শিশুদের পাইলস সমস্যা
- অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক
- ১৪ আগস্ট ২০১৮, ১৫:১০, আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০১৮, ১৫:১৫
পাইলস শিশুদেরও হয়। তবে প্রকৃত পাইলস শিশুদের কম হয়। প্রথমেই আমরা আলোচনা করব পাইলস রোগটি আসলে কী? কারণ এটি নিয়ে বিস্তর বিভ্রান্তি রয়েছে। শিশুদের পাইলস হলে বড়দের চেয়ে বেশি রক্ত যায়। গত নয় বছরে মলদ্বারের সমস্যায় আক্রান্ত ২৯ হাজার ৬৩৫ জন রোগীর ভেতর ছয়টি শিশুর পাইলস দেখেছি। এক শিশু পাঁচ মাস বয়স থেকে, অন্য আরেকিট শিশু তিন বছর বয়স থেকে রক্ত যেতে যেতে মূর্ছা যেত। এর পর রক্ত দিলে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠত। এ দু’জনকে বিনা অপারেশনে রিংলাইগেশন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করায় সম্পূর্ণ ভালো হয়েছে। তবে অভিভাবকরা শিশুদের যে পাইলসের সমস্যা অর্থাৎ টয়লেটে রক্ত গেলে চিকিৎসকের কাছে আসেন তাদের বেশিরভাগই পাইলস নয়। শিশুদের টয়লেটে রক্ত যাওয়ার প্রধান কারণ রেকটাল পলিপ। এটি একধরনের আঙুর ফলের মতো টিউমার, যা ক্যান্সার নয়। এ টিউমার থেকে প্রচুর রক্ত যায়। এগুলো এক বা একাধিক হতে পারে এবং এরূপ শত শত পলিপ থাকতে পারে যা থেকে সাধারণত রক্ত ও মিউকাস বা আম যায়।
রোগীর অভিভাবকরা মনে করেন, এটি রক্ত আমাশয় এবং ওষুধ দিয়ে ভালো করা যাবে। রেকটাল পলিপ রোগের চিকিৎসা হচ্ছে এটিকে কেটে ফেলে দেয়া। রোগীকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এটি করতে হয়। অভিভাবকদের ভয়, ছোট্ট শিশুকে অজ্ঞান করলে তার ক্ষতি হবে। কিন্তু বহু দিন রক্ত যাওয়ায় শিশুটি যে রক্তশূন্যতায় ভুগছে সেদিকে তাদের লক্ষ্য থাকে না। সবচেয়ে অসুবিধা হচ্ছে, দাদী-নানীরা অপারেশনের কথা শুনলেই একেবারে বেঁকে বসেন। তাদের ধারণা, এতটুকুন শিশুকে কখনো অজ্ঞান করা উচিত নয়। তারপর অনন্যোপায় হয়ে আধুনিক তরুণ বাবা-মা বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ধরনা দেন চিকিৎসায় এ রোগ ভালো করার জন্য। কিন্তু সেটি কোনো ডাক্তারের পক্ষেই সম্ভব নয়।
রেকটাল পলিপ অপারেশনের জন্য একটি শিশুকে কয়েক ঘণ্টা হাসপাতালে রাখলেই চলে। রোগীর পেট খালি করার জন্য আগের দিন কিছু ওষুধ দেয়া হয় যাতে পায়খানা পরিষ্কার হয়। খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খালি পেটে অপারেশন করাই ভালো। এ জন্য রোগীকে ঘুম পাড়ানোর ইনজেকশন দিতে হয়। একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যে টিউমারটি (পলিপ) কেটে আনা হয়। যেহেতু এ অপারেশনে মলদ্বারে কোনো কাটাছেঁড়া করা হয় না, তাই অপারেশনের পর ব্যথা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অপারেশনের দু-তিন ঘণ্টা পর রোগী স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করতে পারে এবং সরাসরি বাসায় চলে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বহির্বিভাগের রোগী হিসেবে পরক্ষণেই চলে যেতে পারে।
শিশুদের জন্য একটি সমস্যা হয়। এতে পায়খানা শক্ত হলে মলদ্বার ফেটে যায় এবং ব্যথা হয়। কিছুটা রক্তও যেতে পারে। কিছু দিন পর মলদ্বারে একটি গ্যাজ দেখা যায়। শিশু টয়লেটে যেতে ভয় পায় ব্যথার কারণে। এ রোগটির নাম এনাল ফিশার। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক মল নরম করার জন্য ওষুধ দেন। পানি, সবজি, সালাদ খেলে উপকার পাওয়া যায়। পায়ুপথে মলম লাগানো যেতে পারে। চুলকানি হলে কৃমির ওষুধও দিতে হবে। জন্মের পর পরই যেকোনো সময় এ রোগ হতে পারে। সর্বকনিষ্ঠ এক মাস দশ দিনের শিশুকে দেখেছি এ রোগে আক্রান্ত হতে। উপরোক্ত পদ্ধতি ও ওষুধ প্রয়োগেও ভালো না হলে অপারেশন করতে হয়।
মলদ্বারে শিশুদেরও হয় সেরকম আরেকটি রোগ হচ্ছে ফিস্টুলা বা ভগন্দর। এতে মলদ্বারের পাশে একটি মুখ থেকে পুঁজ ও রক্ত যায় এবং ব্যথা হয়। ১৭ মাসের একটি শিশুর এ রোগ দেখেছি। এ রোগের একমাত্র চিকিৎসা অপারেশন, তবে এটি শিশুদের খুব কম হয়।
মলদ্বারের প্রতিটি রোগের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে এবং এর প্রতিটিতেই সঠিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায়।
বড়দের যে রোগটি সবচেয়ে বেশি হয় সেটি হলো পাইলস। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন ৮০-৯০ শতাংশ পাইলস রোগী বিনা অপারেশনে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন। এ পদ্ধতির নাম হচ্ছে ‘রিং লাইগেশন’ পদ্ধতি। কোনোরূপ অবশ, অজ্ঞান না করেই চেম্বারেই এর চিকিৎসা করা হয়। যে ক্ষেত্রে অপারেশন দরকার সে ক্ষেত্রেও দু-তিন দিন মাত্র হাসপাতালে থাকতে হয়। অপারেশনের পর পাইলস আবার হয় এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। তবে ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আবার হতে পারে। পেটে কৃমি থাকলে তার অবশ্যই চিকিৎসা করা উচিত। তবে কৃমির বাসা থেকে এ রোগের উৎপত্তি এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।
লেখক : বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, (অব) কলোরেকটাল সার্জারী বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা।
চেম্বার : ইডেন মাল্টি-কেয়ার হসপিটাল, ৭৫৩, সাতমসজিদ রোড, (ষ্টার কাবাব সংলগ্ন) ধানমন্ডি, ঢাকা। ফোন : ০১৭৫৫৬৯৭১৭৩-৬,
আরো পড়ুন : চিকিৎসকের দৃষ্টিতে পাইলস ফিস্টুলা না ক্যান্সার
অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক
পাইলস রোগটি আমাদের দেশের সাধারণ রোগীদের কাছে পরিচিত একটি রোগ। সর্বসাধারণের ধারণা পায়ুপথের বিভিন্ন সমস্যা যেমন রক্ত যাওয়া, ব্যথা হওয়া, ফুলে যাওয়া- এসবই হয় পাইলস রোগের কারণে। কিন্তু আসলে এ ধারণা সঠিক নয়। উপরোক্ত প্রতিটি উপসর্গই পায়ুপথে ক্যান্সার হলে হতে পারে। আবার ফিস্টুলা বা ভগন্দর রোগেও উপরোক্ত উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। আবার এমন হতে পারে যে, প্রথমত, পায়ুপথে ক্যান্সার হয়েছে সেটিও ফিস্টুলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, যেমন ইতোমধ্যেই লেখক একজন রোগীর (৬৫) অপারেশন করেছেন ফিস্টুলা হিসেবে কিন্তু মাংস পরীক্ষা (বায়োপসি) রিপোর্টে দেখা গেল ক্যান্সার। এই ফিস্টুলা রোগীটির যে ক্যান্সারের কারণেই ফিস্টুলা হয়েছে তা অপারেশনের পূর্বে কোনো পরীক্ষায় ধরা পড়েনি। ধরা পড়েছে শুধু অপারেশনের পর নিয়মিত মাংস পরীক্ষার রিপোর্টে। যদি ভুলক্রমে বা কোনোভাবে এ রোগীর বায়োপসি না করা হতো তাহলে তার ক্যান্সার ধরা পড়ত অনেক দেরিতে যখন চিকিৎসার অযোগ্য হতো।
আশার কথা এই যে, লেখক মোটামুটি সব ফিস্টুলা রোগীর নিয়মিত মাংস পরীক্ষা করে থাকেন। এ রোগীর ইতিহাস নিয়ে দেখা যায় তিনি নিজে একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। চার বছর ধরে তার এই সমস্যা চলছে এবং তিনি নিজে চিকিৎসক বলে হোমিও ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন। তার মলদ্বার থেকে দূরে একটি মুখ থেকে পুঁজ ও রক্ত পড়ত। এটিকে সাধারণ ফিস্টুলা মনে করে তিনি নিজে দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খাচ্ছিলেন। বেশির ভাগ ফিস্টুলা রোগীর ক্যান্সার থাকে না। পায়ুপথের ক্যান্সার যখন দীর্ঘদিন চিকিৎসাবিহীন থাকে তখন এটি মলদ্বারের পাশে ছিদ্র হয়ে বের হয়ে আসে এবং সেখান থেকে পুঁজ যায় আবার কখনো কখনো রক্ত যায়।
লেখকের দেখা অন্য একজন মহিলা রোগী (৫৫) যিনি রাজধানীর একটি কলেজের অধ্যাপক। গত দেড় বছর যাবত মলদ্বারে রক্ত যাচ্ছে। পায়খানা ক্লিয়ার হয় না। নিজে নিজে ল্যাক্সেনা ট্যাবলেট খাচ্ছেন পেট পরিষ্কার করার জন্য। পায়খানার বেগ এলে কিছু তরল জিনিস বের হয়ে আসে কিন্তু পায়খানা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে এরূপ ভাব। মাঝে মাঝে টয়লেটে রক্ত যায়। ইদানীং মলদ্বারে ও কোমরের নিচের দিকে ব্যথা মলদ্বার থেকে পিছন দিকে ছড়িয়ে পড়া ব্যথা। এখানে উল্লেখ্য, ভেতরের ব্যথা কোমরে অনুভূত হতে পারে আবার ঊরুর দিকেও সম্প্রসারিত হতে পারে।
এই রোগীর প্রাথমিক ইতিহাস শোনার পর লেখকের স্বাভাবিকভাবেই একটু সন্দেহ হয়েছে। অতঃপর তার সিগময়ডস্কপি ও প্রকটস্কপি পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে তার রেকটামের ভেতর ক্যান্সার আছে। কিন্তু রোগীর বিশ্বাস তিনি পাইলসে ভুগছেন। বিস্তারিত ইতিহাস না নিলে ভুল হতো। কারণ রোগীর সাদামাটা বক্তব্য হচ্ছে, তার রক্ত যায় এবং পায়খানা ক্লিয়ার হয় না। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে রোগীরা মলদ্বারের ভেতর যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করাতে চান না। ব্যথা হতে পারে এই ভেবে খুব ভয় পেয়ে যান। জিজ্ঞাস করেন যে, এই পরীক্ষা করলে আমি আগামীকাল অফিসে যেত পারব কিনা?
এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, এ পরীক্ষায় সামান্য অস্বস্তি ছাড়া কোনোরূপ ব্যথা হয় না। বেশির ভাগ রোগীই এ পরীক্ষায় কোনোরূপ ব্যথা পান না। এ পরীক্ষার জন্য খুবই সামান্য সময়ের প্রয়োজন। সারা দিন না খেয়ে থাকার প্রয়োজন হয় না। মলদ্বারে তীব্র ব্যথা আছে এমন রোগীদেরও এ পরীক্ষা করা যায়।
রোগীদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই যে, উপরোক্ত সমস্যা দেখা দিলে সবারই ক্যান্সার হয়েছে। তবে এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যেসব রোগে পায়খানার সাথে রক্ত যায় তার মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্ত যায় যেসব রোগে সেগুলো হচ্ছে ০১. এনাল ফিসার ০২. পাইলস ০৩. রেকটাল পলিপ (শিশুদের বেশি হয়) ০৪. ক্যান্সার ০৫. আলসারেটিভ কেলোইটিস ০৬. ফিস্টুলা ও অন্যান্য।
আমরা মফস্বল থেকে আসা অনেক রোগী দেখি যাদের ক্যান্সার আছে অথচ হাতুড়ে চিকিৎসকরা তাদের ইনজেকশন দিচ্ছেন। কোনো কোনো হাতুড়ে চিকিৎসক আবার একধাপ এগিয়ে সেখানের অপারেশনেরও মহড়া দিচ্ছেন। আবার কখনো কখনো একই রোগীর পাইলস ও ক্যান্সার থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি পাইলসের চিকিৎসা করি তাহলেও দেখা যায় যে রোগীর সমস্যা যাচ্ছে না, তখন মলদ্বারের ভেতর লম্বা যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা (সিগময়ডস্কপি বা কোলনস্কপি) করলে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এ জাতীয় সমস্যাও মাঝে মধ্যে দেখা যায়।
মোট কথা, মলদ্বারের মুখ থেকেও রক্ত যেতে পারে আবার অনেক ভেতর অর্থাৎ রেকটাম বা বৃহদান্ত্রের (Colon or large intestine) ভেতর থেকেও রক্ত যেতে পারে। কি কারণে যাচ্ছে তা বিশেষ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একজন উপযুক্ত চিকিৎসক বলে দিতে পারেন। কিছু কিছু রোগী বলেন যে, আমার পাইলস হয়েছে আমাকে কিছু ওষুধ দেন খেয়ে দেখি পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার নেই। কিন্তু লেখক বিশেষ ধরনের পরীক্ষা না করে অনুমান নির্ভর পাইলস চিকিৎসার বিপক্ষে। কারণ এতে যে রোগীদের ক্যান্সার আছে তা শনাক্তকরণে বিলম্ব হবে। বিলম্বিত চিকিৎসায় ক্যান্সারে ভালো ফলাফল আশা করা যায় না।
লেখক : বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, (অব) কলোরেকটাল সার্জারী বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা।
চেম্বার : ইডেন মাল্টি-কেয়ার হসপিটাল, ৭৫৩, সাতমসজিদ রোড, (ষ্টার কাবাব সংলগ্ন) ধানমন্ডি, ঢাকা।
ফোন : ০১৭৫৫৬৯৭১৭৩-৬
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা