২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রেক্টাম বা মলাশয় ও বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার

-

রেক্টাম বা মলাশয় এবং কোলন অথবা বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারের উপসর্গ, ক্যান্সারটির উৎপত্তি মলাশয় অথবা বৃহদন্ত্রের কোন অবস্থান থেকে হয়েছে, পরিপূর্ণভাবে তার ওপর নির্ভরশীল। মলাশয়ের ক্যান্সার সাধারণত পায়ুপথে রক্তক্ষরণ এবং মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। মলত্যাগের বেগ এলে রোগী তড়িঘড়ি করে টয়লেটে যায় ও শ্লেষ্মাযুক্ত মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে। প্রথম দিকে যেহেতু উপসর্গ তত মারাত্মক নয়, রোগী নিজ থেকেই অনেক সময় চিন্তা করে যে হয়তোবা আমাশয় আক্রান্ত হয়েছে অথবা তার পাইলস থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমাদের দেশে পাইলস অথবা পেট খারাপ বা আমাশয় আক্রান্ত হওয়া বেশ সাধারণ ব্যাপার। ভেজাল, নষ্ট হওয়া খাবার দাওয়াতে অথবা রেস্তরাঁয় খেয়ে পেট খারাপ বা মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তনকে সহজভাবে গ্রহণ করা আমাদের রোগীদের জন্য স্বাভাবিক। সে কারণে পায়ুপথে রক্তক্ষরণ, মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন, কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা পাতলা পায়খানা উপসর্গগুলো যে ক্যান্সারেরও উপসর্গ সেটা অনুধাবন করতে রোগীর অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে, যদিও এর মাঝে ক্যান্সারটি বড় হয়ে মলাশয়/বৃহদন্ত্রের অকুস্থলের চার পাশে এবং পরে ফুসফুস ও যকৃতে ছড়িয়ে যায়। পেটে ব্যথা হয়, মল আটকে গিয়ে সম্পূর্ণ কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট ফুলে ওঠে। অপারেশন ছাড়া রোগমুক্তির জন্য রোগী হাতুড়ে ডাক্তারসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিকিৎসার শরণাপন্ন হয়ে প্রকৃত চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যাওয়ার সুযোগ হারান। ক্যান্সার মলাশয় এবং মলদ্বারের পাশের স্নায়ু ও মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পায়ুপথে প্রচণ্ড ব্যথার জন্ম দেয়।
রেক্টাম বা মলাশয় এবং কোলন অথবা বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারের জন্য ল্যাপারোস্কপি পদ্ধতিতে অপারেশনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পেট না কেটে ও মলদ্বার অপসারণ না করে ক্যান্সারটি সম্পূর্ণরূপে ব্যবচ্ছেদ করে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়। আগেকার দিনে সচরাচর পায়ুপথ বা মলদ্বার ফেলে দিয়ে পেটের ডান বা বাঁয়ের যেকোনো এক পাশে কৃত্রিম মলদ্বার বানিয়ে সেখানে ব্যাগ লাগিয়ে দেয়া হতো। মল ওই ব্যাগে জমা হতো এবং রোগীকে সময় মতো মাঝে মাঝে ব্যাগ পরিষ্কার করে নিতে হতো। এই স্থায়ী ব্যাগ লাগানো অনেক রোগীর কাছে অগ্রহণযোগ্য, সামাজিকভাবে অমর্যাদাপূর্ণ, অরুচিসম্মত হিসেবে গণ্য করে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে যেভাবেই হোক রোগী স্থায়ী ব্যাগ পরিহার করার চেষ্টা করে। মলাশয় এবং কোলন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেনতার অভাব ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সর্বজনীন অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর পরিপূর্ণ আরোগ্য হওয়ার হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম, উপসর্গ, জটিলতা ও ভোগান্তি বেশি এবং ক্যান্সারের ব্যয়বহুলতা সর্বাধিক। সচেনতার অভাব, অজ্ঞতা, ভোগান্তি, অহংবোধ, চিকিৎসক সমাজের প্রতি আমজনতার বিশ্বাসের অভাব এবং ক্যান্সারের ব্যয়বহুলতা রোগীকে প্রকৃত চিকিৎসা অনুসন্ধান থেকে বিরত রাখে। মলাশয় অথবা মলদ্বারের সাধারণ অসুখ যেগুলো ক্যান্সারের মতো মারাত্মক নয় যেমন ফিশার, পাইলস, ইত্যাদির উপসর্গ এবং ক্যান্সারের উপসর্গ একই রকম হতে পারে এবং যেহেতু ওই অসুখগুলো সাধারণত অচিরেই জীবন হুমকির সৃষ্টি করে না রোগীরা উপসর্গের গুরুত্ব অনুধাবন না করেই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন, এমনকি শল্য চিকিৎসকের (সার্জন) পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে এটাও বলতে শোনা যায় যে, রোগী জানে যে রক্তক্ষরণ বা অন্যান্য উপসর্গ পাইলস হবে প্রকৃতপক্ষে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে উপসর্গের কারণ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। রোগীর ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা এবং কলনস্কপি ও বাওন্সি করে রোগ নির্ণয়ের পর সিটি এবং এমআরআই দ্বারা স্টেজিং করার পরেই চিকিৎসা প্রণালী নির্ধারণ করে চিকিৎসা শুরু করা হয়।
আগে প্রচলিত অথবা অত্যাধুনিক, অপারেশনই মলাশয় এবং বৃহৎ পদ্ধতি। আধুনিক পদ্ধতিতে ল্যাপারোস্কপি বা রোবটের মাধ্যমে অপারেশন করে আশপাশের গ্রান্ড যেখানে ক্যান্সার ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে সেই গ্লান্ডসহ ক্যান্সারটিকে সম্পূর্ণ অপসারণ করা। প্রায় নব্বই ভাগেরও বেশি ক্ষেত্রে পেট না কেটে ও মলদ্বার অপসারণ না করে ক্যান্সারটি সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া সম্ভব হয়। অপারেশনের আগে অথবা পরে কেমোথেরাপি অথবা রেডিওথেরাপির প্রয়োজন আছে কিংবা নেই সেটা নির্ভর করে ক্যান্সার স্টেজিংয়ের ওপর। যদিও ইংল্যান্ড, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় নব্বইয়ের দশক থেকে ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতিতে মলাশয় এবং বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারের অপারেশন চালু হয়েছে এবং আমি সে সময় থেকেই ল্যাপারোস্কপিক পদ্ধতিতে মলাশয় এবং বৃহদন্তের অপারেশন করে আসছি। বাংলাদেশে কেবল সম্প্রতি এ পদ্ধতিতে অপারেশনের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে অপারেশনের পর মলদ্বার অক্ষত থাকে, রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে, ক্যান্সার থেকে আরোগ্য পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় এবং আগে আগে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে পারে। এই প্রযুক্তিতে বেশ কিছু একবার প্রয়োগযোগ্য শল্যযন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যে কারণে তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল এ অপারেশনে খরচ কিছুটা বেশি হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আমি এই জটিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সফল অপারেশন করেছি।
খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান এবং জীবনধারা রেক্টাম বা মলাশয় এবং কোলন অথবা বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার সৃষ্টিতে প্রভাবিত করে। ধূমপান পরিহার, প্রচুর শাকসবজি ও পানি পান, নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম রেক্টাম বা কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। যাদের নিকট পরিবারে রেক্টাম এবং কোলন ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তাদের ৪০ বছর পার হওয়ার পর কলনস্কপি করার প্রয়োজন আছে এবং যেকোনো বয়সে উপসর্গ থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মোতাবেক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনিস্বীকার্য।

লেখক : বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, (অব:) কলোরেকটাল সার্জারি বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা।
চেম্বার : ইডেন মাল্টি-কেয়ার হসপিটাল, ৭৫৩ সাতমসজিদ রোড, (স্টার কাবাব সংলগ্ন) ধানমন্ডি, ঢাকা। ফোন : ০১৭৫৫৬৯৭১৭৩-৬


আরো সংবাদ



premium cement

সকল