কার গভর্নর ও খাদেমুল হারাইনের উপদেষ্টা প্রিন্স খালেদ আল ফয়সল সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের সুপ্রিম কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সৌদি গ্র্যান্ড মসজিদের খতিব শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ শায়খ, মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের সেক্রেটারি জেনারেল ড. মোহাম্মদ বিন আবদুল করিম আলিসা, আমিরাতের ফতোয়া কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শায়খ আবদুল্লাহ বায়াহ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সেক্রেটারি জেনারেল ড. ইউসুফ বিন আহমদ আল ওতায়মিন, মিসরের গ্র্যান্ড মুফতি ড. শাউকি আলম, আলজেরিয়ার সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ড. বাইবদাল্লাহ গোলাম-আল্লাহ এবং লেবাননের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল লতিফ ডেরাইনে।


আরো সংবাদ



premium cement