২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ডেঙ্গু জ্বরে করণীয়

-

বর্তমানে সারা দেশে বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে ডেঙ্গু জনমনে বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ রোগ ও তার প্রতিকার এবং চিকিৎসা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণার অভাবই এই আতঙ্কের মূল কারণ। তাই এ রোগ সম্পর্কে সুষ্ঠুভাবে অবহিত হয়ে এ জ্বর প্রতিরোধ করার জন্য জনমনে সতর্কতা সৃষ্টি করা দরকার।
লিখেছেন অধ্যাপক ডা: তোফায়েল আহমেদ
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাস বা ফ্ল্যাভি ভাইরাস গ্রুপের একটি সদস্য এই রোগের কারণ। বিশ্বব্যাপী ট্রপিক্যাল অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়। বর্তমানে যেসব দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি তা হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ-আগস্ট মাসে হঠাৎই ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার ঘটে এবং সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ার আগেই কিছু রোগী এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। যে কারণে জনমনে জ্বর সম্পর্কিত আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়াতে পরে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর হার কমে যায়। গবেষকদের মতে, সামনের বছরগুলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে এ রোগ আরো ব্যাপকভাবে আসতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ রয়েছেÑ ঞুঢ়ব-১, ঊণভ-২, ঊণভ-৩, ঊণভ-৪। প্রতিটি সেরোটাইপ বিভিন্ন রকম ডেঙ্গু জ্বর সৃষ্টি করে। সাধারণত প্রথমবার কোনো একটি সেরোটাইপ দ্বারা এ রোগ হলে পরে সেই সেরোটাইপ দিয়ে আর ডেঙ্গু হয় না তবে দ্বিতীয়বারে সাধারণত অন্য আরেক সেরোটাইপ দিয়ে ডেঙ্গু হয় এবং তা প্রথবারের তুলনায় আরো মারাত্মক আকারে দেখা দেয়।
ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক অ্যাডিস ইজিপটি নামক মশা। এ ছাড়া অ্যাডিস অ্যালবপটিকাস দিয়েও এ রোগের বিস্তার হয়। অ্যাডিস নামে মশাগুলো অন্যান্য মশার চেয়ে বড় এবং গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। এরা বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে যেকোনো জলাবদ্ধ এলাকায় বংশবিস্তার করে। তা ছাড়া ঘরে রাখা টব বা ফুলদানির পানিতেও এরা বংশবিস্তার করে। এদের ডিম ফোটার জন্য পানির প্রয়োজন হয় বলে শুকনো মওসুমে এ মশা কমে যায়। যেকোনো অ্যাডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয় না, যে মশা জীবাণু বহন করে, শুধু সেসব মশার কামড় থেকেই ডেঙ্গু হতে পারে। এ মশা দ্বারা রোগ বিস্তারের আরেকটি অবাক হওয়ার মতো তথ্য হলোÑ সাধারণত দিনের বেলায় অ্যাডিস মশা কামড়ায় এবং ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ হয় দিনের বেলায়।
উপসর্গ : ডেঙ্গ জীবাণুবাহী মশা কামড়ানোর পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে সাধারণত রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। কিছু কিছু ডেঙ্গু রোগী কোনো উপসর্গ ছাড়াই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। সাধারণত ডেঙ্গুর জীবাণু কম পরিমাণ হলে বা রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হলে এ রকম হতে পারে।
যাদের উপসর্গ দেখা দেয়, তাদের আবার ডেঙ্গু রোগ হতে পারেÑ সাধারণ ডেঙ্গু ও রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে রোগীর প্রচণ্ড শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চোখ ব্যথা, চোখ থেকে পানি পড়া, অরুচি বা বমি বমি ভাব ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের জ্বর চার-পাঁচ দিনের মধ্যে কমে গিয়ে গায়ে হামের মতো র্যাশ হতে পারে। তারপর এ জ্বর সেরে যায়।
কিন্তু হেমোরেজিক ডেঙ্গু সাধারণ ডেঙ্গুর তুলনায় বেশি মারাত্মক এবং সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাবে তা রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জ্বরের সাথে সাথে রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হয়। রোগীর জ্বরের সাথে দাঁত ও মাড়ির গোড়া থেকে রক্ত পড়া, নাক দিয়ে বমির সাথে রক্ত পড়া, গায়ে রক্ত জমে ছিটা ছিটা দাগ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। এ ছাড়া পায়খানার রঙ আলকাতরার মতো কালো হতে পারে, যা রক্তক্ষরণের কারণে হয়।
আরো মারাত্মক আকার ধারণ করলে এ রোগ থেকে সার্কুলেটরি ফেইলিওর হয়ে আরো নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়াও কিছু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত করা যায়। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর রক্তে শ্বেত কণিকার স্বল্পতা লক্ষ করা যায়। রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গু জ্বরে অনুচক্রিকা এক লাখ বা তারও অনেক নিচে নেমে যায় এবং হেমাটোক্রিট সাধারণের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। এ ছাড়াও জ্বর শুরু হওয়ার পাঁচ-সাত দিন পর রোগীর রক্তে ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া যায়।
চিকিৎসা : ডেঙ্গু জ্বরের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। উপসর্গ অনুযায়ী এ রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে রোগীকে শরীর ব্যথা ও জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। তবে কখনোই অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেয়া হয় না। এতে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা বাড়ে। এ ছাড়া রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে রেখে প্রচুর পানীয় ও পুষ্টিকর খাবার দেয়া উচিত। হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বরে রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সুষ্ঠু চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে মৃত্যুর হার শতাংশেরও কম।
প্রতিরোধ : ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কিত আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে এ রোগ প্রতিরোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সরকারি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা উচিত। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের উচিত নিজেদের ঘরবাড়ি মশামুক্ত রাখার জন্য মশার ওষুধ ব্য নেট ব্যবহার করা। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা উচিত। এ ছাড়া ঘরের ফুলদানি, ফুলের টব বা অন্য যেসব স্থানে মশার বিস্তার হতে পারে তা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রয়োজন বোধে ঘর থেকে ফুলের টব, ফুলদানি ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক সংগঠন এবং সরকারি তৎপরতায় মশা মারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যেসব স্থান এসব মশার উৎপত্তিস্থল তা নিয়মিত পরিষ্কার করে মশা মারার ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে শুধু ডেঙ্গুই নয়, যেকোনো রোগই চিকিৎসা করার চেয়ে সেই রোগ প্রতিরোধ করাই জরুরি। কাজেই ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করার জন্য সবার এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অধ্যক্ষ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

 


আরো সংবাদ



premium cement