২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হলুদে ব্যথা সারে, কৃমি নাশ করে

হলুদে ব্যথা সারে, কৃমি নাশ করে - ছবি : সংগৃহীত

শুধু রান্নায় নয়, প্রসাধনের তালিকায়ও ঠাঁই করে নিয়েছে হলুদ। বিশেষ করে মেয়েদের কাছে ত্বকের উজ্জ্বলতা রক্ষায় হলুদ সমাদৃত। তবে শুধু মসলা কিংবা প্রসাধনে নয়, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাতেও হলুদের ব্যবহার বেশ। হালে মেয়েদের দেখা যায় ডেটল পানিতে শিশুদের গোসল করাতে। কিন্তু যখন ডেটল ছিল না তখন মায়েরা তেল-হলুদ মাখিয়ে শিশুদের গোসল করাতেন। যেন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন বা চুলকানি, খোস-পাঁচড়া থেকে শিশুকে রক্ষা করা যায়। ভেষজবিদের মতে, দেশে যতগুলো ওষুধি মূল আছে তার মধ্যে হলুদ খুবই সহজলভ্য। যাদের প্রস্রাবের সাথে ফোঁটা ফোঁটা পুঁজ পড়ে, তারা যদি কাঁচা হলুদের রস সামান্য লবণ, একটু মধু বা চিনি মিশিয়ে এক চামচের মতো খেয়ে নেন তাহলে তাদের ব্যথা সেরে যাবে।

হলুদের আরেক নাম হচ্ছে ‘কৃমিঘ্ন’। মানে কৃমি নাশকারী। নানা রোগের জন্মগত কীট কৃমিকে ধ্বংস করে বলেই তার নাম এরকমটি হয়েছে। যাদের পেটে কৃমির উৎপাত আছে তাদের জন্য হলুদ একটি আদর্শ ওষুধি। কাঁচা হলুদের রস ১৫-২০ ফোঁটা সামান্য লবণ মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে কৃমিনাশ হয়। যাদের লিভারে গণ্ডগোল আছে তাদের ব্যবস্থাপত্রেও হলুদ দিয়ে থাকেন কবিরাজরা। তাদের মতে, পান্ডু রোগে মুখে ফ্যাকাসে রঙ ধরলে ঢেকে দেয়ার জন্য হলুদ খুবই দরকার। রোগীকে হলুদের রস ৫-১০ ফোঁটা থেকে আরম্ভ করে এক চা চামচ পর্যন্ত একটু চিনি বা মধু মিশিয়ে খাওয়াতে হয়। এতে খুব উপকার হয়। হলুদ হাম জ্বরে বেশ কাজ দেয়। কাঁচা হলুদ শুকিয়ে গুঁড়ো করে সাথে উচ্ছে পাতার রস ও অল্প মধু মিশিয়ে হামের রোগীকে খেতে দিতে হবে। এতে হামের রোগী বেশ উপকার পাবে। গরুর গোশত, চিংড়ি মাছ এসব খেলে যাদের শরীরে চাকা চাকা হয়ে ফুটে ওঠে, চুলকায় তাদের জন্য হলুদ মহৌষধ। নিমপাতার গুঁড়ো ১ ভাগ, কাঁচা হলুদ শুকিয়ে গুঁড়ো করে ২ ভাগ এবং শুকনো আমলকীর গুঁড়ো ৩ ভাগ একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। আয়ুর্বেদি মতে কফ, পিওজব্যাধিতেও হলুদের স্বীকৃতি রয়েছে। কফ বা কাশি হলে পাঁচ-সাত গ্রাম কাঁচা হলুদ পিসে নিতে হবে।

তারপর গুঁড়ো হলুদ দেড় কাপ আন্দাজ পানিতে ৫-১০ মিনিট ফুটিয়ে শেষে ছেঁকে পানিটুকু আলাদা করে নিতে হবে। সেই পানি অল্প চিনি মিশিয়ে এক চামচ করে মাঝে মধ্যে খেলে কফজনিত রোগ চলে যায়। অপর দিকে হলুদের গুঁড়ো, আখের গুড় আর খাঁটি সরিষার তেল একসাথে মিশিয়ে খেলে হাঁপানিতে একটু উপকার হয়। আঘাত, কাটা, ঘা, ফুলা বা ক্ষতেও হলুদের গুঁড়ো চমৎকার ফল দেয়। শরীরের কোনো জায়গা মচকে গেলে বা আঘাত লাগলে চুন, নুন ও হলুদ মিশিয়ে গরম করে লাগালে ব্যথা ও ফুলা কমে যায়। আর ফোড়া হলে পোড়া হলুদের ছাই পানিতে গুলে লাগালে দেখতে দেখতেই ঘা শুকিয়ে যায়।

