২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ডেঙ্গু নিয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

-

ডেঙ্গু জ্বরের কারণ

ডেঙ্গু জ্বর একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস নামক মশার কামড়ে হয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ৫ ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো- ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩, ডেনভি-৪ এবং ডেনভি-৫ (২০১৩, ইন্ডিয়া)। ডেঙ্গু জ্বর ৩ প্রকারের: ১) ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর ২) ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ৩) ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং ৪) এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। মানুষের শরীরে যদি প্রথমবার এই ৫ ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোনো একটি দিয়ে সংক্রমিত হয়, তাহলে লক্ষণসমূহ প্রকাশিত অথবা অপ্রকাশিত হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমবার ডেঙ্গু সংক্রমণ হলে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের হয়।

এটি কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ওই নির্দিষ্ট প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাস বিপরীতে রোগ প্রতিরোধকারী এন্টিবডি তৈরি হয় যা ভবিষ্যতে ওই নির্দিষ্ট প্রকারের ডেঙ্গু সংক্রমণকে প্রতিহত করে। আশঙ্কার কথা এই যে, দ্বিতীয়বার ওই ব্যক্তি যদি বাকি ৪ প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোনো একটিতে সংক্রমিত হয়, তাহলে তা মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম নামে চিকিৎসকগণের কাছে পরিচিত। এতে সময়মত চিকিৎসা গ্রহণ না করলে ওই ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ :

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর

- জ্বর (১০৪-১০০DF)
- চোখের পেছনে ব্যথা
- মাথাব্যথা
- মাংসপেশিতে ব্যথা
- অস্থি ও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা (হাড়ভাঙাব্যথা-ব্রেকবোন ফিভার)
- খাবারে অরুচি
- বমি বমি ভাব এবং বমি
- র্যাশ (মুখমণ্ডল, গলা এবং বুকের চামড়ায় লালচে বর্ণ বা দানা) 

ডেঙ্গু জ্বরের সতর্কতামূলক লক্ষণসমূহ :

ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম 
- চামড়ায় ছোট, মাঝারি অথবা বড় আকারের লালচে দানা
- দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া
- নাক দিয়ে রক্তপড়া
- চোখের কোণে রক্তজমা
- পেটে প্রচণ্ড ব্যথা এবং কালো পায়খানা
- অনবরত বমি এবং রক্তবমি
- মেয়েদের মাসিকের সাথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
- অতিরিক্ত দুর্বলতা, খিটখিটে স্বভাব এবং অস্থিরতা
- রক্তের চাপ কমে যাওয়া
- তন্দ্রাচ্ছন্ন, বিভ্রান্ত ও অজ্ঞান হওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- পেটের ডান দিকে উপরিভাগে ব্যথা এবং চাকা অনুভব (লিভার বড় হলে)
- শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া (<৯৬DF)
- চোখ কোঠরে যাওয়া
- মুখমণ্ডল, জিহ্বা এবং ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়া
- ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না হওয়া

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা : সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই ৭ দিনের মধ্যে সাধারণত ভালো হয়ে যায়। ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা মূলত শরীরের পানির সমতা রক্ষা করা এবং বিশ্রাম। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ধরনের NSAID ব্যবহার করা যাবে না। শরীর স্পঞ্জ করা যেতে পারে। বিশ্রাম এবং সেই সাথে প্রচুর পানি, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি এবং পছন্দসই তাজা ফলের রস খেতে হবে এবং সেই সাথে ডেঙ্গু জ্বরের সতর্কতামূলক লক্ষণগুলো লক্ষ রাখতে হবে।

এর যেকোনো একটি লক্ষণও যদি প্রকাশ পায় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে অন্যথায় মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাবে। তবে ২০১৯ সালের ডেঙ্গুর ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এক্সপ্যানডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে এবং এর কারণে অনেক প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। দু’একদিনের জ্বরে শরীরের রক্তচাপ কমে গিয়ে রোগী শকে চলে যাচ্ছেন। জ্বরে শরীরের তাপমাত্রাও থাকছে কম ১০০-১০২DF। এসব জটিলতা এড়াতেই অপেক্ষা না করে প্রথম দিনের জ্বরে বিএমডিসি কর্তৃক রেজিস্ট্রিকৃত একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। চিকিৎসক যদি মনে করেন রোগী বাসায় চিকিৎসা নেয়ার জন্য উপযোগী তাহলে বাসায় চিকিৎসা নেয়া যেতে পারে।
এ ছাড়াও চিকিৎসকগণ কিছু রোগীকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যাদের জ্বর হলে প্রথম দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন, যেমন : 
(১) এক বছরের কম বয়সী বাচ্চা 
(২) গর্ভবতী মা 
(৩) বৃদ্ধ 
(৪) ডায়াবেটিক 
(৫) হার্টেরসমস্যা 
(৬) উচ্চরক্তচাপ
(৭) কিডনির সমস্যা
(৮) লিভারের সমস্যা

ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় : ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি রোধ এবং এর কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া। নি¤œলিখিতভাবে বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন হলে এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। দরকার সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের স্বতন্ত্র উদ্যোগ। নি¤œলিখিত উপায়ে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব :
-ঘরের ভেতরে এবং বাইরে জমে থাকা পানি তিন দিনের মধ্যে অপসারণ, যেমন : ফুলের টব, ফুলদানি, একুরিয়াম, আর্টিফিশিয়াল ঝর্ণা, ডাবের খোসা, টায়ার এমনকি বাথরুমের ভেজা ফ্লোর, বেসিন এবং কমোড। 
- ঘরের দরজা-জানালায় নেট ব্যবহার
-দিনের বেলায় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো
-লম্বা জামা এবং প্যান্ট পরিধান
-মশার রিপিল্যান্ট (ওডোমস) ব্যবহার
-আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা এবং অসুস্থ অবস্থায় অন্য এলাকায় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকা 

২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা এবং নিজস্ব কিছু মতামত
যেহেতু প্রথমবার ডেঙ্গু সংক্রমণে অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষণ অপ্রকাশিত থাকে এবং এমনকি লক্ষণ থাকলেও অনেক চিকিৎসকই ডেঙ্গুর শনাক্তকরণে কোনো টেস্ট করানোর জন্য আগ্রহী নন। কারণ, ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য আলাদা কোনো ওষুধ নেই, চিকিৎসা শুধু উপসর্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। তাই, প্রথম ডেঙ্গু সংক্রমণ অনেক ক্ষেত্রেই নির্ণয় হয় না, সেহেতু এবার যেসব রোগীগণ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এ আক্রান্ত হয়েছেন অথবা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বার সক্রমণে কোনো গবেষণাপত্র তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। IEDCR এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ডেনভি-১, ডেনভি-২ এবং ডেনভি-৩ এর অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। IEDCR এর তথ্যমতে- ২০১৯ সালে ডেন-৩ দিয়ে সক্রমণের হার বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা যায় যে ডেন-৩ দিয়ে সংক্রমণে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হার অন্যান্য দেশে ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। আবার এমনও হতে পারে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাসগুলোর মিউটেশনের ফলে নতুন প্রকারের একটি ডেঙ্গু ভাইরাস তৈরি হয়েছে, যেজন্যে জটিলটা বেশি হচ্ছে। এ জন্য দরকার ভবিষ্যত গবেষণা। তবে একজন ভারোলজিস্ট হিসেবে আমি মনে করি যে, প্রত্যেক চিকিৎসকগণকে রোগীদের প্রথমবার ডেঙ্গু জ্বরের আশঙ্কা হলে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্তকরণ জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement