২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ডা: জিনাত ডি লায়লা

মাথাব্যথা ও মানসিক রোগ

-

মাথাব্যথা ও দৈনন্দিন জীবন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাথাব্যথা ছাড়া জীবন কল্পনাতীত। কর্মব্যস্ত জটিল ও গতিশীল এবং প্রতিযোগিতায় ভরপুর আমাদের এই জীবনে মাথাব্যথা তো লেগেই আছে। যদিও মাথাব্যথা আমাদের অত্যন্ত পরিচিত ব্যাধি এবং
মাথাব্যথা হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। লিখেছেন ডা: জিনাত ডি লায়লা
মাথাব্যথা অত্যন্ত অবহেলিত আমাদের এই উন্নয়নশীল দরিদ্রতায় পূর্ণ এই বাংলাদেশ। তবে এটি অত্যন্ত লক্ষণীয় বিষয় যে, বেশির ভাগ মাথাব্যথাই সাধারণত মানসিক কারণে হয়ে থাকে। মাথাব্যথাকে অবহেলা করলে এটি একটি জটিল রোগে পরিণত হয়ে আপনাকেই আঘাত করবে ভয়াবহভাবে। তাই আমাদের সচেতনতার জন্য মাথাব্যথা সম্পর্কে কিছু কথা জেনে রাখা ভালো।
কেমিক্যাল মেসেঞ্জার সেরোটনিন বা রাসায়নিক সংবাদ প্রেরক সেরোটনিন যাকে বলা হয় নিউরোট্রান্সমিটার, এই সেরোটনিন নামক পদার্থ অত্যধিক পরিমাপে বৃদ্ধি পেলে তা মস্তিষ্কেও রক্তনালীর ওপর কাজ করে মাথাব্যথার দৃষ্টি করে। প্রায় ৭০ শতাংশ মাথাব্যথাই মানসিক বা সাইকোলজিক্যাল কারণে হতে দেখা যায়। মাথাব্যথা হলেই নিজের ইচ্ছামতো যেনতেন ওষুধ খাওয়া আমাদের চিরাচরিত অভ্যাস যা কি না উচিত নয়। যেনতেনভাবে ওষুধ গ্রহণ করার অর্থ হলো মাথাব্যথাকে দীর্ঘকাল ধরে লালন-পালনের ব্যবস্থা করা। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ পাওয়া মানে নিজেই নিজের সাথে অন্যায় করা যা কি না বুমেরাং হয়ে আপনাকেই আঘাত করবে। বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগও মাথাব্যথা হয়ে থাকে অথবা কোনো রোগের উপসর্গ হিসেবেও হয়ে থাকতে পারে। যা অনেক মানুষই বুঝতে পারে না।
তাইতো বোঝার জন্য প্রয়োজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। মানসিক রোগের কারণে যে মাথাব্যথাগুলো হয় সে ক্ষেত্রে মানসিক রোগের ডাক্তার আপনাকে যথেষ্ট উপকার করতে পারবেন। ছোট থেকে শুরু করে বড় বড় মানসিক রোগের মাথাব্যথার সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমনÑ বিষণœতার কথাই ধরি। বিষণœতা এক প্রকার মানসিক রোগ বা ব্রেন ডিজিজ। বিষণœতাজনিত মানসিক রোগে যে মাথাব্যথা হয় তা মাথাব্যথায় ব্যবহৃত সাধারণ ওষুধে ভালো হয় না। বিষণœতায় সৃষ্টি মাথাব্যথার সাথে থাকে একাকিত্ব বা মন শূন্য শূন্য এবং খালি খালি লাগার অনুভূতি, অনিদ্রা, কাজে-কর্মে ভীষণ অবনতি, খাদ্য গ্রহণের প্রতি অনীহা, অরুচি, ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি, যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া, আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগা, নিজেকে শেষ করার মনোভাবসহ নানারকম উপসর্গ। তবে এ মাথাব্যথা এলোমেলো বা ভোঁতা ধরনের।
বিষণœতাজনিত মাথাব্যথায় প্রায় সময়ই পুরো মাথাজুড়ে ব্যথা থাকে। ভোরবেলা ও বিকেলে ভালো না লাগার ভাবটা বেশি থাকে, সাথে সাথে দারুণ অস্থির ভাব। বিষণœতা কী মাথাব্যথা সৃষ্টি করে কিংবা মাথাব্যথার জন্য কি বিষণœতা হতে পারে তা একটি বিতর্কিত ও কঠিন বিষয়। বিষণœতার সাথে জড়িত নিউরোট্রান্সমিটার হলো সেরোটনিন যা কি না মাথাব্যথার সাথেও জড়িত। বিষণœতাসম্পন্ন রোগীদেরও মাথাব্যথা থাকতে পারে। আর সে জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত চিকিৎসা। সঠিক রোগ নির্ণয় ও বিষণœতার সঠিক চিকিৎসা বিষণœতার সাথে জড়িত মাথাব্যথাকে প্রশমিত করতে সাহায্য করবে। বিষণœতার কারণে মাথাব্যথা হয়ে থাকলে রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিষণœতা নিরোধক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারটি বিষণœতা ও মাথাব্যথা উভয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই বিষণœতা রোগ নির্ণীত হলে বিষণœতা দূরীভূত হয় এমন ওষুধ রোগীর ওপর প্রয়োগ করতে হয়।
