২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খাবার গ্রহণে সতর্ক হোন

এই পছন্দের খাবারের সাথেই আপনি হয়তো খেয়ে নিচ্ছেন মারাত্মক কোনো অসুখের জীবাণুটাকে - সংগৃহীত

মুখরোচক পছন্দসই খাবার পেলে আমরা কোনো বাছ বিচার না করেই মুখে পুড়ে দেই। কিন্তু আপনি জানেন কি? এ পছন্দের খাবারের সাথেই আপনি হয়তো খেয়ে নিচ্ছেন মারাত্মক কোনো অসুখের জীবাণুটাকে। কারণ খাদ্য গ্রহণে অসতর্কতার জন্য বেশির ভাগ রোগের জীবাণু খাদ্য ও পানির মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। তাই শুধু একটু খাদ্য সতর্কতা, সাবধানতা, কিছু পরামর্শ মেনে চললেই আপনি বেঁচে থাকতে পারেন কঠিন কোনো অসুখের ছোবল থেকে। আসুন দেখা যাক খাদ্য সতর্কতার এ বি সি ডি ও ই গুলো কী কী-

(অ) ‘এ’ ফর এডিটিভস : রঙ মেশানো খাবার সুন্দর দেখায়, এটা সবাই জানেন। কিন্তু বিপদের কথা হলো আজকাল খাবারে যেসব রঙ মেশানো হচ্ছে (যেমন মেটালিক ইয়েলো) তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই বিপজ্জনক। এদের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্বন্ধে যা জানা গেছে তার তালিকা না বাড়িয়ে এটুকুই বললেই যথেষ্ট হবে যে, এরা ক্যান্সারের অগ্রদূত। তাই সবার জন্য পরামর্শ এই, ঘরে তৈরি খাবার বেশি বেশি খান, দোকানের খাবার যথাসম্ভব পরিহার করুন। কৃত্রিম রঙ ও প্রিজারভেটিভ ব্যবহৃত হচ্ছে না যেসব খাবারে শুধু সেগুলোই কিনুন। এ তো গেল রঙের কথা। এসব ছাড়াও আপনার পছন্দের প্যাকেট স্যুপ, টিনজাত খাবার, পটেটো চিপস ও সসের মধ্যে থাকে মোনাসোডিয়াম গ্লুটামেট, যা অনেকের মাথাব্যথা ও অ্যালার্জি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা ও ছোট শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। যাদের উচ্চরক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের এসব খাবার থেকে কিডনির অসুখ হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য কর্নফ্ল্যাকার্স হতে পারে বিপজ্জনক।

(ই) ‘বি’ ফর ব্যাকটেরিয়া : ব্যাকটেরিয়া ফুডপয়জনিংয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। এরা খুব তাড়াতাড়ি খাদ্যের দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে এবং টকসিন তৈরির মাধ্যমে খাদ্যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে বোতলজাত খাবার, আচার, জেলি, নোনা মাছ, হোটেলের খাবার বা ঘরে খাদ্য বাসি হলে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব খাদ্য গ্রহণের ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে বমি, পাতলা পায়খানা, চোখে ঝাঁপসা দেখা বা শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। তাই এমনটি হলে জলদি ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

(ঈ) ‘সি’ ফর ক্যানফুড : ক্যানজাত খাবার সংরক্ষণের অসতর্কতার জন্য অনেক সময় হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। ক্যানের মুখটা প্রথম ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। পরে ছিদ্র করে বা কেটে নিন। টিনের খাবার খোলাভাবে ফেলে রাখবেন না, ফ্রিজে রেখে দু’দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলুন। আর ফ্রিজ নিয়মিত পরিষ্কার করুন এবং পরিমিত তাপমাত্রায় রাখুন।

(উ) ‘ডি’ ফর ড্রেন : বাসন-কোসন ধোয়ার পর রান্নাঘরের ড্রেন পরিষ্কার করুন। খেয়াল রাখবেন, যেন ড্রেনের মুখে ময়লা বেঁধে না থাকে। সপ্তাহে অন্তত একবর গরম পানিতে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে পরিষ্কার করুন।

(ঊ) ‘ই’ ফর এগ : ডিম অবশ্যই ভালোভাবে সেদ্ধ করে খাওয়া উচিত। কাঁচা কখনোই খাবেন না। এতে টাইফয়েড জীবাণু থাকতে পারে। কাঁচা ডিম ধরার পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলুন। ডিম সব সময় ফ্রিজে রাখুন এবং শিগগিরই খেয়ে ফেলুন। সর্বোপরি রয়েছে আমাদের হাত। হাতের মাধ্যমে সাধারণত বেশির ভাগ জীবাণু সংক্রমিত হয়। তাই হাত সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। বিশেষ করে বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর, ময়লা-আবর্জনা ধরার পর হাত অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। আসুন এসব খাদ্যসতর্কতা মেনে চলে আমরা হয়ে উঠি খাদ্যসচেতন, দেহকে করে তুলি রোগমুক্ত।

 

আরো পড়ুন : সুস্বাস্থ্যের জন্য খাবার

ডা: সেহেলী জাহান

যুগ যুগ ধরে যখন মানুষ আমিষ খেয়ে আসছে, তখন এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কী সেই কারণ? প্রাথমিকভাবে আমিষ খাওয়ার কারণ অবশ্যই স্বাদ। আমিষ খাওয়া শুরু হয়েছিল যে সময়ে সেই সময় অবশ্য মানুষ কেবল পেটের ক্ষুধা মেটাতেই শিকার করত এবং গোশত খেত; কিন্তু আগুন আবিষ্কারের পর কোনো সন্দেহ নেই গোশত খাওয়ার প্রধান কারণ স্বাদ। নানা উপায়, নানা কায়দায় খাওয়া হয় নানা ধরনের গোশত।

গোশত খাওয়ার প্রধান কারণ প্রোটিন। আমিষ তথা গরু, ভেড়া, ছাগল, হরিণ ও মাছ প্রভৃতি থেকে পাওয়া যায় প্রাণিজ প্রোটিন, যার প্রয়োজন কোষের পুষ্টির জন্য। আমরা জানি শিশু বড় হয়ে ওঠার সময় তো বটেই, বয়সীদেরও কোষ বিভাজন হচ্ছে অনবরত। আর এই কোষের পুষ্টির জন্য, কোষ তৈরির জন্য প্রয়োজন প্রোটিনের। বলে রাখা প্রয়োজন, যে প্রোটিনে অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে সেটি সম্পূর্ণ প্রোটিন। আর আমিষ প্রোটিনেই আছে অ্যামাইনো অ্যাসিড। আমিষের দ্বিতীয় গুণ হলো এর মধ্যে ভিটামিন বি-১২ এর উপস্থিতি। যার প্রয়োজন শরীরের মধ্যে যাওয়া খাদ্যসম্ভার থেকে লোহা টেনে নিয়ে হজম করানো। প্রোটিনের অর্থাৎ প্রাণিজ প্রোটিনের তৃতীয় গুণ হলো এটি শক্তি অর্থাৎ এনার্জি প্রদানকারী।

বাঙালিসহ পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ মনে করে আমিষ, প্রোটিন ছাড়া শরীর সুস্থ রাখা অসম্ভব। আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যারা বেশি মাথার কাজ করেন তাদের জন্য এই প্রাণিজ পুষ্টি অত্যন্ত জরুরি। প্রাণিজ প্রোটিন ছাড়া যে শরীর সুস্থ রাখা যায় এবং সহজেই তা সম্ভব তার প্রসঙ্গে এবার বলা যাক। নিরামিষ খেয়ে যে মাথা মোটাদের সংখ্যা বাড়ে না তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ভারতে নিরামিষ খান এমন মানুষের এলাকায় গেলে। পরিসংখ্যান বলে সেখানে ঘাটতি পড়ে না ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিকের জোগান। মাথার অর্থাৎ মস্তিষ্কের পুষ্টির জন্য কখনোই আলাদা করে প্রাণিজ প্রোটিন প্রয়োজন হয় না। সুষম খাদ্য পেলে শরীরের অন্যান্য অংশের মতোই মস্তিষ্কের পুষ্টি সাধন হবে। আর শরীরের জন্য? সবাই অবশ্যই জানেন গরু, হাতি, গণ্ডার প্রভৃতি প্রাণীর শরীরের ওজন ওয়েইং স্কেলের বেশ ওপরের দিকেই যাবে। এই বিশাল বপুর জন্তুদের শরীর কিন্তু পুষ্ট ও সুস্থ থাকে কেবল নিরামিষ ভক্ষণেই।

এবার বলে নেয়া যাক প্রাণিজ প্রোটিনের বিকল্পগুলো। প্রাণিজ প্রোটিনে থাকা ভিটামিন বি-১২ অতি সহজেই পাবেন দুধে, যা সহজেই আপনার শরীরে থাকা লোহাকে হজম করিয়ে দেবে। আর এনার্জি? সহজেই পাওয়া যাবে কার্বোহাইড্রেট বা চিনি জাতীয় খাদ্যে। নিরামিষাশীদের সংখ্যা বাড়ছে। সারা পৃথিবী এখন ঝুঁকছে নিরামিষ খাদ্যের দিকে। ভাবলে অবাক হতে হয়; কিন্তু এটাই সত্যি, এটাই ঘটনা। প্রাণিজ প্রোটিন যারা গ্রহণ করেন না, তারা অনেক বেশি সুস্থ থাকেন। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখুন, ব্রিটেনে একজন আমিষাশীর বছরে চিকিৎসার খরচ লাগে ৫৮.০৬২ পাউন্ড। অথচ একজন নিরামিষাশীর চিকিৎসার খরচ বছরে মাত্র ১২.৩৪০ পাউন্ড। এত গেল অর্থনৈতিক ফারাক, আর স্বাস্থ্য? যদি ১০০ জন আমিষাশী শারীরিক পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যান তা হলে তুলনায় মাত্র ২২ জন নিরামিষাশী শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালমুখী হন। বেশ কিছুদিন আগে সমগ্র ব্রিটেন এবং সেই সাথে প্রায় গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠছিল একটি নামে ‘বোভাইন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফালোপ্যাথি’। পুরো নামটা বোধহয় বোঝা গেল না, স্বাভাবিক। ‘ম্যাড কাউ ডিজিজ’ বললেই সবাই লাফিয়ে উঠবেন। এই ম্যাড কাউ ডিজিজের ফলে গত তিন বছরে ব্রিটেনে নিরামিষাশীদের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

এবার একটু অন্যতম তথ্যে আসা যাক। আমিষাশীরা নিরামিষাশীদের থেকে বেশি অসুস্থ হন। কিন্তু তা কী ধরনের?
- যারা নিরামিষ খান তাদের রক্তে কোলস্টেরলের মাত্রা অনেক কম। আমিষাশীদের তুলনায় ২০% কম। ফলে নিরামিষ যারা খান তাদের হৃদরোগের আশঙ্কাও অনেক কম।
- গরু ও ভেড়ার গোশত এবং প্রচুর পরিমাণে মাছ খেলে পেটে ক্যান্সারের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যায়। খাদ্যনালীতে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ মাংসের চর্বি।
- আমিষাশী মহিলারা স্তনের ক্যান্সারে ভোগেন তুলনামূলক অনেক বেশি।
- জাপান, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষরা মাছ খান বেশি। এদের পাকস্থলীতে ক্যান্সারও হয় বেশি।
- আমিষাশীদের পেটে পাথর জমে তুলনামূলক অনেক বেশি। এক হাজার জনের মধ্যে ২৫০ জনের পেটে পাথর জমে কেবল আমিষ খাওয়ার কারণে।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তামাক, মদ ও মাদকের প্রভাবে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। এরপরই মৃত্যুর বড় কারণ গোশত।

লেখক : অধ্যাপিকা ও বিভাগীয় প্রধান, নিউরোমেডিসিন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ।


আরো সংবাদ



premium cement