১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভালো ঘুমের জন্য কী করবেন?

ভালো ঘুমের জন্য কী করবেন? - সংগৃহীত

প্রতিটি মানুষেরই বিশ্রাম দরকার। বিশ্রামের মাধ্যমেই শরীর আবার নতুন করে নিজেকে পরবর্তী কাজের জন্য তৈরি করে নেয়। ঘুম হল এমনই এক স্বাভাবিক জৈবিক বিশ্রাম প্রক্রিয়া। ঘুমের সময় শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিল ক্রিয়া চলে। ঘুমের শারীরিক ও মানসিক দু’টি দিক রয়েছে। ঘুমের মধ্যেই শরীরের গঠনক্রিয়া চলে। তাই ছোট বয়সে মানুষ বেশি ঘুমোয়। পাশাপাশি ঘুমের মধ্যে শরীর নিজের মেরামতির সুযোগ পায়। সারাদিনের ধকল দূর করে।

অন্যদিকে ঘুমের সময় মস্তিষ্কও তথ্য বাছাইয়ের কাজটি সেরে ফেলে। বিষয়টি একটু বুঝে নেয়া দরকার। আসলে একজন মানুষ সারাদিনে বিভিন্ন উৎস থেকে অগুনতি তথ্য পেয়ে থাকেন। কিন্তু একজন ব্যক্তির এই বিপুল পরিমাণ তথ্যের দরকার পড়ে না। ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সব অপ্রয়োজনীয় তথ্যকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেয়। আর দরকারি তথ্যগুলোকে অত্যন্ত নিপুণভাবে একত্রিত করে গুছিয়ে রাখে। ঘুমের মধ্যে হয়ে চলা শারীরিক ও মানসিক এই দু’ধরনের কাজের সমন্বয়েই একজন মানুষ আগামী সময়ের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে।

কতক্ষণ ঘুম?
সাধারণ হিসেবে বললে, দিনে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম দরকার। তবে শুধু ঘুমের সময়ের দিকে তাকালে বড় বোকামি করা হয়ে যাবে। পাশাপাশি দেখতে হবে ঘুমের গুণমান। অনেক ক্ষেত্রেই ঘুমের সময়ে কোনো গণ্ডগোল না থাকলেও শারীরিক বিভিন্ন কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সবথেকে সমস্যার বিষয় হলো, এই ঘুমের ব্যাঘাতের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি না। তাই শুধু সময় দিয়ে ঘুমের বিচার করা ঠিক হবে না।

প্রশ্ন হলো, ভালো ঘুম হয়েছে তা বুঝব কী করে?
এক্ষেত্রে একটি সহজ হিসেব রয়েছে, ঘুম থেকে উঠে একদম তরতাজা অনুভূতি হচ্ছে, মুছে ফেলা গেছে ফেলে আসা সময়ের ক্লান্তি, সারাদিন আর চোখে ঘুম নেই— তবেই বোঝা যাবে ঘুম হয়েছে পর্যাপ্ত। এটাই পর্যাপ্ত ঘুমের সংজ্ঞা।

পর্যাপ্ত ঘুম না হলে?
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে মূলত দুই ধরনের সমস্যা হয়— সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি।
সাময়িকভাবে কোনো দিন ঘুম না হলে পরের দিন ক্লান্তি, কাজ করার ইচ্ছে কমে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধে, কাজে ভুল-ভ্রান্তি বাড়া ইত্যাদি সমস্যা হয়ে থাকে। এমনকী একদিনের ঘুম না হলেও পরের দিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে।
সাময়িক ঘুমের ব্যাঘাত থেকে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাড়ি চালানোর সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরাই এমন সমস্যায় পড়েন। আসলে পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সাময়িকভাবে দু’চোখ বুজে আসাটা বেশ স্বাভাবিক। দেখা গেছে, গাড়ির চালকের মাত্র ৩ সেকেন্ডের জন্য চোখ লাগার ফলেও অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তবে শুধু গাড়ির চালকই নন, যেকোনো পেশার ব্যক্তিদের অসচেতনতার সুযোগে দুর্ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়।

তবে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদিভাবে মানসিক সতর্কতা কমে যাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, কাজের ইচ্ছে চলে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, দুশ্চিন্তা ও অবসাদে ভোগা, ভুলে যাওয়ার সমস্যা, অ্যালঝাইমার্স ইত্যাদি সমস্যায় মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। শারীরিকভাবে দীর্ঘদিন ভালো ঘুমের অভাব থেকে হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া সহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গেরই ক্ষতি হতে পারে। এমনকী দীর্ঘদিন কম ঘুম হলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও কয়েকগুণ বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

এখানে বলা প্রয়োজন, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানুষ মোটা বা স্থূল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারেন। এমন হওয়ার কারণটিও বেশ অদ্ভুত। আসলে ঘুম না হওয়া বেশিরভাগ মানুষই রাতে উঠে ফ্রিজ খুলে বা রান্নাঘর থেকে নানা খাবার নিয়ে খেয়ে থাকেন। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই ওজন বেড়ে যায়। এছাড়া অপর একটি কারণও রয়েছে। অপর্যাপ্ত ঘুম থেকে মানুষের শরীরের মেটাবলিক কাজকর্ম বিগড়ে গেলে, শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়। এর থেকেও বিনিদ্র মানুষ স্থূলত্বের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন।

ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ কী?
জীবনযাত্রা ও শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে ঘুমের সমস্যা হয়। জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে মোবাইলের কথা। মোবাইল থেকে এক ধরনের নীল আলো বের হয়। এই আলো ঘুমে সাহায্যকারী মেলাটনিন হর্মোনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঘুম আসতে চায় না  ঘুমোতে যাওয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ টিভি দেখা, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহারও ঘুম আসায় বাধা দিতে পারে  অনেক রাতে ঘুমোতে যাওয়া  দুপুরে ঘুমানো ইত্যাদি বিষয় ঘুমের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে।

কয়েকটি অসুখের কারণেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে—
 ইনসমনিয়া— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘুম না আসার প্রধান কারণ ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা। এই রোগের তিনটি ভাগ রয়েছে।
স্লিপ অনসেট ইনসমনিয়া : এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের ঘুমোতে গেলেও ঘুম আসে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকেন। ঘুম আসে অনেকক্ষণ বাদে।
‌঩স্লিপ মেইন্টেনেন্স ইনসমনিয়া : এক্ষেত্রে ব্যক্তি ঘুমিয়ে পড়লেও বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারেন না। বারবার ভেঙে যায় ঘুম।
স্লিপ অফসেট ইনসমনিয়া : রোগীর ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায়।

 স্লিপ রিলেটেড ব্রিদিং ডিজঅর্ডার— এই রোগে আক্রান্তের শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘুমের ব্যাঘাত জড়িয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সমস্যাটা মূলত থাকে নাক থেকে গলা পর্যন্ত শ্বাসনালীর উপরের অংশেই। এই সমস্যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো নাক ডাকা। ব্যক্তি শ্বাস নেওয়ার সময় বায়ু নাক থেকে গলা পর্যন্ত কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বাধা পেয়ে নাক ডাকার শব্দ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ঘুমের সময় স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারেন না। অবশ্য নাক ডাকার সমস্যাকে বেশিরভাগ মানুষই তেমন কোনো শারীরিক সমস্যা বলে আমল দেন না। তবে জেনে রাখুন, এর থেকে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে।

চিকিৎসা
চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো রোগ নির্ণয়। প্রাথমিকভাবে রোগীর লক্ষণগুলি জেনে নেয়া হয়। এখন অবশ্য বিভিন্ন আধুনিক টেস্ট চলে এসেছে। এই টেস্টগুলির মধ্যে স্লিপ টেস্ট উল্লেখযোগ্য।
ইনসমনিয়ার সমস্যা সমাধানে অনেকসময় রোগীর কাউন্সেলিং করতে হয়। এর নাম কগনিটিভ বিহেভিয়ারল থেরাপি। পাশাপাশি কিছু ওষুধও খেয়ে যেতে হয়। নির্দিষ্ট কিছু অসুখ থেকে ঘুমের সমস্যা হলে চিকিৎসা হয় রোগ ধরে।

ঘুমের ওষুধের অভ্যেস নয়
স্বাভাবিক ঘুমের মতো ঘুম, ঘুমের ওষুধ খেয়ে হয় না। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার নানা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তাই চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া একদম উচিত নয়।

স্লিপ হাইজিন
ভালো ঘুমোতে হলে মানতে হবে স্লিপ হাইজিন—
 ঘুমোতে যাওয়ার প্রায় এক ঘণ্টা আগে মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভির ব্যবহার বন্ধ করে দিন।
 ঘুমোতে যাওয়ার আগে খবরের কাগজ পড়বেন না।
 দুপুর বা দিনের অন্য সময় ঘুমের অভ্যেস ছাড়ুন। রাতেই বিছানায় যান।
 ঘুমের সময় ঘর অন্ধকার করে রাখুন।
 শোওয়ার ঘরে বাইরের আওয়াজ কম ঢোকার ব্যবস্থা করুন।
 ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনুন।
 ঘুম না এলে অযথা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করবেন না। বদলে উঠে পায়চারি করতে পারেন। বই পড়ুন, লো-টোনে গান শুনুন। দেখবেন ঠিক ঘুম চলে এসেছে।


আরো সংবাদ



premium cement