২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হাঁটু ব্যথার কারণ ও প্রতিকার

ব্যথা অবস্থায় হাঁটুকে বিশ্রাম দিতে হবে - সংগৃহীত

হাঁটু ব্যথার রোগী প্রায় প্রতিটি পরিবারেই দেখতে পাওয়া যায়। এর বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রধান কারণ অস্টিও আর্থ্রাইটিস বা অস্থিসন্ধির ক্ষয়জনিত কারণ। আমাদের দেহের প্রতিটি সন্ধি বা জয়েন্টের মতোই হাঁটুর জয়েন্টের হাড়ও নরম এবং মসৃণ আবরণ বা কার্টিলেজ দ্বারা আবৃত। এই কার্টিলেজ যখন ক্ষয় হয়ে অমসৃণ আকার ধারণ করে তখন জয়েন্ট নাড়াচাড়ায় ব্যথা অনুভূত হয়, জয়েন্ট ফুলে যায়। এটি অস্টিও আর্থ্রাইটিস বা হাঁটুর এক প্রকার বাত।

যে যে কারণে হাঁটুর অস্টিও আর্থ্রাইটিস হয় :

বয়সজনিত ক্ষয় : বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত ৪৫ থেকে ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সে এই রোগ বেশি হয়।

লিঙ্গ : সাধারণত পুরুষের তুলনায় মহিলাদের আর্থ্রাইটিস বেশি হয় এবং তা মনোপোজ বা মাসিক বন্ধের পর। কিংবা যাদের হিস্টেরেক্টমি সার্জারি হয়েছে।

অধিক দৈহিক ওজন : হাঁটু হচ্ছে মানবদেহের অন্যতম ওজন বহনকারী সন্ধি। তাই অতিরিক্ত দৈহিক ওজন হাঁটুতে অধিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে হাঁটুর ক্ষয় বেশি হয়।

মাংসপেশির দুর্বলতা : দুর্বল মাংসপেশি হাঁটুর সন্ধিকে তার স্বাভাবিক স্থানে ধরে রাখতে পারে না। ফলে ঘর্ষণ বেশি হয়, ক্ষয়ও বেশি হয়।

আঘাতজনিত কারণ বা জয়েন্ট ইঞ্জুরি

অস্থিসন্ধির তরল পদার্থ বা সাইনোভিয়াল ফ্লুয়িড কমে গেলে : দেহের বড় বড় জয়েন্টের ভেতর এক প্রকার তরল পদার্থ থাকে যা জয়েন্ট নাড়াচাড়া করতে সাহায্য করে। এই তরল পদার্থ কমে গেলে জয়েন্টে ঘর্ষণ বেশি হয়। ফলে ক্ষয়ও বেশি হয়।

পেশাজনিত কারণ : যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করেন, অতিরিক্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন এবং যারা অতিরিক্ত ভার বহন করতে হয় এমন কাজ করেন তাদের হাঁটুর ব্যথা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

তা ছাড়া জেনেটিক বা বংশগত কারণ, জন্মগতভাবে অস্বাভাবিক বা ম্যালফরমড জয়েন্ট ইত্যাদি কারণেও হাঁটুর অস্টিও আর্থ্রাইটিস হতে পারে।

উপসর্গ :
১. হাঁটুতে ব্যথা।
২. হাঁটু ফুলে যাওয়া।
৩. হাঁটু গরম অনুভূত হওয়া।
৪. হাঁটু ভাঁজ করতে না পারা বা জয়েন্ট জমে আছে এমন বোধ হওয়া।
৫. জয়েন্টের আকৃতি পরিবর্তন।
৬. কখন কখন হাঁটুর নাড়াচাড়ায় শব্দ অনুভূত হয়।

রোগ নির্ণয় : এ ক্ষেত্রে সাধারণত রোগীর বয়স, উপসর্গ, রোগের ইতিহাস, কিছু ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশনের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু রেডিওলজিক্যাল এবং প্যাথলজিক্যাল টেস্টও করা হয়। যেমন: x-ray, MRI, Bone mineral density test, Rh factor, serum calcium level ইত্যাদি।

চিকিৎসা :
মেডিসিন : সাধারণত ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ দেয়া হয়। তা ছাড়া ক্ষয় পূরণের জন্য ডায়টারি সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়।
ফিজিওথেরাপি : ব্যথা নিরাময় এবং জয়েন্টের স্বাভাবিক মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনার জন্য ফিজিওথেরাপি একটি আধুনিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি। হাঁটুর অস্টিও আর্থ্রাইটিসের জন্য ব্যবহৃত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাগুলো হলো : আলট্রা সাউন্ড থেরাপি, শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি, টেনস থেরাপি, ইন্টার ফেরেনসিয়াল থেরাপি, লেজার থেরাপি, হাঁটুর শক্তি বাড়ানোর জন্য বিশেষ ব্যায়াম।

ইন্ট্রা আর্টিকুলার ইঞ্জেকশন : জয়েন্ট ফ্লুয়িড কমে গেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ইন্ট্রা আর্টিকুলার ইঞ্জেকশন দিয়ে থাকেন।
সার্জারি : কখনো কখনো হাড়ের ক্ষয় মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি করার প্রয়োজন হয়।

হাঁটুর আর্থ্রাইটিসে করণীয় :
১. ব্যথা অবস্থায় হাঁটুকে বিশ্রাম দিতে হবে।
২. দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকা যাবে না।
৩. সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা কম করতে হবে।
৪. ব্যথা অবস্থায় হাইকমোড ব্যবহার করতে হবে।
৫. ব্যথা অবস্থায় বসে নামাজ পড়তে হবে।
৬. বসা থেকে ওঠার সময় সাপোর্ট নিয়ে উঠতে হবে।
৭. হাঁটার সময় হাঁটুর সাপোর্ট হিসাবে- নি ক্যাপ, নি ব্রেস, ওয়াকিং এইড ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর্থ্রাইটিস থেকে বাঁচার উপায় : যদিও হাড়ের ক্ষয় একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া তবুও প্রথম থেকেই কিছু নিয়ম মেনে চললে ক্ষয়কে দূরবর্তী করা যেতে পারে। যেমন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ও এলকোহলমুক্ত জীবনযাপন।

লেখক : ফিজিওথেরাপিস্ট, কিউর মেডিক্যাল অ্যান্ড জেনারেল হসপিটাল, গুলশান।
ফোন : ০১৭১২-০৯২৯০৫

 

আরো পড়ুন : মচকে গেলে কী করবেন?

আমাদের শরীরে অনেক জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধি রয়েছে। প্রতিটি জয়েন্টের চার পাশে থাকে একাধিক সংখ্যক লিগামেন্ট। এই লিগামেন্টের কাজ হচ্ছে জয়েন্টের হাড়গুলো যথাস্থানে রাখা ও নড়াচড়ায় সাহায্য করা। একটি নির্দিষ্ট কোণ পর্যন্ত সহজে নড়াচড়া করা যায়। তবে এর বেশি করতে গেলে ব্যথা লাগে। কোনো কারণে সীমার বাইরে নড়াচড়া হলে কিংবা জয়েন্টের লিগামেন্টগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হলে লিগামেন্টে টান পড়ে বা কিছু অংশ ছিঁড়ে যায়। একেই মচকে যাওয়া বলে।

উপসর্গ
জয়েন্টের চার পাশের লিগামেন্ট ও টিস্যুতে টান পড়লে কিংবা ছিঁড়ে গিয়ে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দেয় :
- জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হওয়া
- আক্রান্ত জয়েন্ট নাড়াতে গেলে ব্যথা বেড়ে যাওয়া
- জয়েন্টের চারপাশে ফুলে যাওয়া
- সচরাচর গোড়ালি বেশি আক্রান্ত হয়


কী করবেন
- আঘাতপ্রাপ্ত জয়েন্টকে বিশ্রামে রাখুন এবং সাপোর্ট দিন। 
- জয়েন্টটিকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন, অথবা জায়গাটিতে ঠাণ্ডা সেঁক দিন। 
- জয়েন্টের চারপাশে ভেজা গজ বা ভেজা তুলা রাখুন এবং সেটাকে ব্যান্ডেজ দিয়ে সামান্য শক করে বাঁধুন।

ফলোআপ 
- তিন দিন পর ব্যান্ডেজ খুলে ফেলুন
- জয়েন্ট গরম পানিতে ভেজান
- গরম ব্যান্ডেজ বাঁধুন 
- পূর্ণ বিশ্রাম নিন

দু’দিন পর
- ব্যান্ডেজ ও ড্রেসিং খুলে ফেলুন
- যদি কালশিরা মিলিয়ে যেতে শুরু করে, জয়েন্ট নড়াচাড়া করা শুরু করুন।

হাঁটু মচকে গেলে
হাঁটু এমন একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ জোড়া যা বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে, দৌড়াতে, উপরে উঠতে এবং নামতে একান্ত প্রয়োজন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজ করতে গিয়েই হাঁটু মচকায়। শরীরের ওজন বহনকারী জোড়াগুলোর মধ্যে হাঁটু অন্যতম। এটি তিনটা হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। হাঁটুতে চারটি প্রধান লিগামেন্ট ও দু’টি মেনিসকাস থাকে।

লিগামেন্ট হলো ইলাসটিক টিস্যু, যা এক হাড়কে অন্য হাড়ের সাথে যুক্ত করে, জয়েন্টে শক্তি প্রদান করে, হাড়ের নড়াচড়ায় অংশগ্রহণ করে এবং জয়েন্টের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।

আর মেনিসকাস শরীরের ওজন সমভাবে ঊরুর হাড় থেকে পায়ের হাড়ে সরবরাহ করে, হাড়ের প্রয়োজনীয় নড়াচড়ায় সহায়তা করে এবং জয়েন্টের দৃঢ় অবস্থা বজায় রাখে।

হাঁটু মোচড় চেপে মচকে গেলে হাঁটুর লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে লিগামেন্ট বিস্তৃত হতে পারে কিংবা আংশিক বা সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যেতে পারে। মেনিসকাসের বিভিন্ন ইনজুরি হয়। মেনিসকাস আংশিক বা সম্পূর্ণ ছিঁড়ে যেতে পারে। ৭০ শতাংশ মোচড়ের আঘাতে এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্টের সাথে মেনিসকাস ইনজুরি থাকে।

কারণ
- হঠাৎ হাঁটু মোচড় খেলে
- রিকশা থেকে পড়ে গেলে 
- গাড়ি বা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা
- খেলাধুলা করার সময় যেমন-ফুটবল, বাস্কেটবল, হকি, কাবাডি খেলা
- মই থেকে পড়ে গেলে।
- উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়লে
- গর্তে পড়ে গেলে
- সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় এক ধাপ ভুল করলে
- হাঁটুর বাইরের দিকে সরাসরি আঘাত

উপসর্গ
- প্রথমে তীব্র ব্যথা হওয়া, পরে আস্তে আস্তে ব্যথা কমে যাওয়া
- ব্যথা হাঁটুর বাইরের পার্শ্বে এবং পেছনে অনুভূত হবে
- হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়
- আঘাত পাওয়ার প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই হাঁটু ফুলে যাওয়া
- ফোলা ও ব্যথার জন্য হাঁটু নাড়াতে না পারা
- দাঁড়াতে বা হাঁটতে চেষ্টা করলে হাঁটু বেঁকে যাচ্ছে মনে হওয়া
- হাঁটু অস্থিতিশীল বা ঘুরে যাচ্ছে মনে হওয়া

কী করবেন
- হাঁটুকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
- জায়গাটিতে ঠাণ্ডা সেঁক দেবেন।

একটি কাপড়ে বরফের টুকরা নিয়ে অথবা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ব্যথা ও ফোলার জায়গায় চেপে রাখুন, এতে ব্যথা ও ফোলা কমে যাবে।

প্রতি ঘণ্টায় ১০ মিনিট বা দুই ঘণ্টা পর পর ২০ মিনিট অনবরত লাগাবেন। তবে ঠাণ্ডা অবশ্যই সহ্যের মধ্যে রাখতে হবে। এই পদ্বতি আঘাতের ৪৮-৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত চলবে।

- হাঁটুতে ইলাসটো বা স্প্রিন্ট ব্যবহার করলে ব্যথা ও ফোলা কমে যাবে।
- হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে হাঁটুকে হৃৎপিণ্ডের সমরেখা থেকে উঁচুতে রাখবেন। এতে ফোলা কমবে।
- রোগীকে ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে। 
- অতঃপর রোগীকে অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে পাঠাবেন যিনি হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরির চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিঃ, ২, ইংলিশ রোড, ঢাকা।
ফোন: ০১৬৭৩৪৪৯০৮৩ (রোমান)


আরো সংবাদ



premium cement