২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জরায়ুর মুখের ক্যান্সার

-

মহিলাদের নিচ পেটে সন্তান ধারণের অঙ্গের নাম জরায়ু। জরায়ুর নিম্নভাগের অংশকে জরায়ুর মুখ বলে। জরায়ুর মুখে অনেক সময় ক্যান্সার হয়। স্তন ক্যান্সারের পর জরায়ুর মুখের ক্যান্সারই মহিলাদের দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার। জরায়ুর মুখের ক্যান্সারে অনেক মহিলার মৃত্যু হয়। লিখেছেন অধ্যাপক ডা: মো: শহীদুল্লাহ
জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের কারণ ও ঝুঁকিসমূহ
প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস’ (এইচপিভি) নামে একটি ভাইরাস দিয়ে জরায়ুর মুখের ক্যান্সার হয়। এইচপিভির ১০০টির ওপরে প্রজাতি আছে। এর মধ্যে এইচপিভি ১৬ ও ১৮ প্রজাতি শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। যৌন মিলনের মাধ্যমে এই ভাইরাস দ্বারা যৌনাঙ্গে সংক্রমণ ঘটে। যৌনজীবন বা বিবাহিত জীবনের শুরুতেই সাধারণত এই সংক্রমণ সংঘটিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যান্সার সৃষ্টি না করে সংক্রমণটি নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়। বাল্যবিয়ে, কম বয়সে সহবাস, অধিক সন্তান প্রসব, একাধিক যৌনসঙ্গী থাকা, তামাক সেবন করা, দারিদ্র্য, নিরাপদ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাবÑ এসবের জন্য জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বাল্যবিয়ে, কম বয়সে সহবাস, একাধিক যৌনসঙ্গী থাকা বা তামাক সেবন করার কারণে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়। ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ১৬ ও ১৮’ দিয়ে সঙ্ঘটিত সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হলে জরায়ুর মুখে ‘প্রি-ক্যান্সারাস ক্ষত’ বা ক্যান্সার পূর্ববর্তী ক্ষত তৈরি হয়। সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে জরায়ুর মুখের ‘প্রি-ক্যান্সারাস ক্ষত’ পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়। প্রি-ক্যান্সারাস ক্ষত থেকে ক্যান্সার হতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। ৩৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মহিলারাই এ রোগের শিকার হন বেশি।
লক্ষণ
জরায়ুর মুখের ক্যান্সার পূর্ববর্তী ক্ষতের সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না। আবার ক্যান্সারের প্রথম দিকেও কোনো লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে। জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে : মাসিকের রাস্তায় অনিয়মিত ও অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। দুই মাসিকের মধ্যবর্তী সময়েও রক্তক্ষরণ হতে পারে। সহবাসের পরে মাসিকের রাস্তায় রক্তক্ষরণ হয়। এটি জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। মাসিকের রাস্তায় দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব বের হয়। এ ছাড়া নিচ পেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা বা অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করা, ওজন কমে যাওয়া, খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণও দেখা দিতে পারে। ক্যান্সার ছড়িয়ে গেলে আরো মারাত্মক লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
ক্যান্সারের তিঝনিং পরীক্ষা
আপাত সুস্থ কোনো মহিলার জরায়ুর মুখে কোনো ‘প্রি-ক্যান্সারাস ক্ষত আছে কি না বা কোনো লক্ষণবিহীন ক্যান্সার আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার নাম ‘তিঝনিং পরীক্ষা। তিঝনিং করে প্রি-ক্যান্সারাস ক্ষত পাওয়া গেলে সহজেই তার চিকিৎসা করে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যেতে পারে। আর প্রাথমিক স্তরে ক্যান্সার ধরা পড়লে তার চিকিৎসা করাও সহজতর ও সফলতর হয়। জরায়ুর মুখের ক্যান্সারের ‘তিঝনিং’ পরীক্ষা হিসেবে ‘প্যাপ এসমিয়ার’ (চধঢ় ংসবধৎ) টেস্ট ও ভায়া (ঠরংঁধষ ওহংঢ়বপঃরড়হ রিঃয অপবঃরপ ধপরফ) টেস্ট ঘ সাধারণত এ দুটি পরীক্ষা করা হয়। ৩০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের জীবনে অন্তত একবার তিঝনিং টেস্ট করাতে হবে। আদর্শ নিয়ম হলো, ২০ বছর বয়স থেকে অথবা বিয়ের তিন বছর পর থেকেই নিয়মিতই তিঝনিং টেস্ট করানো। প্যাপ এসমিয়ার টেস্টে জরায়ুর মুখের লালা নিয়ে এর কোষগুলোতে অস্ব^াভাবিক কোনো পরিবর্তন আছে কি না, তা দেখার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হয়। এটি জরায়ুর মুখের ক্যান্সার তিঝনিংয়ের গোব স্ট্যাটার্ড পরীক্ষা। তবে খরচ বেশি এবং করাও তুলনামূলকভাবে কঠিন। ভায়াং নামক তিঝনিং টেস্ট খুবই সহজ। এই পরীক্ষায় জরায়ুর মুখে একটু অ্যাসিটিক এসিড লাগিয়ে দেয়া হয়। স্বাভাবিক জরায়ুর মুখের রঙ হালকা গোলাপি। কিন্তু সেখানে যদি কোষের অস্ব^াভাবিক কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকে, তবে অ্যাসিটিক এসিডের কারণে সে অংশের রঙ সাদা হয়ে যায়। এরপর সাদা পরিবর্তন হলে বুঝতে হবে সেখানে অস্বাভাবিক কোষ আছে। এটা প্রি-ক্যান্সারাস ক্ষত বা ক্যান্সার পূর্ববর্তী ক্ষতও হতে পারে, আবার ক্যান্সারও হতে পারে। এর নাম ভায়াং টেস্ট পজিটিভ। ভায়াং টেস্ট পজিটিভ হলে কলপোক্রোপি করে জরায়ুর মুখের সাদা ছোপ থেকে একটু বায়োপসি নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষা করে ক্যান্সার হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে এ টেস্ট করানো যায়। ভায়াং টেস্ট নেগেটিভ হলে তিন বছর পর পর এ পরীক্ষাটি করাতে হবে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত।
ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয়
জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য টিকা আছে। ৯ বছর বয়স থেকে তিন ডোজে এই টিকা দেয়া যায়। উপযুক্ত সময় হলো ৯ থেকে ১৩ বছর বয়স। প্রথম ডোজের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে না করা, কম বয়সে যৌনমিলন না করা, অনিরাপদ যৌনমিলন না করা, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার না করা, ছেলেদের খতনা করা ইত্যাদিও জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। নিয়মিত তিঝনিং করানোও জরায়ুর মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের অংশ।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ।

 


আরো সংবাদ



premium cement