১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস কতটা মারাত্মক?

ডায়াবেটিস ধরা পড়লে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক খাদ্য গ্রহণ করা উচিত - সংগৃহীত

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের সাথে আমরা কম-বেশি পরিচিত। কিন্তু গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি এবং এর ভয়ঙ্কর সব জটিলতা সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই। এ ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি-

মিসেস রিনা (ছদ্মনাম), বয়স ৩৩ বছর। প্রথম সন্তান জন্মের সাত বছর পর পুনরায় গর্ভধারণ করেছেন, কিন্তু প্রথমবারের মতো চেকআপে এলেন সাড়ে সাত মাস গর্ভাবস্থায় (৩২ সপ্তাহ), পেট অস্বাভাবিক বড় হয়ে যাচ্ছে। বললেন, প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। তাই এবারো গর্ভাবস্থায় কোনো ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন মনে করেননি। যা হোক, পরীক্ষা করে দেখা গেল রক্তে সুগার খালি পেটে ১৪ (14 mmol/L) ও খাবার গ্রহণের পর ২৬ (26 mmol/L); যা সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে হয়ে থাকে। আল্ট্রাসনোগ্রামে দেখা গেল, সন্তানের পানির (Amniotic fluid) পরিমাণ অত্যধিক। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে ইনসুলিনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এলো।

পূর্ণ সময়ে সন্তান ডেলিভারির পর দেখা গেল, কান্নার সময় ও দুধপান করার সময় সন্তান নীল হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা করে সন্তানের হার্টে ফুটো ধরা পড়ল, যা সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে হতে পারে। একই ধরনের অন্য একজন রোগীর সন্তান ডেলিভারির পর দেখা গেল, সন্তানের ঠোঁট কাটা। যদিও তাদের আশ্বস্ত করলাম, আজকাল ছোটখাটো ত্রুটির উন্নত চিকিৎসা সম্ভব। আবার এও বোঝালাম যে, প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে এসব দুর্ভোগ এড়ানো সম্ভব।

উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনার উদ্দেশ্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিশেষত গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। আমাদের জানতে হবে, যার কখনো ডায়াবেটিস ছিল না, তারও গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
১. পারিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে (মা-বাবা, ভাই-বোন, মামা-খালা, চাচা-ফুফু, দাদা-দাদী, নানা-নানী)
২. আগে অধিক ওজনের (চার কেজি বা বেশি) সন্তান অথবা ত্রুটিযুক্ত সন্তান জন্মদানের ইতিহাস থাকলে
৩. অজ্ঞাত কারণে পেটে অথবা জন্মের পরপরই সন্তান মারা যাওয়ার ইতিহাস থাকলে
৪. বারবার সন্তান নষ্ট হওয়ার (অ্যাবরশন) ইতিহাস থাকলে
৫. গর্ভাবস্থায় সন্তানের পানির পরিমাণ (অ্যামনিয়াটিক ফ্লুইড) অতিরিক্ত হলে
৬. গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন ইনফেকশনের লক্ষণ, যেমন- তলপেটে ব্যথা, মাসিকের রাস্তায় চুলকানি, চর্মরোগ ইত্যাদি দেখা দিলে
৭. বয়স ৩০ বছরের অধিক বা শরীরের ওজন অতিরিক্ত হলে
৮. পূর্ববর্তী গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে।

ডায়াবেটিসে মা ও গর্ভস্থ শিশুর সম্ভাব্য জটিলতা
১. অ্যাবরশন বা প্রথম তিন-চার মাসের মধ্যে সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়া
২. রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে প্রি-একলাম্পসিয়া নামক জটিলতা
৩. ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া ও ইনফেকশনের কারণে সময়ের আগেই পানি ভেঙে যাওয়া
৪. সন্তানের ওজন অধিক হওয়ায় ডেলিভারির সময় জটিলতা
৫. ডেলিভারি-পরবর্তী ইনফেকশন, সন্তান পর্যাপ্ত দুধ না পাওয়া ইত্যাদি।

গর্ভস্থ শিশুর জটিলতা
১. শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ, যা সাধারণত প্রাথমিক গর্ভাবস্থায় (প্রথম তিন মাস) অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হয়ে থাকে
২. গর্ভাবস্থায় সময়ের তুলনায় সন্তান অস্বাভাবিক বড় ও কিছু ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ছোট হওয়া
৩. হঠাৎ পেটের ভেতর সন্তান মারা যাওয়া, যা সাধারণত গর্ভাবস্থায় শেষ দু-তিন সপ্তাহে হতে পারে
৪. জন্ম-পরবর্তী শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, আকস্মিক রক্তের সুগার কমে যাওয়া, শ্বাসনালীতে ইনফেকশনসহ বিভিন্ন মারাত্মক জটিলতা।

জটিলতা এড়াতে করণীয়
১. পরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভধারণের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া (প্রি-কনস্পেশন কাউন্সেলিং)
২. মাসিক বন্ধ হলে যত দ্রুত সম্ভব গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের পরীক্ষা করা
৩. গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের পরপরই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া ও নিয়মিত চেকআপে থাকা
৪. ডায়াবেটিস ধরা পড়লে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক খাদ্য গ্রহণ (ডায়েট প্ল্যানিং), প্রয়োজনে নিয়মিত ইনসুলিন নেয়া
৫. ইনসুলিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সপ্তাহে কমপক্ষে দু’বার রক্তের সুগার চেক করা, যা আজকাল গ্লুকোমিটার নামক একটি সহজলভ্য যন্ত্রের মাধ্যমে ঘরে বসেই করা যায়।
৬. ১৮-২০ সপ্তাহে সন্তানের জন্মগত ত্রুটি নির্ণয়ের জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম (Anomaly scan) করা
৭. গর্ভাবস্থায় ও পরবর্তী জটিলতা সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং যেকোনো সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।

সর্বোপরি ডায়াবেটিস একটি জটিল কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে মা ও সন্তানের জটিলতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement