২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাসিকে নানা ধরনের সমস্যা

-


সায়মা বয়স ২৪। ভার্সিটিপড়–য়া তুখোড় ছাত্রী। পড়াশোনায় যারপরনাই মনোযোগ। কিন্তু সমস্যাটা মাসিকের সময় হয়। মাসিক শুরু হওয়ার দুই দিন আগে থেকেই ব্যথা শুরু হয়। এ জন্য ভার্সিটিও কামাই দিতে হয়। প্যারাসিটামল বড়ি দিনে দু-তিনবার খেয়েও লাভ হয় না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় প্রাকটিক্যাল ক্লাস মিস হলে। কাভার করা খুবই কঠিন। আর মাসিকের দিন তো রোজ কিয়ামত। চিৎকার ও কান্নায় ভেসে যায় সায়মা। হায়রে কষ্ট। মাঝে মধ্যে বিষণœœতায় ভোগে। এ আবার কেমন রোগ। মা সবসময় চিন্তিত থাকেন। এক ভাই এক বোনের সংসারে মা সায়মার ভবিষ্যৎ নিয়েও উৎকণ্ঠায় থাকেন। বাবা অবশ্য এত কিছুর ধার ধারেন না। বলেন, ঠিক হয়ে যাবে। কাল হয়েছে বাবার এই ধারণা। এ জন্যই যাই যাই করে ডাক্তারের কাছেও যাওয়া হয় না। মধ্যবিত্তের সংসার। মাসিকের রক্তও ভালোই যায়। তিন-চার ঘণ্টা পর প্যাড চেঞ্জ করতে হয়। কিন্তু বেশি সমস্যা পুরো তলপেট এবং কোমর এবং নিচের অংশে প্রচণ্ড ব্যথা। সায়মা দু-তিন দিন বিছানা থেকে উঠতে পারে না। সায়মা কাঁদে। কেন তার এমন হলো। ছিমছাম শ্যামবর্ণের সায়মার মাসিকের তারিখ ঠিক ছিল এতদিন। ঠিক সময়েই হতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মাসিক পুরোপুরি সেরে যাওয়ার তিন-চারদিন পর আবার রক্ত আসছে। একি যন্ত্রণা! সায়মা মানসিক রোগী হয়ে যাবে না তো। বান্ধবীদের শেয়ার করেছে সে। সবার একই কথা। ভালো ডাক্তার দেখাও। কিন্তু সেশন ফি, নোট-পত্রের খরচ জোগাতেই সায়মার ডাক্তার দেখানোর সামনের মাস আর সামনে আসে না। ভুগতেই থাকে।
অতঃপর বান্ধবীদের চাপে ও বাবার অসহযোগিতা উপেক্ষা করেই মা একদিন নিয়ে এলেন গাইনোকলোজিস্টের কাছে। সায়মার তলপেটের আলট্রাসনোগ্রাম করা হলো গাইনোকলোজিস্টের পরামর্শে। এক ধরনের চাকা পাওয়া গেছে দুটো ডিম্বাশয়ে। যাকে বলে মেডিক্যালের ভাষায় চকোলেট সিস্ট। সায়মা ভয়ে ও শঙ্কায় কেঁদে ফেলে। ডাক্তার আশ্বস্ত করেন। ওষুধপত্র দেন। বলেন, নিয়মিত ওষুধ খেতে। সিস্টের সাইজ আরেকটু বড় হলে সার্জারির প্রয়োজন হতো। সায়মার নিঃশ্বাস যায় যায় অবস্থা। ডাক্তার আরো বললেন, চেকআপে আরো আগে আসা দরকার ছিল। এ ধরনের সমস্যা জটিল হলে ভবিষ্যতে সন্তান হতেও নানা ধরনের সমস্যা দেখা যায়।
এ তো গেল সায়মার কথা। নীলার সমস্যাটা অন্যরকম। প্রথম দু-তিন দিন মাসিকের এত রক্ত যায় যে নীলা দুর্বল হয়ে যায়। মা খাবার স্যালাইন গুলিয়ে খাওয়ান। প্যাডে রক্ত কাভার হয় না। বড় কাপড় নিতে হয়। সাথে ব্যথাও আছে। নীলা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী। মাসে নিয়মিত চারদিন তাকে কামাই করতেই হয়। এটা অভ্যাস হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, গত মাসে নীলা ক্লাস চলাকালীন মাথা ঘুরে বেঞ্চেই পড়ে যায়। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ধরা পড়ে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা অনেক কম। তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। আলট্রাসনোগ্রামে ধরা পড়েছে, তার জরায়ুতে তিনটি ফাইব্রয়েড নামক টিউমার আছে। আপাতত অপারেশন না হলেও চলবে। ওষুধপত্র চলছে।
এ তো গেল রক্ত বেশি যাওয়ার সমস্যা। কারো আছে মাসিক শুরু হওয়ার পাঁচ-ছয়দিন আগে থেকেই সাদা স্রাব যায়। কেউ কেউ আবার বলেন, স্তনে খুব ব্যথা। গা, হাত-পা ভারী হয়ে যায়। ওজন দু-তিন কেজি এমনিতেই বেড়ে যায়। মাথা ঝিম ঝিম করে। কোনো কাজে মনোযোগী হতে পারেন না। কেউ বলেন বমি ভাব হয়। আবার কারো কারো মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথার সাথে বমিও হয়। অনেকে তখন ভাবেন, অ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথা। রক্ত যদি প্রতি মাসেই বেশি যেতে থাকে আর যদি আপনি চিকিৎসা না করান, তবে একসময় রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ও আয়রন কমবেই। তখন দেখা যায় নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা। একটু কাজকর্ম করলেই বুক ধড়ফড় করে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সামান্য হাঁটাহাঁটি বা সিড়ি ভাঙলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। বুকে ব্যথা অনুভব হয়।
এ জন্য বলছি, মাসিকের সময় ব্যথা, রক্ত বেশি যাওয়া কিংবা অনিয়মিত রক্তক্ষরণ হওয়া কোনোটাকেই আমলে না নিয়ে উপায় নেই। যথাসময়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন। যারা ভয় পান তাদের জন্য বলছি, বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। তলপেটের একটি আলট্রাসনোগ্রাম প্রয়োজন হতে পারে। রক্ত কম আশঙ্কা হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করতে হতে পারে। অনেকের আবার প্রস্রাবের সমস্যার কথা বলে থাকেন। ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া কিংবা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, একবার প্রস্রাব হওয়ার পর কিছুক্ষণ না যেতেই আবার বেগ মনে হওয়া। এসব উপসর্গ থাকলে প্রস্রাবের পরীক্ষাও দরকার হতে পারে। মোট কথা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আপনি কী সমস্যায় ভুগছেন সেটা শনাক্ত করতে হবে। তারপর চিকিৎসা। তবে এ ধরনের চিকিৎসায় আপনার দ্বিধা, সঙ্কোচ বা ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনার সমস্যা সম্পর্কে ডাক্তারকে খোলাখুলি বলুন। ডাক্তার কিছু জানতে চাইলে তার জবাব দিন। যে ওষুধপত্র ব্যথার জন্য দেয়া হয়, প্রয়োজনে সেগুলো খাবেন। যদি সাথে এসিডিটির ওষুধ দেয়, সেটাও নেবেন। কারণ শুধু ব্যথার ওষুধ অনেক সময় খাদ্যনালীর সমস্যা করে। কিছু ওষুধপত্র আছে নিয়ম করে পাঁচ, সাতদিন কিংবা ২১ দিন খেতে হয়। ডাক্তার যেভাবে বলেন, সেভাবে ওষুধ সেবন করুন। ডাক্তার কখনো বলবেন না আপনাকে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে। টুকটাক কাজকর্ম, ক্লাস এগুলো আপনি সানন্দে করতে পারবেন মাসিক চলাকালীন। আপনি সতেজ থাকুন। মাসিক মেয়েদের শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কাজেই এ মাসিক যেন আপনার জীবনকে অচল না করে দেয় এবং কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে সে জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিন। নিজে সুস্থ-সবল-সতেজ থাকুন, আপনার আশপাশের সবাইকে সুস্থ থাকার পরামর্শ দিন।
লেখক : গাইনোকলোজিস্ট, চেম্বার-পপুলার
শান্তিনগর


আরো সংবাদ



premium cement