২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ল্যাটেক্স অ্যালার্জির ধরন ও চিকিৎসা

-

গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে প্রাকৃতিক রাবার থেকে তৈরি ল্যাটেক্স অ্যালার্জি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা ল্যাটেক্স গ্লাভস ব্যবহার করে থাকেন রোগী। পরীক্ষা করার সময় যাতে নিজেরা সংক্রামিত না হন। ক্রমবর্ধমান অ্যালার্জির কারণে এই প্রযুক্তি
পরিবর্তন আনার কথা উঠছে। লিখেছেন অধ্যাপক ডা: গোবিন্দ চন্দ্র দাস

ল্যাটেক্স হচ্ছে, রাবার গাছ থেকে উৎপন্ন দুধের মতো তরল একটি প্রাকৃতিক পদার্থ। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ল্যাটেক্স ব্যবহার করে বিভিন্ন জিনিস প্রস্তুত করা হয়। যেমনÑ গ্লাভস ও বেলুন। এসব প্রস্তুত করার সময় ল্যাটেক্সের সাথে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত করা হয়, যাতে এগুলোর পিচ্ছিলতা বজায় থাকে এবং রাবারকে বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে থেকে দূরে রাখে।
এই সমস্ত রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে অ্যালার্জি রোগীর ল্যাটেক্স ব্যবহার করলে তাদের অ্যালার্জির প্রকোপ বেড়ে যায়। গ্লাভস ও বেলুনের পাশাপাশি কনডমের কথাও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সীমিত কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ল্যাটেক্স অ্যালার্জির কারণে রাবার ব্যান্ড, পেন্সিলের দাগ তোলার ইরেজার, রাবারের তৈরি খেলা, মেডিক্যাল সরঞ্জাম, কাপড়ে রাবারের ইলাস্টিক এবং শিশুদের ফিডার ব্যবহার করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে শক্ত ক্রেপ রাবার যেমনÑ জুতার তলার কারণে সচারচর অ্যালার্জি হয় না। রাবার থেকে উৎপন্ন পেইন্ট সচারচর অ্যালার্জি উৎপন্ন করে না, যদি না এর সাথে ল্যাটেক্স মেশানো হয়।
অ্যালার্জির ধরন : ল্যাটেক্স থেকে দুই ধরনের অ্যালার্জি সংঘটিত হয়। প্রথমটি হচ্ছে ডিলেইভ ধরনের কণ্টাক্ট ডারমাটাইটিস। এ ক্ষেত্রে শরীরে র্যাশ বা চাকা দাগ তৈরি হয়। র্যাশ বেশি দেখা যায় (গ্লাভস ব্যবহার করা হয় হাতেই) তবে শরীরের অন্য অংশ ল্যাটেক্সের সংস্পর্শে এলে সেখানেও র্যাস বের হয়। এই ডারমাটাইটিসের কারণ হচ্ছে রাবারের সাথে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য। আশার কথা হচ্ছে, খুব বিরক্তিকর হলেও এই ধরনের অ্যালার্জি লাইফের প্রতি হুমকি নয়।
দ্বিতীয় অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে আই-জি-ই বাহিত অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া। এটি খুবই মারাত্মক। এ ধরনের রোগীরা সচারচর আগেই ল্যাটেক্সের সংস্পর্শে এসে সেনসিটিভ বা স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন। অর্থাৎ এরা হচ্ছেন ল্যাটেক্স স্পেসিফিক আই-জি-ই এন্টিবডি পজিটিভ। এরা পরবর্তীতে আবার ল্যাটেক্সের সংস্পর্শে এলে শুরু হয় চুলকানি, শরীর লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে উঠা, হাঁচি এবং শ্বাসকষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে এই অ্যালার্জি জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠে। তখন তাকে বলা হয় অ্যানফাইলেক্সিস। এ ধরনের রোগীর উপসর্গ হচ্ছে শক, শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ কমে যাওয়া। ত্বরিত ব্যবস্থা না নিলে জীবনহানি ঘটতে পারে।
এই ধরনের অ্যালার্জির তীব্রতা নির্ভর করে রোগীর স্পর্শকাতরতার অনুপাত এবং ল্যাটেক্সের সাথে তার সংস্পর্শের পরিমাপের ওপর। সবচেয়ে বিপদের কারণ ঘটে যখন শরীরের আদ্র অংশে ল্যাটেক্সের সংস্পর্শে ঘটে এবং অপারেশনের সময় যখন শরীরের ভেতরের অংশে ল্যাটেক্স স্পর্শিত হয়। কারণ এই সব জায়গা থেকে ল্যাটেক্স দ্রুত পরিশোষিত হয়ে থাকে।
বাতাসের মাধ্যমেও ল্যাটেক্স শ্বাসতন্ত্রের সংক্রামণ ঘটাতে পারে। যেমনÑ গ্লাভসে যে কর্নস্টার্চ পাউডার ব্যবহৃত হয়, ল্যাটেক্স তার সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়। যখন এই গ্লাভস ব্যবহৃত হয় তখন কর্নস্টার্চ পাউডারের সাথে ল্যাটেক্সেও ঘরের বাতাসে মিশে উড়তে থাকে। বাতাসে ভাসমান এই কণাগুলো নিঃশ্বাসের সাথে মানুষের শরীরের প্রবেশ করে এবং অ্যালার্জি সংঘটিত করে। যত বেশি পরিমাণে কর্নস্টার্চ পাউডার ব্যবহৃত করা হয়, অ্যালার্জির ঝুঁকি তত বেড়ে যায়। সেই কারণে এখন চেষ্টা করা হচ্ছে পাউডারহীন গ্লাভস বা সিনথেটিকভাবে প্রস্তুত ভিনাইল নাইট্রাইল দ্বারা গ্লাভস তৈরি করা হচ্ছে।
রোগের হার
যারা ল্যাটেক্স কারখানায় কাজ করেন এবং ল্যাটেক্স দ্বারা তৈরি গ্লাভস ও অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করেন, তারাই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। যাদের স্পাইন বাইফিডা (জন্মগত রোগ মেরুদণ্ডে) কিংবা রেচনতন্ত্রে জন্মগত ত্রুটি আছে তাদের শতকরা ৫০ জনের এই অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি শতকরা ১০ ভাগ। অন্যদের মধ্যে যারা অনেকবার শৈল্য চিকিৎসার মুখোমুখি হয়েছেন তারাও ঝুঁকিপূর্ণ। রাবার কারখানার কর্মীরা যে ঝুঁকির মধ্যে থাকেন তা বলাই বাহুল্য। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান মানুষদের এই অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ছয় ভাগ।
ল্যাটেক্স অ্যালার্জির রোগীদের কিছু কিছু খাবারের প্রতি অ্যালার্জি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যেসব খাদ্যে ল্যাটেক্সের মতো একই প্রোটিন থাকে, সেই খাদ্যগুলোতে অ্যালার্জি সৃষ্টি হয়। যেমন কলা, কিউই ফ্রুট।
মূল্যায়ন এবং চিকিৎসা
ল্যাটেক্স অ্যালার্জি চিকিৎসার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সচেতনতা। যদি মনে হয় যে, আপনার এই ধরনের অ্যালার্জি আছে তাহলে অবিলম্বে অ্যালার্জি চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন। রোগের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে এবং আপনাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেবেন যে, আপনার কোনো ল্যাবরেটরি টেস্টের প্রয়োজন আছে কি না। যদি ল্যাটেক্স অ্যালার্জি থাকে তাহলে আপনাকে যতদূর সম্ভব প্রাকৃতিক ল্যাটেক্সের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। আপনার পরিবার, আপনার সন্তান, আপনার নিয়োগস্থল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (ছাত্র হলে) কর্মকর্তাদের আপনার অ্যালার্জির কথা জানিয়ে দিন। অনেক দেশে রোগীরা হাতে নির্দিষ্ট ধরনের ব্রেসলেট ব্যবহার করেন যা দেখে অন্যরা বুঝতে পারে যে, ওই ব্যক্তি ল্যাটেক্স অ্যালার্জিতে আক্রান্ত। আপনার ডাক্তারের কাছে জেনে নেবেন যে আপনাকে জরুরি প্রয়োজনের জন্য ইপনেফ্রিন ইঞ্জেকশন সাথে রাখতে হবে কি না।
আপনি যদি এখন চাকরিতে থাকেন, সেখানে ল্যাটেক্স ব্যবহার কাজ করতে হয়, তাহলে আপনার নিয়োগকর্তার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন। আপনার যোগ্যতা থাকলে তিনি হয়তো আপনাকে অন্য বিভাগে নিয়োগ দেবেন।
আপনি অন্য ধরনের গ্লাভস ব্যবহার করতে পারেন। যেমন ভিনাইল বা নাইট্রেইল গ্লাভস। তবে তাদের কার্যকারিতা সমান হবে না। তা ছাড়া সেগুলো ব্যয় বহুলও ঘটে। ল্যাটেক্স গ্লাভস ব্যবহার করলেও তাতে যেন অন্তত কর্নস্টার্চ থাকে সেটুকু খেয়াল রাখতে হবে।
আপনার যদি ল্যাটেক্সজনিত শ্বাসকষ্টের রোগ থেকে থাকে, তাহলে যে এলাকাতে ল্যাটেক্স ব্যবহার করা হয় সেই এলাকাতে পারতপক্ষে যাবেন না। যেখানে গ্লাভস খুব বেশি ব্যবহৃত হয়, সেখানে উচিত পাউডারবিহীন গ্লাভস ব্যবহার করা। অ্যালার্জি রোগীদের জন্য ল্যাটেক্স কনডম ব্যবহার বিপজ্জনক। একটি বিকল্প হতে পারে ন্যাচারাল স্কিন কনডম। এতে ল্যাটেক্স থাকে না এবং এগুলো জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমান কার্যকরী। তবে এইডস এইচআইভি বা অন্যান্য যৌন রোগের সংক্রামণ রোধে কার্যকারী নয়। এখন চেষ্টা করা হচ্ছে সিনথেটিক রাবার থেকে কনডম তৈরির যা এই সমস্যার সমাধান করবে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন এমন ল্যাটেক্স সামগ্রী তৈরি করতে যেগুলোতে ল্যাটেক্স অ্যালারজেন কম থাকবে। তা হলে ল্যাটেক্স অ্যালার্জি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সুনিশ্চিতভাবে।

লেখক : অধ্যাপক, ইমুনোলজি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা।
চেম্বার : হলিস্টিক হেলথ কেয়ার সেন্টার, ৫৭/১৫ পান্থপথ, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১৫৯৪২২৮


আরো সংবাদ



premium cement