২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অপব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

-

ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ। মানুষসহ গবাদি পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক (বিশেষ করে পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপ ) প্রবেশ করার পর এর কার্যকারিতা শুরু হয় এবং মলমূত্রের মাধ্যমে নির্গত হয়েও তা সক্রিয় থাকে। মলমূত্রের সাথে নির্গত হওয়ার পর তা পানি এবং মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পানিবাহিত হয়ে তা নদী-খাল-বিলে এমনকি সমুদ্র পর্যন্ত গড়ায়। অ্যান্টিবায়োটিক যেখানেই অবস্থান করে সেখানেই ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে থাকে। কিন্তু পানি ও মাটিতে বহু ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব রয়েছে যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু নিয়মবহির্ভূত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ রক্ষাকারী এসব অণুজীবের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। বিদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন থাকলেও আমাদের দেশে তা না থাকায় বৈধ-অবৈধভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ফার্মাসিগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সামান্য জ্বরেও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে থাকেন। আবার ওষুধ কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং বিভাগের অযাচিত চাপ, লোভনীয় মূল্য হ্রাস, উপহার প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ওষুধ প্রেস্ক্রাইব ও বিক্রয় করতে বাধ্য করান। অ্যান্টিবায়োটিক তার নিজস্ব ধর্মানুযায়ী অপরিবর্তিত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়াবিরোধী কার্যক্ষমতা অক্ষুণœ রেখেই মানুষের মলমূত্র দিয়ে নির্গত হয় এবং তা নর্দমা, নদী, মাটিতে মিশে গিয়ে পরিবেশের সহায়ক নাইট্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন চক্র রক্ষাকারী অণুজীবগুলোর বাসস্থান ধ্বংস করে দিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ২২ হাজার কোটি টাকার অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি ব্যাকটোরিয়াল এজেন্টসহ অন্য ওষুধ বিপুল পরিমাণে ব্যবহার হচ্ছে যার পরিমাণ কয়েক হাজার টনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে যা মলমূত্র দিয়ে এদেশের নদী মাটিতে স্তূপ হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত ছত্রাকনামক অণুজীব হতে প্রস্তুত করা হয় এবং শরীর বৃত্তীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করার দরুণ এসব অ্যান্টিবায়োটিক অপরিবর্তিত অবস্থায় নিজ কার্যক্ষমতা অক্ষুণœ রেখেই মল-মূত্র দিয়ে নির্গত হয়। ফলে মাটি-পানিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া এদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে এবং পরিবেশের জন্য যত সংখ্যক ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন তার সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে। ফলে পরিবেশের অস্তিত্ব রক্ষাকারী প্রধান চক্রগুলো যেমনÑ অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ইত্যাদি চক্রের গতি ও হার কমে গিয়ে ধীর বিষক্রিয়ার মতো পরিবেশ এর মৃত্যু ঘটাতে পারে যা মানবকুলকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে। অন্যদিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল এজেন্টসহ অন্যান্য ওষুধ শরীরবৃত্তীয় বিপাক ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতÑ বিপাকজাত পদার্থরূপে মাটি ও পানিতে জমা হচ্ছে। এদের মধ্যে কোনো কোনোটি ব্যাকটেরিয়াবিরোধী ভূমিকা পালন করতে পারে, পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থরূপে বিপাকীয় পদার্থগুলো (মেটাবোলাইটস) জমা হয়ে মাটি ও পানির ভৌত গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে পরিবেশের প্রধান উপাদানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমের বিঘœতা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত পরিবেশে প্রধান পাঁচটি অণুজীব যেমন ব্যাকটেরিয়া, একটিনো মাইসেটিস ছত্রাক, শৈবাল ও প্রোটোজয়া রয়েছে যাদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ব্যাপক। মাটি ও পানিতে বিদ্যমান এসব অনুজীব ও জৈব-অজৈব পদার্থের পারস্পরিক ক্রিয়া ও সম্পর্ক নিয়ে পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র (ঊপড় ঝুংঃবস) গঠিত। আণুবীক্ষণিক পরীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি গ্রাম শুষ্ক মাটিতে প্রায় ১০০-১০০০ কোটি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, সে হিসাবে দেখা যায় প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১০০-৪০০০ কেজি জীবন্ত ব্যাকটেরিয়া আছে। এদের মধ্যে ব্যাসিলাস, ক্লসট্রিডিয়াম, করিনি ব্যাক্টেরিয়াম, সিউডোমোনাস, স্ট্যাপাইলোকক্কাস, স্ট্রেপটোকক্কাস এবং জ্যানথোমোনাস উল্লেখযোগ্য। বাস্তুতন্ত্রে এসব ব্যাকটেরিয়া বিয়োজক হিসেবে কাজ করে। এদের দেহ থেকে ক্ষয়িত পদার্থ দিয়ে মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদকে পচনে সাহায্য করার মাধ্যমে জীবের জটিল যৌগগুলোকে সরল বস্তুতে রূপান্তর করতÑ সবুজ উদ্ভিদ, শৈবালসহ শক্তি উৎপাদনকারী জীবগুলোর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। আর এদের ভক্ষণের মাধ্যমে মানুষসহ জগতের প্রাণীকুল সূর্য থেকে সঞ্চিত শক্তি প্রাপ্ত হয়। পাশাপাশি পচনশীল জীব থেকে গ্যাসীয় উপাদান যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি অবমুক্তকরত পরিবেশে এদের ভারসাম্য রক্ষা করে। অতএব এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, পরিবেশ রক্ষাতে ব্যাকটেরিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। অতএব ব্যাকটেরিয়াসহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদান (যেমন: পানি, মাটি ও বায়ু) যদি অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ওষুধ দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে পরিবেশের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হতে বাধ্য। নিয়ম বহির্ভূত ও অযাচিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্য ওষুধ ব্যবহারের কারণে মানুষের শরীরের পাশাপাশি পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ইদানীং অনেক ডাক্তার জ্বর-সর্দিও মতো সামান্য রোগের চিকিৎসা দিতে গিয়েও রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করছেন। বিশেষ করে ফার্মাসিগুলোর মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্য ওষুধের অবাধ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার (অপব্যবহার) চলছে। বহু লোক ওষুধের জন্য সরাসরি এসব ফার্মাসির দ্বারস্থ হয়ে থাকে। তাই সময়ের দাবি হচ্ছেÑ এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালানো জরুরি। উল্লেখ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন কোনো ওষুধ আবিষ্কার হলেই আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আমরাই এই ওষুধ আমদানি করেছি উল্লেখ করে ডাক্তারদের প্রেসক্রাইব করতে প্ররোচিত করে থাকেন। অথচ দেশে উৎপাদিত বিদ্যমান ওষুধগুলোর কার্যকারিতা সংশ্লিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে হ্রাস পাইনি। আমাদের দেশে বিদ্যমান ওষুধগুলোর কার্যকারিতা সংশ্লিষ্ট রোগের ক্ষেত্রে হ্রাস পেলে সে ক্ষেত্রে নতুন ওষুধ আমদানি করা যেতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ‘চিকিৎসা প্রোটোকল’ নির্ধারণ করতÑ প্রোটোকলে উল্লিখিত ওষুধগুলোই কেবল বাজারজাত করা যাবেÑ এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা উচিত। অতীতে ওষুধ কোম্পানিগুলো নতুন নতুন ওষুধ দেশে বাজারজাত করে ডাক্তারদের মাধ্যমে রোগীদের ওপর গিনিপিগের মতো পরীক্ষা চালিয়েছেন এবং মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দরুন ওই ওষুধ বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন। ততক্ষণে রোগীর যা হওয়ার হয়ে গেছে। এ ধরনের ওষুধগুলোর মধ্যে সিসাপ্রাইড, টারফেনাডিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

লেখক : এমএসসি, এমমবিএ, এমফিল (সিইউ)
ফার্মাসিউটিকেলস কর্মকর্তা ও গবেষক
মোবা : ০১৮২৩ ৯৪৭৩৩১
ইমেইল : ধনুরধঁফফরহ@মসধরষ.পড়স

 


আরো সংবাদ



premium cement