১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দাঁতের রোগ থেকে হার্টের সমস্যা

দাঁতের রোগ থেকে হার্টের সমস্যা - ছবি : সংগৃহীত

‘কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশিবিষে দংশেনি যারে’ দাঁতের ব্যথা নিয়ে কবির এ কবিতাটি অনেকেই উচ্চারণ করেন। একসময় বলা হতো- দাঁতের ব্যথা মানেই দাঁত তুলে ফেলা। অর্থাৎ দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। বর্তমানে বিজ্ঞানের গবেষণায় তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় এখন দাঁত তোলার রেওয়াজ প্রায় নেই বললেই চলে। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া দাঁত তুলে ফেলা উচিত নয়। লিখেছেন অধ্যাপক ড. অরুপ রতন চৌধুরী

অনেকেই জানেন না, একটি প্রদাহজনিত দাঁত বা ইনফেকটেড দাঁত অথবা ব্যথার দাঁত তুলে ফেললে শরীরে দেখা দিতে পারে রকমারি রোগ ও জটিলতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘শরীরের যেকোনো অঙ্গের মতো দাঁতের সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। দাঁত তুলে ফেললে শুধু যে সৌন্দর্য ব্যাহত হয় তা নয়, পাকস্থলীর সমস্যাও দেখা দেয় এবং কথা বলতে শব্দ উচ্চারণ ও সমস্যা হয়। চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘দাঁতে কোনো ইনফেকশন হলে চোখের অপারেশন করা যায় না। আগে দাঁতের ইনফেকশন কমিয়ে তবেই চোখের সার্জারি করা যায়। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসায় আজকাল ইনফেকশন কমিয়ে দাঁতের সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়াও দেখা গেছে দাঁতে ইনফেকশন হলে অনেক সময় মাথা, চোখে, কানে রেফারড পেন হয়। গবেষণায় দেখে গেছে, হার্টের সমস্যা থাকলে দাঁত সার্জারির সময় হার্টের সমস্যা হতে পারে। কারণ ডেন্টাল সার্জারিতে ব্যাকটেরিয়া রক্তে প্রবেশ করে, ফলে তা হার্টের ক্ষতি করে। সময় মতো অ্যান্টিবায়োটিক কভারেজে দাঁতের চিকিৎসা এবং সেই সাথে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত টেকনোলজি অর্থাৎ জীবাণুমুক্ত পরিবেশের মাধ্যমে দাঁতের চিকিৎসা করা প্রয়োজন। যদি কারো পেসমেকার বা প্রস্তেটিক ভালভ থাকে, তবে দাঁত তুললে হার্টের ক্ষতি হতে পারে। অতএব, প্রয়োজন নিরাপদ পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে আধুনিক কনজারভেটিভ পদ্ধতিতে দাঁতের সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ধারণা, দাঁত ব্যথা হলে তার একমাত্র চিকিৎসা হলো দাঁত তুলে ফেলা। কিন্তু একটি রোগাক্রান্ত দাঁতকে সুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন সুস্থ, সবল রাখতে সব ধরনের চিকিৎসা এখন হচ্ছে। যেমন রুট ক্যানেল চিকিৎসা, ক্রাউন ক্যাপ ইত্যাদি।

দাঁত ব্যথা হলে তা তুলে ফেলার খরচ সামান্য হলেও এর ফলে হৃদযন্ত্রে বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে, হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি। এ জন্য আমাদের আগে থেকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত দেশে তাদের হার্ট সংক্রান্ত চিকিৎসার খরচ অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পেরেছেন দন্ত চিকিৎসকদের কাছ থেকে সঠিক সময়ে পরামর্শ নেয়ার কারণে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থতার জন্য বিশ্বমানের প্রযুক্তির সাহায্যে দাঁত সুরক্ষিত রাখতেই আমরা সবাই সচেষ্ট। একটি অসুস্থ দাঁতকে উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমের সুস্থ করতে যে খরচ হয়, তা ওই হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার বিপুল খরচের বহুগুণ কম। আমাদের দেশে উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তির মাধ্যমে এক একটি দাঁতের ক্ষেত্রে এ খরচ প্রায় চার হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।

দাঁত ব্যথা হলে রোগীরাই বেশির ভাগ সময় বলেন, দাঁতটা উঠিয়ে দিতে। প্রথমেই একটি কথা মনে রাখা দরকার, ইনফেকশন নিয়ে কখনোই কোনো দাঁত ওঠানো উচিত নয়। এখন আধুনিক সূক্ষ্ম যন্ত্রাংশের সাহায্যে জীবাণুমুক্তকরণ ব্যবস্থায় দাঁতের পালপ চেম্বারের ইনফেকশন দূর করে সেখানে ঢুকিয়ে দেয়া হয় বৈজ্ঞানিভাবে প্রস্তুত কিছু পদার্থ। আন্তর্জাতিক মানের এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে এখন রুট ক্যানেল চিকিৎসায় একটি অসুস্থ দাঁতকে বেদনাহীন ও কার্যকর করা যায়।

এ পদ্ধতিটিতে সাধারণত পাঁচ দিন বা তার বেশি সময় লাগে। পরবর্তীকালে ওই দাঁতকে মজবুত করার জন্য তার ওপর একটি মুকুটের মতো (অবিকল দাঁতের রঙের এবং দাঁতের মতোই) বস্তু বসিয়ে দেয়া হয়, যার সাহায্যে স্বাভাবিক জিনিসও খাওয়া যায়। তবে ওই মুকুটের মতো বস্তুটি তৈরির খরচ সম্পূর্ণ আলাদা। কখনো কোনো দুর্ঘটনা বা অন্যান্য কারণে দাঁত ভেঙে গেলেও এ চিকিৎসা পদ্ধতি কাজে লাগানো যেতে পারে। ওই মুকুটের নাম ক্রাউন, সেটি পরসেলিন, মেটাল বা স্বর্ণেরও হতে পারে। সাধারণত দাঁত ক্যারিজ রোগ বেশি গভীরে গেলে রুট ক্যানেল চিকিৎসার পর ক্রাউন পরানো হয়।

সাধারণত পেরিওডেন্টাইটিস রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে দাঁতের পার্শ্ববর্তী চোয়ালের হাড়ের ক্ষয় হয় এবং সে ক্ষেত্রেই দাঁত নড়ে যায়। এই রোগে মুখে দুর্গন্ধ হয়, মাড়ি ফোলা, মাড়ি থেকে পুঁজ ও রক্ত বের হয়। আলট্রাসনিক স্কেলিংয়ের সাহায্যে দাঁতের ময়লা বা ডেন্টাল প্লাক পরিষ্কার করে। প্রথমে মুখের ইনফেকশন কমিয়ে তারপর মাড়ির চিকিৎসা করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমে একটি ঙচএ-করে বুঝতে হয় কি ধরনের হাড় ক্ষয় হয়েছে। মাড়ির বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে নড়ে যাওয়া দাঁতকে আবার সঠিকভাবে রাখা যায়। এ আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা এখন আমাদের দেশেও হচ্ছে। মাড়ির ওই অপারেশন সারতে সময় লাগে কমপক্ষে এক সপ্তাহ। আলট্রাসনিক স্কেলিংয়ের মাধ্যমে সর্বপ্রথম মুখের ইনফেকশন ও দুর্গন্ধ দূর করে তবেই এই মাড়ির শল্য চিকিৎসা করা হয়। তাই দাঁত নড়ে গেলে বা দাঁত অতিরিক্ত ক্ষয় বা গর্ত হলেও না তুলে ওই দাঁতের সংরক্ষণ করা সম্ভব। তাই একটি দাঁত তুলে ফেলার আগে সঠিক চিকিৎসা করা প্রয়োজন।

সাধারণত আমরা দাঁত তুলার জন্য যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি সেগুলো হচ্ছে- আক্কেল দাঁত , সঠিক অবস্থান না থাকলে যে দাঁতটি ক্ষতি করতে পারে। দাঁতের গোড়া ও তার সংলগ্ন সিস্ট ও গ্রানুলোমা।
মাড়ির অতিরিক্ত প্রদাহ, যার ফলে অতিরিক্ত হাড় ক্ষয় হয়েছে।

ক্যান্সারে আক্রান্ত দাঁত কিংবা অর্থডেনটিক চিকিৎসার কারণে অসমান দাঁত ইত্যাদি ক্ষেত্রে দাঁত তুলে ফেলা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু দাঁত সার্জারির মাধ্যমে তুলতে হয়।

অসুস্থতার কারণে বা বয়সের জন্য যারা সবক’টি দাঁতই হারিয়েছেন, তাদের জন্য বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তৈরি বাঁধানো দাঁত অনেক কার্যকর। এই বাঁধানো দাঁত দু’রকমের। ০১. খুলে পড়া, ০২. স্থায়ী। একটি দাঁত অনুপস্থিতির কারণে খাওয়া-দাওয়া, শব্দ উচ্চারণ ও সৌন্দর্যের অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে; তাই দাঁত হারালেও কৃত্রিম দাঁত (স্থায়ী অথবা খুলে পড়া) লাগানো প্রয়োজন।

সুন্দর- সুস্থ মুখের হাসির জন্য আমাদের কী করা প্রয়োজন-
১. ছ’মাস অন্তর আলট্রাসনিক স্কেলিং ও দাঁত পরীক্ষা।
২. সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উপযুক্ত পেস্ট সহযোগে ব্রাশ।
৩. ঠোঁট বা মুখে বিভিন্ন ক্ষতিকারক কসমেটিক বা রঙ বা পদার্থ ব্যবহার বন্ধ করা।
৪. দাঁত ব্রাশের সাথে নিয়মিত ফ্লসিং।
৫. মুখগহ্বর বা মুখমণ্ডলের কোনো ক্ষতচিহ্ন বা ঘা তা যত ছোটই হোক না কেন, অবহেলা না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দন্ত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।
৬. দাঁতের ভেতর ছোট গর্ত হলে, অবহেলা না করে, সঠিক সময়ে ফিলিং করা।
৭. তামাক, ধূমপান ও মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।

মনে রাখতে হবে, দাঁত ব্রাশ করার আগে সূতার মতো জিনিস-ফ্লস দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা প্রয়োজন। কারণ ব্রাশ করার ফলে দাঁতের ওপর থেকে খাদ্যকণা পরিষ্কার হয়, কিন্তু ফ্লসিংয়ের ফলে দু’টি দাঁতের ফাঁকে যে খাদ্যকণা জমা হয়, সেগুলোও পরিষ্কার হয়। দিনে অন্তত দু’বার সঠিক পদ্ধতিতে দাঁত ব্রাশের সাথে মাড়ি ম্যাসাজ করা প্রয়োজন। অহেতুক কোনো আলপিন বা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাখুঁচি না করা। মুখের জন্য ক্ষতিকর এমন পদার্থ যেমন তামাক, জর্দ্দা, গুল, ধূমপান ত্যাগ করা। দাঁতের সমস্যায় না জেনে কোনো দোকানে গিয়ে যেকোনো ওষুধ না খাওয়াই ভালো। কারণ, এতে সমস্যা অনেক বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে ডেন্টাল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়াই যুক্তিযুক্ত।
দন্তচিকিৎসার পরিধি আজ শুধু দাঁত তোলা আর দাঁত বাঁধানোতে সীমাবদ্ধ নেই।

এর পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। কারণ মুখের অনেক রোগ থেকেই দেহের সাধারণ রোগ হতে পারে। যেমন- হার্ট ডিজিজ বা হৃদরোগীদের দাঁত তুলার আগে সঠিক এন্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানো ও গর্ভকালীন সতর্কতার সাথে ওষুধ খাওয়ানো এবং শিশুদের সুস্থ দেহের জন্যও দাঁত ও মুখের সুস্থতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে এসব ক্ষেত্রে তাদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের (যাদের চিকিৎসায় আছেন) সাথে পরামর্শ করেই দাঁতের চিকিৎসা করা ভালো।

পরিশেষে স্টেরিলাইজেশনের বা জীবাণুমুক্ত পরিবেশে দন্ত চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ এসব রোগ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে সংক্রামিত হতে পারে। অতএব সচেতনতার সাথে মুখ ও দাঁতের রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করুন, সুস্থ থাকুন। সবশেষে, একটি মূল্যবান দাঁত ফেলে দেয়ার আগে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।
অতএব, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ডেন্টেস্ট্র্রি বিভাগ, বারডেম
ই-মেইল : aratan@dab-bd.org


আরো সংবাদ



premium cement