২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ফেইসাল পালসি : মুখ বেঁকে যাওয়া রোগ

-

ফেইসাল পালসি এক ধরনের স্নায়ুরোগ, যেখানে ফেইসাল করোটিক স্নায়ুর অসুস্থতায় মুখের একদিক আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে অবশ হয়ে মুখ অন্যদিকে বেঁকে যায়, যাতে চেহারার বিকৃতি, চোখের সমস্যা ও মুখের স্বাদের ব্যাঘাত ঘটে। রোগী সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকে চেহারা বিকৃতির কারণে। তা ছাড়া বয়স্কদের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে মুখের
পক্ষাঘাতে অনেকে স্ট্রোক অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা রক্ত জমাট হওয়া ভেবে বা মুখের অবস্থা
স্বাভাবিক হবে কিনাÑ এসব দুশ্চিন্তায় বেশ ভেঙে পড়েন। লিখেছেন ডা: নাহিদ শারমিন নূপুর
ফেইসাল করোটিক স্নায়ু একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশ্র স্নায়ু, যার সঠিক কর্মক্ষমতার ওপর নির্ভর করে মুখের সৌন্দর্য, আবেগ, উচ্ছ্বাসসহ মুখের বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তির প্রকাশ। সঠিক ও স্পষ্টভাবে কথা বলা, মুখের ভেতরের লালাগ্রন্থি ও চোখের অশ্রুগ্রন্থির যথাযথ নিঃসরণ এবং জিহ্বার মাধ্যমে স্বাদ গ্রহণ ইত্যাদি।
করোটির মধ্যে কানের বিভিন্ন অংশের সাথে রয়েছে ফেইসাল স্নায়ুর সরাসরি সম্পর্ক। তাই কানের প্রদাহ, আঘাত, টিউমার ইত্যাদির জটিলতায় এ স্নায়ু সহজে আক্রান্ত হয়ে মুখ বেঁকে যেতে পারে। যার কারণে মুখের পক্ষাঘাতকে কানের রোগ হিসেবে ধরা হয়। যেখানে ৯০ শতাংশেরও অধিক ক্ষেত্রে কানের বিভিন্ন সমস্যার কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ যেকোনো বয়সের পুরুষ বা মহিলার ক্ষেত্রে হতে পারে। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অনেক সময় রোগী সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, তার মুখ একদিকে বেঁকে গেছে বা সচেতন অবস্থায় বুঝতে পারে মুখের একদিকে অস্বস্তি বা দুর্বল লাগছে, যা আস্তে আস্তে অবশ হয়ে বাঁকা হয়ে যায়। অনেক কারণে এ রোগ হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অজ্ঞাত কারণে, যাকে বলা হয় বেলস্ পালসি।
মুখের পক্ষাঘাতের কারণ
ফেইসাল পালসি দু’টি কারণে হয়ে থাকে :
যেমনÑ
১. কেন্দ্রীয় কারণ : যেখানে ফেইসাল স্নায়ু মস্তিষ্কে উৎপত্তি স্থানে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যেমনÑ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, রক্ত জমাট বাঁধা, টিউমার, ফোড়া, মাল্টিপল স্কে¬রোসিস, পলিনিউরাইটিস ইত্যাদি। যেখানে মুখের নিচের অংশ সাধারণত আক্রান্ত হতে থাকে।
২. প্রান্তিক কারণ : সাধারণত দেখা যায়, যেখানে ফেইসাল স্নায়ু মস্তিষ্কের বাইরে, করোটির ভেতরে, টেমপোরাল অস্থির মধ্যে এবং করোটির বাইরে আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অজ্ঞাত কারণে হয়ে থাকে।
অন্যান্য কারণ
-করোটির মধ্যে : একুয়াস্টিক নিউরোমা, শরীরের অন্যান্য স্থান থেকে স্থানান্তরিত ক্যান্সার, মেনিনজাইটিস।
-টেমপোরাল অস্থির মধ্যে : মধ্যকর্ণের তীব্র প্রদাহ, দীর্ঘস্থায়ী কানের প্রদাহ (কলিস্টিওটোমা), আঘাত (দুর্ঘটনাজনিত বা অপারেশনের ফলে), ভাইরাসের সংক্রমণ, বেলস পালসি, টিউমার।
-করোটির বাইরে : প্যারটিড লালাগ্রন্থির টিউমার, আঘাত।
-শারীরিক রোগের কারণেও মুখ বেঁকে যেতে পারে, যেমন বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ, শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তির অভাবজনিত কারণ এইডস, সারকয়ডসিস্ ইত্যাদি।
রোগের উপসর্গ
এটি নির্ভর করে রোগের কারণ ও স্নায়ুর ক্ষতের ব্যাপ্তির উপর।
- সাধারণভাবে মুখ একদিকে বেঁকে যায়, মুখের আক্রান্ত দিকেরÑ
- চোখ বন্ধ করতে সমস্যা হয়।
- অশ্রু ও লালা নিঃসরণ কমে যায়।
- মুখে খাদ্য জমে থাকে।
- জিহ্বায় স্বাদ লোপ পায়।
- কথা বলতে সমস্যা হয়।
- কানে ব্যথা, মুখ দিয়ে লালা গড়ানো, পানাহারে সমস্যা হয়।
-কদাচিৎ বধিরতা, মাথাঘোরা, উচ্চ শব্দের প্রভাবে কানে অস্বস্তিবোধ হয়। এবং বহিঃকর্ণের ত্বকের ওপর ছোট ছোট ফোসকা পড়ে।

রোগ নির্ণয়
ষ সম্পূর্ণ রোগ বৃত্তান্ত নেয়া
ষ রোগীকে ভালোভাবে পরীক্ষা করা, বিশেষ করে মাথা, কান ও ঘাড়
ষ বিশেষ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে ফেইসাল স্নায়ুর ক্ষতের স্থান নির্ধারণ করা, যেমনÑ
ষ চোখের অশ্রু এবং মুখের লালাগ্রন্থির নিঃসরণের পরিমাণ নির্ধারণ
ষ জিহ্বার স্বাদের অবস্থা নির্ণয়
ষ স্টেপিডিয়াল রিফ্লেক্স পরীক্ষা
ষ বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক পরীক্ষার মাধ্যমে রোগের সম্ভাব্য ফলাফল এবং চিকিৎসার উন্নতি, অবনতি ইত্যাদি নির্ধারণ করা যায়।
ষ রেডিওলজি : সিটি স্ক্যান, এমআরআই পরীক্ষা
অডিওগ্রাম (শ্রবণশক্তির পরীক্ষা)
ষ ক্যালরিক টেস্ট : ভেস্টিবুলার এপারেটাসের নিয়ন্ত্রণাধীন শরীরের ভারসাম্যের পরীক্ষা
চিকিৎসা
রোগীকে আশ্বস্তকরণ
রোগের কারণ এবং ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কে রোগীর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করা।
সাধারণত তিন ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়Ñ
ক. ফিজিওথেরাপি
ষ মুখের অবশ অংশে গরম সেঁক দেয়া (ভেজা তোয়ালের মাধ্যমে),
ষ মুখে মালিশ করা এবং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করা। এতে মুখের নড়াচড়া পরিলক্ষিত না হলেও অক্ষত স্নায়ুরজ্জু পুনরুজ্জীবিত হয় এবং মুখের মাংসপেশির স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকে।
খ. ওষুধপত্র
ষ কর্টিকোস্টেরয়েড,
ষ প্রয়োজনে ভাইরাস নাশক ওষুধ যেমন- এসাইক্লোভির,
ষ রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধিকারক ওষুধ নিকোটিনিক এসিড,
ষ ব্যথা প্রশমনে এনালজেসিক ইত্যাদি দেয়া হয়ে থাকে।
গ. অপারেশন
ষ কদাচিৎ ফেইসাল স্নায়ুর ডিকমপ্রেশন বা বহিরাংশচ্ছেদন-স্নায়ুর চাপ কমানোর জন্য।
ষ চোখের যতœ : খুবই জরুরি; চোখকে ধুলোবালি থেকে রক্ষা করা, চোখের শুষ্কতা রোধে ফোঁটা জাতীয় কৃত্রিম অশ্রুর ব্যবহার, প্রয়োজনে অপারেশনের মাধ্যমে চোখ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা। সর্বোপরি রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়, যা ফিজিওথেরাপি ওষুধপত্র বা অপারেশন- যেকোনো ধরনের বা সম্মিলিতভাবে হতে পারে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগ সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়, যা নির্ভর করে রোগের কারণ ও ব্যাপ্তির ওপর। তবে মুখের পক্ষাঘাতকে কখনো অবহেলা করতে নেই। সময়মতো বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেক মারাত্মক জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
রোগের পুনরাবির্ভাব
