২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশে রং ফর্সাকারী ক্রিম কি আসলেই ত্বক ফর্সা করে?

বাংলাদেশে রং ফর্সাকারী ক্রিম কি আসলেই ত্বক ফর্সা করে? - সংগৃহীত

বিশ্বের অনেক দেশের মতো ত্বকের সুরক্ষা এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নানা রকমের প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়ে থাকে বাংলাদেশেও। এসব পণ্যে নানা ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত থাকার কারণে বিশ্বজুড়েই প্রসাধনী ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ এসব রাসায়নিক অনেকের ত্বকের জন্য কোন সুরক্ষা বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি তো করতে পারেই না, বরং সেটি ক্ষতিকরও হয়ে ওঠতে পারে।

বিশেষ করে রং ফর্সাকারী ক্রিমগুলো নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে।

ক্রিম কি আসলেই ফর্সা করে?
লেজার মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক ডা. ঝুমু জাহানারা খান বলছেন, আসলে কোন ক্রিমই শরীরের রংকে ফর্সা করতে পারে না। কারণ ত্বকের রঙের সাথে শরীরের ভেতরের অনেক উপাদান জড়িত রয়েছে। আমরা কখনোই গায়ের রংকে সাদা করতে পারি না, উজ্জ্বল করতে পারি। আমাদের ত্বকের স্বাভাবিক যে মেলানোসাইড সেলগুলো আছে, যা রঞ্জক তৈরি করে, সেটাই আমাদের গায়ের রংটা ধারণ করে। এটা ত্বক রক্ষায় অনেকভাবে কাজ করে।

তিনি বলছেন, এখন বাজারে অনেক সস্তা ক্রিম এসেছে, যেগুলোয় অনেক ভারী রাসায়নিক এবং ক্ষতিকারক পদার্থ রয়েছে। এগুলো খুব তাড়াতাড়ি হয়তো ফর্সা বা সাদা ইফেক্ট দিয়ে দেয়, কিন্তু কিছুদিন পরেই সেটা বরং ত্বকের জন্য নানা ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। যেমন ত্বকটা হয়তো খুব লাল হয়ে ওঠে, জ্বলছে বা রোদে যেতে পারছে না। বাংলাদেশের বাজারে যেগুলো পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগ ক্রিমই আসলে এরকম। আমাদের উচিত, নিজেদের যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য রয়েছে, সেটাকেই ঠিকভাবে রাখা এবং যত্ন করা। মনে রাখতে হবে, সাদা হয়ে যাওয়া সম্ভব না। তবে কিছু মেডিকেশন আছে যেগুলোয় ত্বক হয়তো উজ্জ্বল হয়।

কিন্তু যেভাবে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে অহরহ শরীরের ত্বক ফর্সা করার বিজ্ঞাপন বা ঘোষণা দেয়া হয়, তাহলে সেগুলো কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

ডা: ঝুমু জাহানারা খান বলছেন, মেডিকেল পণ্যের ওপর নানা নজরদারি আছে, আইন আছে। কিন্তু কসমেটিকস পণ্যের ক্ষেত্রে সেটা নেই। সে কারণে ওরা যা খুশি তাই, অনেক আজেবাজে জিনিসও কনজ্যুমার পণ্য হিসাবে বাজারে ছাড়া হয়। যেমন ফর্সা করার সস্তা ক্রিম তো অবশ্যই ত্বকের ক্ষতি করবে।

তিনি বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একজনের কথা শুনে আরেকজন পণ্য ব্যবহার করেন। কিন্তু একেকজনের ত্বক একেক রকম হওয়ায় কারো কারো জন্য সেটা চরম ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

আমাদের উচিত, নিজেদের যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য রয়েছে, সেটাকেই ঠিকভাবে রাখা এবং যত্ন করা। মনে রাখতে হবে, সাদা হয়ে যাওয়া সম্ভব না, বলছেন ডা: ঝুমু জাহানারা খান।

বাংলাদেশের যেসব প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশিরভাগেই ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশর জন্য ক্ষতিকর বলে জানিয়েছে এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা।

তারা বাংলাদেশের নামীদামী ৩৩টি প্রসাধনী পণ্য পরীক্ষা করে সবগুলোয় ক্ষতিকর উপাদানের অস্তিত্ব পেয়েছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের হেয়ার জেল, বেবি লোশন, বিউটি ক্রিমসহ বিভিন্ন প্রসাধনীতে আর্সেনিকসহ বিভিন্ন রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এমনকি শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়, এমন প্রসাধনীতেও বিষাক্ত উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।

তারা বলছে, নামীদামী পণ্যগুলোর মধ্যেই তারা এসব উপাদান পেয়েছে, তাহলে কমদামী অন্য পণ্যের কি অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়।

এসব পণ্যের ব্যাপারে ক্রেতা বা বিক্রেতাদের মধ্যে খুব একটা সচেতনতা দেখা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাজারে ক্ষতিকারক উপাদানের কসমেটিকস রয়েছে।

ত্বকের সৌন্দর্য যখন মানসিক রোগের কারণ
বাংলাদেশের গবেষকরা বলছেন, প্রসাধনী পণ্যের ব্যাপারে ক্রেতা বা বিক্রেতাদের খুব একটা সচেতনতা দেখা যায় না। বাংলাদেশের ত্বক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্বক ফর্সা বা উজ্জ্বল করতে গিয়ে অনেকেই উল্টো ক্ষতির মুখে পড়েন। মুখের ত্বকে দাগ তৈরি হওয়া, রোদে বা তাপের মধ্যে যেতে না পারা, চুলকানি বা লালচে হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও তৈরি হয়।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের মনোবিজ্ঞানী ইসরাত শারমিন রহমান বলছেন, সৌন্দর্যের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে যখন সেটি উল্টো সৌন্দর্য হানির কারণ হয়, সেটি অনেকের ওপর মানসিকভাবে প্রভাব ফেলে।

তিনি বলছেন, যিনি নিজেকে আরো সুন্দর করার চেষ্টা করেছেন, বা কোন ক্ষত ঢাকার চেষ্টা করছেন, তিনি যখন উল্টো ত্বকের সমস্যায় পড়েন, সেটা তার ওপর মানসিকভাবে অনেক প্রভাব ফেলে। হয়তো অনেকে তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করে। তখন তার মধ্যে রাগ তৈরি হয়, হতাশা তৈরি হয়। তিনি হয়তো নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এটা তার আত্মবিশ্বাসের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

অনেকের মধ্যে 'অস্বীকার করার' প্রবণতাও তৈরি হয়। তারা এসব দাগ বা ত্বকের ক্ষতি ঢাকতে গিয়ে আরো বেশি ক্ষতি করে ফেলেন, বলছেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?
রূপ বিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান বলছেন, প্রসাধনী পণ্য বাছাইয়ে সতর্ক হতে হবে।

তিনি বলছেন, হুট করে বা অন্যদের দেখে কোন প্রসাধনী ব্যবহার করা উচিত না। কারণ একজনের ত্বকের জন্য সেটি ঠিক হলেও, আরেকজনের জন্য সেটি ভালো নাও হতে পারে।

বাসায় বসে ত্বকের জন্য হার্বাল পণ্য ব্যবহার করা ভালো। ডিম, দুধ, মধু, দই শসা- সমস্ত কিছু ত্বকের জন্য ভালো। তৈলাক্ত ত্বক বা শুষ্ক ত্বক অনুযায়ী এসব পণ্য তারা ত্বকের জন্য ব্যবহার করতে পারেন, কারণ এগুলোতে ক্ষতিকর কিছু নেই।’

তিনি বলছেন, ‘অনেক রং ফর্সাকারী ক্রিমেই ত্বক পাতলা হয়ে যায় বা ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। পরে দেখা যায়, তারা রোদে বের হতে পারছেন না বা অন্য কিছু ব্যবহার করতে পারছেন না। পরে পুরো ত্বকের ব্যাপারটি তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।’

এ কারণে আমি সবাইকে বলতে চাই, রং ফর্সাকারী ক্রিমের দিকে একেবারেই না তাকানোর জন্য। বরং সবাইকে বলবো, ঝকঝকে সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর একটি ত্বকই যথেষ্ট, ফর্সা হওয়া জরুরি নয়।


আরো সংবাদ



premium cement