১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শান্তির দূত কফি আনান

কফি আনান(১৯৩৮-২০১৮) - ছবি : সংগ্রহ

মানবিক কাজের জন্য বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব ও কূটনীতিক কফি আনান মারা গেছেন ৮০ বছর বয়সে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা জাতিসঙ্ঘের সপ্তম মহাসচিব হিসেবে ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন ঘানা বংশোদ্ভূত এ ব্যক্তিত্ব। তিনিই ছিলেন জাতিসঙ্ঘের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান মহাসচিব। ২০০৭ সালে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক নেতাদের গ্রুপ দ্য এলডারসের প্রতিষ্ঠা হলে এর সদস্য হন কফি আনান। ২০১৩ সালে ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান হন তিনি।

সিরিয়ায় জাতিসঙ্ঘের শান্তিদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমার সরকার গঠিত কমিশনের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আনান কমিশন নামে পরিচিতি পাওয়া ওই কমিশন রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ৮৮টি সুপারিশ করে। গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা নিধনের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে আনান কমিশনের সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন ২০০১ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী এই ব্যক্তি। ২০০১ সালে জাতিসঙ্ঘ এবং কফি আনান যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে কফি আনান এ পুরস্কার অর্জন করেন।
কুমাসি থেকে বিশ্বশান্তির দূত

কফি আনান ১৯৩৮ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত ঘানার কুমাসি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা উভয়ের পরিবারই উপজাতি গোষ্ঠীর শীর্ষপর্যায়ের পরিবারের সদস্য ছিলেন। ফলে উপজাতীয় ও আধুনিক উভয় সংস্কৃতি গায়ে মেখেই বড় হন আনান।
ঘানার একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তিনি কুমাসির কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেন। ২০ বছর বয়সে স্কলারশিপ পেয়ে আনান যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ম্যাসালেস্টার কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে দক্ষ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আনান যেন বিশ্বজয়ী কূটনীতিক হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। ১৯৬১ সালে ওই কলেজ থেকেই অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেন কফি আনান। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ হলে আনান চলে যান সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। সেখানে তিনি গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনশ্যানাল অ্যান্ড ডেভেলেপমেন্ট স্টাডিজে অর্থনীতির ওপরই আরেক দফা স্নাতক ডিগ্রি নেন।

জেনেভায় পড়াশোনার পর আনান জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (হু) যোগ দেন। সংস্থাটিতে প্রশাসনিক ও বাজেট কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাকে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে পদায়ন করা হয়। আনান বরাবরই মাতৃভূমিতে ফিরতে চাইলেও আফ্রিকান দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা তার সে সিদ্ধান্ত বাধাগ্রস্ত করেছে।

এর মধ্যে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আলফ্রেড পি স্লোয়ানে ফেলোশিপ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে ফেলোশিপটি শেষ করার পর আনানকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার অব সায়েন্স ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়। পরে ঘানায় ফেরার বদলে তিনি নিউ ইয়র্কের জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে চাকরিতে যোগ দেন।

১৯৭৪ সালে আনান জাতিসঙ্ঘ ইমারজেন্সি ফোর্সের চিফ সিভিলিয়ান অফিসার হিসেবে কায়রোতে পদায়ন লাভ করেন। তবে সে বছর ওই দায়িত্ব ছেড়ে ঘানায় গিয়ে দেশটির পর্যটন উন্নয়ন কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে যোগ দেন।
এরপর আনান আবার আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জাতিসঙ্ঘে যোগ দেন। সাত বছর তিনি জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনে (ইউএনএইচসিআর) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অফিসে বাজেট পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই দশকের শেষ দিকে তিনি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তাসমন্বয়ক পদে কাজ করেন। ১৯৯০ সালে জাতিসঙ্ঘের অফিস অব প্রোগ্রাম প্ল্যানিং, বাজেট অ্যান্ড ফিন্যান্সের সহকারী মহাসচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন আনান।

এই দীর্ঘ সময়ে তিনি জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা থেকে ব্যবস্থাপনা, সব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান। এমনকি ১৯৯০ এর দিকে কুয়েত যুদ্ধের সময় ইরাক থেকে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির জন্যও মধ্যস্থতা করেছিলেন আনান।
এত বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান দেখিয়ে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সংস্থার মহাসচিব পদে নিয়োগ পান আনান। তার রাজসিক ভঙ্গিমা, শান্ত-শীতল মার্জিত ভাব এবং রাজনৈতিক সচেতনতা জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ পদে পৌঁছতে তাকে সহায়তা করে। এত বড় পদে দায়িত্ব পেলেও আনান তার অতীত ক্যারিয়ারের মতোই ছিলেন নরমভাষী। এই নরম ভাষায়ই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যসঙ্কট নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছিলেন তিনি।

প্রথম মেয়াদে জাতিসঙ্ঘের কার্যক্রমে অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন আনায় আনানকে ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০১ সালে জাতিসঙ্ঘের সাথে আনানকেও যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।

ওই পুরস্কার প্রদানের কারণ হিসেবে তখন নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আনান জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা সংস্থাকে নতুন রূপ দিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় আরো বেশি তৎপর করেছেন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা এবং এইডসের মতো দুরারোগ্য রোগের প্রতিরোধে তার কার্যকর পদক্ষেপই জাতিসঙ্ঘকে বিশ্ববাসীর দরবারে আরো সম্মানিত করেছে।

কফি আনানের প্রতিষ্ঠিত ‘কফি আনান ফাউন্ডেশন’ এর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তিনি ছিলেন একজন বিশ্বনেতা, যিনি সারা জীবন আরো শান্তিময় একটি বিশ্বের জন্য লড়াই করে গেছেন। স্বচ্ছ ও অধিকতর শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়তে সারা জীবন লড়াই করে গেছেন তিনি। জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বকালীন ও কর্মজীবনে তিনি ছিলেন শান্তি, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চ্যাম্পিয়ন। যেখানেই সমস্যার খোঁজ পেতেন সেখানেই পৌঁছে যেতেন তিনি। গভীর সমবেদনায় জয় করেছেন হাজারো মানুষের মন। অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে গেছেন অন্যের জন্য।
সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, গার্ডিয়ান


আরো সংবাদ



premium cement