১০ থেকে ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে রোগ বারবার হতে দেখা যায়। তবে আজকাল সময়মতো রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসার ফলে রোগের পুনরাবির্ভাব বেশ কমে গেছে। সাধারণত গড়ে ১০ বছরের ব্যবধানে রোগের পুনরাবির্ভাব দেখা যায়।
মুখের পক্ষাঘাত সৃষ্টিকারী কিছু সাধারণ অসুখÑ বেলস্ পাল্সি
ফেইসাল স্নায়ুর এক ধরনের প্রদাহ, যার কারণ অজ্ঞাত। সাধারণত হারপিস সিমপ্লেক্স এবং সর্দি-কাশির ভাইরাসের সংক্রমণের পরে এ রোগ দেখা যায়। মুখের পক্ষাঘাত ৫০ শতাংশের ক্ষেত্রে বেলস পালসির কারণে হয়ে থাকে। এ রোগ যেকোনো বয়সে যে কারো হতে পারে। তবে গর্ভাবস্থা, বহুমূত্র, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ঊর্ধ্ব শ্বাসনালীর অন্যান্য প্রদাহের সাথে এ রোগ বেশি হয়।
উপসর্গ
ষ মুখ একদিকে বেঁকে যায়,
ষ আক্রান্ত দিকের চোখ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয় না।
ষ খাদ্য চর্বনে সমস্যা এবং রোগী আক্রান্ত দিকের কানে বেশি শোনে।
ষ রোগের প্রারম্ভে অনেক সময় ঘাড়ে, কানে কিংবা কানের পেছনে ব্যথা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
ষ চোখের পরিচর্যা,
ষ মুখের আক্রান্ত অংশ মালিশ এবং মুখের ব্যায়াম করা,
ষ প্রয়োজনে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা,
ষ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেলস পালসি সম্পূর্ণরূপে সেরে যায়।
র্যামসে হান্ট সিন্ড্রোম
ফেইসাল স্নায়ুর হারপিস জস্টার ভাইরাসজনিত প্রদাহ যা তীব্র ধরনের হয়ে থাকে। সেখানে ফেইসাল স্নায়ুর সাথে অন্যান্য করোটিক স্নায়ুও আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগেÑ
ষ মুখ এদিকে বেঁকে যায়।
ষ কানের ভেতরে ও আশপাশে তীব্র ব্যথা।
ষ বহিঃকর্ণের চামড়ায় ফোসকা পড়ে।
ষ জিহ্বার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।
ষ মাথা ঘোরা সমস্যা দেখা দেয়।
ষ স্নায়বিক ধরনের বধিরতা।
ষ কানে বেশি শোনা ইত্যাদি সমস্যা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
ষ স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের সাথে ভাইরাসনাশক ওষুধ এসাইক্লোভির ব্যবহার করা যেতে পারে।
ষ তীব্র ব্যথা প্রশমনে নারকোটিক জাতীয় ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
ষ বহিঃকর্ণের ফোসকার অ্যান্টিবায়োটিক ও হাইড্রোকরটিসোন মিশ্রিত মলম ব্যবহার করতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে এ রোগ সম্পূর্ণভাবে সেরে গেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগের জটিলতাসহ কদাচিৎ মুখের পক্ষাঘাত স্থায়ীভাবে থেকে যায়।


আরো সংবাদ



premium cement
লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির

সকল