আবেগের বিকৃতি বা আবেগজনিত মানসিক সমস্যায়ও মাথাব্যথার উদ্রেক হতে পারে। আবেগের ওঠানামায় মাথাব্যথার সমস্যা হতে পারে। আবার দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথাও হতে পারে। সাধারণত বিকেল ও সন্ধ্যার সময় বা পরে দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথা হতে পারে। দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথা ধীরে ধীরে তীব্রতার দিকে এগিয়ে যায়। মূল উপসর্গগুলো হলোÑ মাথার চার পাশে চাপ অনুভূতি, গলা, ঘাড় ও কাঁধের মাংসপেশিতে টানটান ভাব। দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথার অন্যান্য উপসর্গ হলো ঘুমের অসুবিধা, চিন্তাভাবনা হওয়া, বিরক্তভাব সৃষ্টি হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া। এ ধরনের মাথাব্যথা উজ্জ্বল আলোতে বেড়ে যায়। দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথার সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, কাজকর্মেও মাত্রাতিরিক্ত চাপ, হতাশা-নিরাশা, আহাজারি ইত্যাদি কারণে এ ধরনের মাথাব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম, খোলা মন নিয়ে চলা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি কাজ এরকম মাথাব্যথা দূর করতে সহায়তা করে থাকে। দুশ্চিন্তাজনিত মাথাব্যথায় ক্যাফেইন বেশ কার্যকরী। আপনার মাথাব্যথা যদি দিনের পর দিন লেগেই থাকে অথবা সেটা যদি সাধারণ মাথাব্যথার ওষুধ খাওয়ার পরও না কমে তবে আপনার যোগাযোগ করা উচিত মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে। মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যাওয়া লজ্জার কিছু নয়। আমাদের সমাজে মানসিক রোগীর শরণাপন্ন হওয়াকে কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখে বা উপহাসের চোখে দেখে, যা কিনা একেবারেই ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার যে শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগও একটি রোগ এবং এই রোগেরও রয়েছে আধুনিক চিকিৎসা। হাত কেটে গেলে যেমন ব্যান্ডেজ করতে হয় তেমনি মনে যদি আঘাত লাগে দরকার মনের চিকিৎসা। দুটোই রোগ এবং দুটোরই রয়েছে চিকিৎসা। তাই মানসিক রোগীকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
আমার দীর্ঘদিনের চিকিৎসক জীবনে আমি দেখেছি বহু রোগী প্রথমে মাথাব্যথার সমস্যা নিয়ে আসে, কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর দেখা যায় তাদের মধ্যে কেউ কেউ মানসিক রোগে ভুগছে। তবে মাথাব্যথা হলে সবারই যে মানসিক সমস্যা থাকবে এমন কোনো কথা নেই। মাথাব্যথার রয়েছে অনেক চিকিৎসা। শারীরিক বহু কারণেও মাথাব্যথা হয়ে থাকে। তবে সেটা শারীরিক কারণজনিত মথাব্যথা নাকি মানসিক কারণজনিত মাথাব্যথা তা নির্ণয় করবেন আপনার ডাক্তার। তাই আমাদের সবারই উচিত মাথাব্যথাকে অবহেলা না করা এবং যথাসময়ে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে ওষুধ সেবন করা।

লেখিকা : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
চেম্বার : উত্তরা ল্যাবএইড, ইউনিট-২, সেক্টর-১৩, উত্তরা, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement