২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নিরাপদ মাতৃত্ব

-

একজন গর্ভবতী মা তার গর্ভকালীন সময়ে সম্পূর্ণ সুস্থ ও নিরাপদে থেকে কোনো বিপদ বা ঝুঁকি ছাড়া সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারাটাকেই
নিরাপদ মাতৃত্ব বলা হয়। এ জন্য একজন গর্ভবতী যখন তার গর্ভধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হন, তখন থেকেই রেগুলার চেকআপ
করানো উচিত। এ নিয়ে লিখেছেন অধ্যাপক ডা: রাশিদা বেগম
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে একবার, ২৮ সপ্তাহের পর থেকে ১৫ দিনে একবার এবং ৩৬ সপ্তাহের পর থেকে সাত দিনে একবার চেকআপ করাতে হবে। তবে ডঐঙ-এর সুপারিশ অনুযায়ী, গর্ভবতী মায়েদের অন্তত চারটা ভিজিট হওয়া দরকার। ভিজিটগুলো হচ্ছে ১২-১৬ সপ্তাহে একবার, ২৪-২৮ সপ্তাহে একবার এবং ৩২ সপ্তাহের পরে দুই বার।
এ ধরনের চেকআপ কোথায় করাবেন
যেকোনো এমবিবিএস ডাক্তারই চেকআপ করতে পারেন। প্রতিটি প্রেগন্যান্সিই ঝুঁকিপূর্ণÑ এটা সব ডাক্তারই জানেন। এ ছাড়া যেখানে সাব-সেন্টার রয়েছে, সেখানে হেলথ ভিজিটররাও চেকআপ করতে পারেন। কারণ তাদের এ বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি মনে করেন ডাক্তারদের জানাতে হবে, সে ক্ষেত্রে তারা রেফার করে দেন। এরপর উপজেলা বা জেলাপর্যায়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাই চেকআপ করেন।
গর্ভাবস্থায় ঝুঁঁকিপূর্ণ লক্ষণগুলো কী কী
অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ কিছু সাইন বা লক্ষণ আছে, যেমন গর্ভাবস্থায় যদি রক্তপাত হয়। প্রথম দিকে এবরশন, মোলার প্রেগন্যান্সি এবং একটোপিক প্রেগন্যান্সির জন্য হয়। ২৮ সপ্তাহের পরে গর্ভফুল জরায়ুর নিচের দিকে থাকলে রক্তপাত হয়। গর্ভফুল স্বাভাবিক জায়গায় থাকলেও কখনো জরায়ুগাত্র থেকে ছুটে গেলে রক্তপাত হয়। এগুলো সাঙ্ঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া প্রেগন্যান্সির সময় অতিরিক্ত বমি হওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হাত-পা ফুলে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, উপর পেটে ব্যথা করা, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া যা প্রি-একলাম্পসিয়া, একলাম্পশিয়াতে হয় এগুলো। পেট বেশি বড় বা খুব ছোট হওয়া, সন্তান কম নড়াচড়া করা, পানি ভেঙে যাওয়া, রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়া এগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ কিছু লক্ষণ।
গর্ভাবস্থায় কী কী টিকা নিতে হয় এবং কখন নিতে হয়
গর্ভাবস্থায় টিটেনাস ইনজেকশন দেয়া হয়। সাধারণত দু’টি ইনজেকশন নেয়া হয়, ২০ সপ্তাহের পর থেকে এক মাসের ব্যবধানে দু’টি ইনজেকশন নেয়া হয়। যাদের পাঁচটা ডোজ কমপ্লিট আছে, তাদের আর ইনজেকশন দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
গর্ভবতী মায়েরা অপুষ্টিতে ভুগলে করণীয়
প্রেগন্যান্সিতে যেহেতু সন্তান মায়ের কাছ থেকে পুষ্টি নিয়ে বড় হয়, এ সময় মায়ের অতিরিক্ত ক্যালরি দরকার। একজন স্বাভাবিক মায়ের যে পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মায়ের তার চেয়ে বেশি পুষ্টি প্রয়োজন হয়। গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন প্রায় ৩০০ ক্যালরি বেশি দরকার হয়। এই অতিরিক্ত ক্যালরির প্রয়োজন মেটানোর জন্য সব খাবারই কিছু কিছু করে বেশি খেতে হবে। মা যদি না খান, সে ক্ষেত্রে মা অসুস্থ হয়ে যাবেন। আর সন্তান তো মায়ের শরীর থেকে খাবার নিয়ে বড় হয়। যদি মা সুস্থ না থাকেন, সে ক্ষেত্রে সন্তানও তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিতে পারবে না। শিশুর গ্রোথ বা বৃদ্ধি কম হবে। এমনকি নিউরোলজিক্যাল সমস্যাও হতে পারে। কাজেই গর্ভকালীন সময়ে পুষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
গর্ভবতী মায়ের প্রতি পরিবারের কর্তব্য বা করণীয়
পরিবারের করণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। প্রেগন্যান্সি মোটেও সহজ জিনিস নয়। প্রতিটি প্রেগন্যান্সিই কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এ সময় একটা মানুষের মধ্যে আরেকটা মানুষ তৈরি হয়। এ সময়টা মায়ের পুরো দৈহিক কাঠামোতেই পরিবর্তন ঘটে। এ সময় তার শারীরিক পরিবর্তন হয়, যেমন তার পেট বড় হয়। এ ছাড়া, এ সময় কারো কারো ব্লাড-সুগার কিংবা ব্লাড-প্রেশার বেড়ে যেতে পারে।
গর্ভবতীদের এ সময়ে স্বাভাবিক গৃহস্থালি কাজ করতেও কষ্ট হয়। এটা স্বাভাবিক বিষয়। পরিবারের উচিত, এ সময়ে তাদেরকে গৃহস্থালি কাজ থেকে বিরত রাখা। একজন মায়ের পর্যাপ্ত বিশ্রাম দরকার।
চাকরিজীবী মায়েদের ব্লাড-সার্কুলেশনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যদি তারা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করেন। যার ফলে সন্তানের গ্রোথও কম হতে পারে। এ সময় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করা যাবে না। বাসার কাজেও তাদেরকে রিলিফ দেয়া উচিত, যাতে তারা বিশ্রাম নিতে পারে।
দুপুরে খাওয়ার পর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়া উচিত। না ঘুমালেও অন্তত শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। হঠাৎ কোনো সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
ইদানীং বন্ধ্যাত্বের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? সন্তান নেয়ার উপযুক্ত সময় কখন
২০-এর পরই যে কেউ সন্তান নিতে পারে। এর আগে সন্তান নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। আবার ৩৫ বছর বয়সের পর প্রেগন্যান্সি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। তখন মা ও সন্তানের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, অল্পবয়স্ক মেয়েদেরও বন্ধ্যাত্ব দেখা যাচ্ছে। এর কারণ পরিবেশগত হতে পারে, আবার খাবারও অনেকখানি দায়ী। কারণ আজকাল কোনো খাবারই ঠিক নেই। সবকিছুতেই ভেজাল। যেকোনো খাবারেই আজকাল কেমিক্যাল থাকে। ফল বা খাবারে প্রিজারভেটিভ থাকে। এই কেমিক্যাল দায়ী হতে পারে। পুরুষের বন্ধ্যাত্ব বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ পরিবেশগত দূষণ। এ ছাড়া বেশি বয়সে বিয়ে এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টও বন্ধ্যাত্ব বেড়ে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ।
মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের করণীয়
সরকার চেষ্টা করছেন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তৃণমূলে সেবা পৌঁছে দেয়ার। সব পর্যায়ে যদি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকে এবং সেগুলো সবাই পায়, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু ধরুন, ভবন আছে কিন্তু লজিস্টিক সাপোর্ট নেই, সে ক্ষেত্রে তো সমস্যা। শুধু ডাক্তার থাকলে তো আর হবে না। সেবা দিতে হলে দরকার পর্যাপ্ত ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি, রোগ নির্ণয়ের পর্যাপ্ত সুবিধা। কিন্তু তৃণমূলে এসব কি পর্যাপ্ত আছে? ডাক্তারদের নিজেদেরই কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। এ জন্য পেরিফেরিতে ডাক্তার ঠিকমতো থাকতে পারেন না। এটি একটি জটিল সমস্যা।
মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে চিকিৎসকদের ভূমিকা
চিকিৎসকদের ভূমিকা অনেক। তাদের কাজ হচ্ছে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে যথোপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া। চিকিৎসকরা উপজেলায় থাকবে আর সরকারের উচিত জনগণের স্বার্থে ডাক্তারদের ভালো এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। কাজের পরিবেশ তৈরি করা ডাক্তারদের কাজ নয়, সেটা কিন্তু নীতি-নির্ধারকদের কাজ। কাজেই ডাক্তারদের ডেডিকেশন এবং সরকারের উপযুক্ত সাপোর্ট মিলেই কমবে। যেমন আগের তুলনায় অনেক কমেছে পেরিফেরিতে ডাক্তারদের সাপোর্ট আছে বলেই।
নরমাল ডেলিভারি বনাম সিজারিয়ান সেকশন
বর্তমানে কিছু কিছু জায়গায় সিজারিয়ান সেকশন বেড়ে যাওয়ার কারণ হলোÑ জনগণের মধ্যে নিরাপদ শিশুর জন্মলাভের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা নিশ্চিতকরণ।
মনে করুন, কোনো দম্পতির সন্তান হচ্ছে বিয়ের ১২-১৪ বছর পরে বা আইভিএফ করে। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে তারা একটা সন্তান নেয়। সে ক্ষেত্রে রোগী নিজেই চান না একটা কঠিন পরিস্থিতি (নরমাল ডেলিভারি) মোকাবেলা করতে বা ঝুঁকি নিতে। ভেজাইনাল ডেলিভারি, সিজারের চেয়ে অবশ্যই উত্তম। কিন্তু ভেজাইনাল ডেলিভারি কখনো কখনো সন্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের দেশে সিজারের পরিমাণ কিন্তু বেশি নয়। সিজারের মূল কারণ হচ্ছেÑ নিরাপদ ডেলিভারি। যেকোনো ভেজাইনাল ডেলিভারিতেই কিছু ঝুঁকি আছে। যেমন সন্তানটা কেমন অবস্থায় আছে তা পুরোপুরি বোঝা যায় না।
সাধারণত টাকার জন্য কেউ সিজার করে না। এমন অনেক ডাক্তার আছেন যারা বিপদ এড়ানোর জন্য সিজার করে থাকেন। রোগী হাসপাতালে রেখে বাসায় গেলেও টেনশন কাজ করে। কারণ বাসায় গিয়ে মনে হবে, সন্তানের হার্ট সাউন্ড কেমন আছে? পানির রঙ কেমন আছে? সন্তানটা আটকে যাচ্ছে কি না? এসব নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হবে।
আর যার কাছে রেখে যায় সে যদি ওই লেভেলের না হয়, তাহলে তার কাছে রেখে যাওয়া মুশকিল। আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এ জন্য ওইরকম এক্সপার্টের কাছে রেখে না গেলে নরমাল ডেলিভারি আসলেই কষ্টসাধ্য। এ জন্য এক্সপার্ট মিডওয়াইফ দরকার। অনৈতিক ডাক্তারদের জন্য কোথাও কোথাও অপ্রয়োজনীয় সিজার হয়ে থাকে। তবে রোগী ও চিকিৎসক উভয়পক্ষের ধৈর্যের অভাব কিছুটা দায়ী। এই কারণেই দক্ষ মিডওয়াইফের কোনো বিকল্প নেই। অবিরাম মনিটরিং, এপিডুরাল এনেস্থেশিয়া এবং প্রয়োজনে কনসালট্যান্ট যদি মনে করেন, মিডওয়াইফই যথেষ্ট, সে ক্ষেত্রে পেশেন্টের সেটা মেনে নেয়ার মানসিকতা, সিজারের হার কমাতে পারে।
সিজারের নেতিবাচক কোনো দিক আছে কি না
নরমাল ইজ নরমাল। সবকিছুই যদি নরমাল হয় তাহলে এর বিকল্প কিছুই নেই। সেটাই বেস্ট। সিজারের সময় এনেস্থেটিক জটিলতা, কাটা জায়গায় ইনফেকশন, ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। স্বাভাবিক ডেলিভারির পরে সাথে সাথেই পেশেন্ট হেঁটে বেড়াতে পারে, কিন্তু সিজারের পর অন্তত সাত দিন সে কিছুটা হলেও অসুস্থ থাকে। সিজারের পর যদি জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে অন্যান্য আরো কিছু সমস্যা হতে পারে। জটিল পরিস্থিতি না হলে কোনো অসুবিধাই হয় না। তবে তিন-চারবারের বেশি প্রেগন্যান্সি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।


আরো সংবাদ



premium cement