মেছতা ও মুখের কালো দাগ দূর করতে পারে হলুদ। প্রথমে মনসার আঠার মধ্যে হলুদ এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর ছায়ায় শুকিয়ে তা গুঁড়ো করে নিয়মিত মুখে লাগালে মেছতা সেরে যায়। এতে মুখের কালো দাগও দূর হয়ে যায়।

রোগ প্রতিরোধে মিষ্টি কুমড়া
মো: জহিরুল আলম শাহীন
বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের সবজির মধ্যে অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু সবজির নাম মিষ্টি কুমড়া। এটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি সবজি। এটি কাঁচা ও পাকা উভয়ভাবেই রান্না করে খাওয়া যায়। মিষ্টি কুমড়ার পাতা ও ফুল অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। মানুষের দেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণে মিষ্টি কুমড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিষ্টি কুমড়ার কাণ্ড, পাতা ও ফুল সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। প্রায় সারা বছরই মিষ্টি কুমড়া পাওয়া যায়। তবে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত মওসুমে বেশি পাওয়া যায়। দামেও সস্তা।

এ সবজিটি মিষ্টি বলে শিশুসহ সবার কাছে প্রিয় খাদ্য। মিষ্টি কুমড়ায় প্রচুর পরিমাণে আমাদের দেহের অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, সি বেশি পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে হাজার হাজার শিশুরা অন্ধ হয়ে যায়। আর এ ভিটামিনের অভাবে চোখের ও শরীরে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই অতি সহজলভ্য এ সবজিটি নিয়মিত খেয়ে যেমন অন্ধত্ব নিবারণ করা যায়, তেমনি শরীরের নানা রোগও প্রতিরোধ করা যায়। আমাদের মনে রাখা উচিত- হলুদ রঙের সবজিতে বা ফলে বেশি পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ থাকে। রান্নার সময় এ ভিটামিন নষ্ট হয় না। অপর দিকে, ভিটামিন ‘সি’ রান্নার সময় কিছু নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল বা তরকারি কেটে খোলা বাতাসে রেখে দিলে কিছু নষ্ট হয়ে যায়। তাই কেটে ঢাকনা দিয়ে রেখে দেয়া উচিত। আর ভিটামিন ‘সি’ আমাদের শরীরে জমা থাকে না। তাই প্রতিদিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি খাওয়া উচিত। সবজি আমাদের শরীরের অপুষ্টি ও নানা বিধ সমস্যা, নানা রোগ-ব্যাধি যেমন রক্তশূন্যতা, অন্ধত্ব, ক্যান্সার, পাকস্থলীর নানা রোগ, হাড় ও দাঁতের নানা সমস্যা, চমড়ার নানা রোগ প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবজি আমাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ও দেহের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে জীবনকে দীর্ঘায়িত করে। মিষ্টি কুমড়া এমন একটি ফল জাতীয় সবজি- যাতে দেহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

রাসায়নিক উপাদান : মিষ্টি কুমড়া Cucurbitaceae গোত্রের উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Cucurbita maxima|। এই উদ্ভিদে স্যাপোনিন আছে। ফলে আছে ভিটামিন এ, বি, সি, শর্করা, আমিষ, গ্লোটিন, চিনি এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। ফুলে আছে ফ্ল্যাভোনয়েডস। বীজে থাকে স্টেরল, ট্রাইটাপিন, কিউকারবিটাসিনস, ভিটামিনস, খনিজ পদার্থ এবং এতে একটি রজনও পাওয়া যায়।

পুষ্টি উপাদান : প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী মিষ্টি কুমড়ার পুষ্টি উপাদান হলো : খাদ্য শক্তি ৪১ কিলোক্যালরি, ভিটামিন ‘এ’ ৭২০০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ২৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘বি১’ ০.০৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘বি২’ ০.০৬ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৫৬৪ মিলিগ্রাম, শর্করা ৭ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ৩ গ্রাম, চিনি ২.৮ গ্রাম, প্রোটিন ২ গ্রাম, ভিটামিন ‘ই’ ৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪৮ মিলিগ্রাম, ফোলেট ২১ মাইক্রোগ্রাম, আয়রন ১৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ২২ মিলিগ্রাম, মিয়াসিন ১ মিলিগ্রাম, জিংক ১ মিলিগ্রাম এবং চর্বি ০.৫ গ্রাম।

উপকারিতা : উজ্জ্বল কমলা রঙের সবজি এই মিষ্টি কুমড়া অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ভিটামিন ও খনিজ লবণে ভরপুর। একে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের স্টোর হাউজ বলা হয়। মিষ্টি কুমড়ার ভিটামিন ‘এ’ উপাদান চোখের জন্য খুবই উপকারী। এটি মানবদেহের সুস্থ ত্বক গঠন ও দেহের টিস্যু বা কলা তৈরি করতে সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়ার আঁশ বা ফাইবার দেহের ক্ষুধা ও ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। মানব শরীরের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গর্ভবতী ও শিশুকে বুকের দুধ দানকারী মহিলাদের মিষ্টি কুমড়া খুবই প্রয়োজনীয় একটি খাবার। এ সময় মহিলাদের প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়া দরকার।

মিষ্টি কুমড়া মানব দেহের রক্ত শূন্যতা দূর করে। তাই মহিলাদের মাসিকের পর মিষ্টি কুমড়া খেলে দেহের রক্ত শূন্যতা তাড়াতাড়ি পূরণ হয়। এ সবজিতে এক ধরনের তেল থাকে। যা পুরুষের প্রোস্টেটের কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে দেহের শুক্রাণু পরিপুষ্ট থাকে। এতে ডাইটরি ফাইবার বেশি থাকায় হৃদরোগ ও অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়ায় ফাইটোস্টেরল থাকে, যা রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল কমাতে সাহায্য করে। এ সবজিতে প্রচুর বিটা-ক্যারোটিন থাকে যা মানবের দেহে ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়। এই বিটা-ক্যারোটিন বার্ধক্য রোধ করে দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। মিষ্টি কুমড়ায় ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স যেমন ফোলেট, মিয়াসিন, পাইরিডক্সিন ও পেন্টাথেনিক এসিড থাকে। যা সুস্থ শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন।

তা ছাড়া, মিষ্টি কুমড়া দেহের জন্য আরো বিশেষ যে কাজ করে তা হলো :

* মিষ্টি কুমড়ার বিটা-ক্যারেটিন দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। * এটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। * মিষ্টি কুমড়ায় এল-ট্রিপ্টোফ্যান আছে যা মানসিক বিষণ্নতা কমাতে খুব সাহায্য করে। * এ সবজির ভিটামিন ‘সি’ দেহের সর্দি, কাশি ও ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা প্রতিরোধ করে। * মিষ্টি কুমড়ার ভিটামিন ‘এ’ চামড়া ও মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, ত্বকের সংক্রামণ রোধ করে। মাংসপেশিকে মজবুত করে। * মিষ্টি কুমড়ার বিটা ক্যারোটিন ধমনীর গায়ে কোলেস্টেরল জমতে বাধা দেয় ফলে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে। * এ সবজিটি গর্ভবাস্থায় মায়েদের সংক্রমণ রোধ করে। মায়ের উচ্চরক্তচাপ ও লিপিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। * মিষ্টি কুমড়ার আঁশ প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। মিষ্টি কুমড়ার জিংক গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করে এবং নিউরাল ডিফেক্ট প্রতিহত করে। * মিষ্টি কুমড়ায় থাকা স্যাপোনিন নামক রাসায়নিক উপাদান আমাদের শরীরে হরমোনের অসংখ্য কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।

সতর্কতা : যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ মতে খাবেন। যাদের ওজন বেশি তারা মিষ্টি কুমড়া কম খাবেন। এ সবজিতে বেশি আঁশ থাকায় বেশি খেলে অস্বস্থিবোধ ও পেটব্যথা হতে পারে। সুতরাং পরিমিত ও নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া খান। কারো পেটে সমস্যা থাকলে বা ডায়রিয়া হলে মিষ্টি কুমড়া না খাওয়াই ভালো। এ উপকারী সবজি গাছটি বাড়ির আশপাশে লাগান ও যতœ নিন। পরিবারের সবাইকে সবজিটি খেতে দিন।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement